সোহানুর রহমান শাহীন

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

সাইকেল

মানুষ পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পর থেকে। সে আলো গায়ে মেখে মেখে বেড়ে ওঠা শুরু হয়। সেই শুরু থেকে বাস্তবচিত্র ধারণ করে মনের ভিতর, মস্তিস্কে। তাকে কেউ কেউ স্মরণ করতে পারে আবার কেউ কেউ ভুলে যায় অনায়াসে। কেউ কেউ সময়ের হাত ধরে বদলাতে বদলাতে পূর্ব স্মৃতি মনে করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। যাদের মনের মধ্যে কৃপণতা থাকে না মাঝে মাঝে তারাই স্মৃতির থলি হাতড়ায়। বের করে আনে কৈশর-শৈশব-যৌবনের বারো ভাজার খবর। বিশেষ করে শৈশবের জংধরা তালা খুলে যৌবনে হাজির করার মানুষের সংখ্যাও অনেক আছে। তবে শৈশবের চাবি হারানো তালায় তেল-মবিল না দিয়েই অনায়াসে তালা খুলে স্মৃতি মেলে ধরার দায় পড়েছে আমার। যেহেতু কিছু না হলেও শৈশব ফিরে পাবো সেই আশায়।

আমার শৈশবের স্মৃতির মধ্যে বাইসাইকেল চালানো শেখার কথা মনে পড়ে বারবার, কারণ হিসেবে এটা বলা যায় যে, বাইসাইকেল বহালতবিয়তে বিচরণ করছে কিশোর থেকে শুরু করে আশি বছর বয়সের বৃদ্ধর কাছে।

একটা সময় বাইসাইকেল চালানোর শখ মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম আর সব সময় ভাবছিলাম দুই চাকায় সাইকেল চলে! অনেকে আবার হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালায় আবার লাফিয়ে লাফিয়ে সাইকেলে ওঠে, এটাও সম্ভব! তবে একটি মাত্র চাকা দিয়ে যে সাইকেল চালানো সম্ভব তা সার্কাস খেলা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পরে অবশ্য বিভিন্ন ইলেকট্রনিক চ্যানেলের মাধ্যমে টিভির পর্দায় দেখানো হয়েছে এক চাকার সাইকেল খেলা।

আমাদের বাসায় সাইকেল ছিল না, পরিচিত তেমন কেউ নেই যাদের কাছে সাইকেল চালানোর জন্য চেয়ে পাওয়া যাবে। আবার দুয়েকজন আছেন যারা আমাকে সাইকেল চালাতে দিতে রাজি নয়। আমি ছোট ছেলে, যদি সাইকেল চালাতে গিয়ে আমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। বিমুখ হয়ে যাই পরিচিতজনের কাছে গিয়ে, আবার আবদার করি, আবার ফিরিয়ে দেন তারা। তবে কি সাইকেল চালানো শেখা হবেনা! মনে বল রেখে চেষ্টা চালাতে থাকি, হাল ছেড়ে দেবার মতো ছেলে আমি নই, সে বিশ্বাস আছে নিজের উপর।

আমাদের পাড়ায় অনেক ছেলেদের দেখা যায় তারা ছোট ছোট সাইকেল চালায় দলবেঁধে, অথচ তাদের নিজেদের সাইকেল নেই, সেটা আমি ভালো করে জানি। তাদের কাছেও চেয়েছিলাম সেই ছোট বাইসাইকেল চালানোর জন্য। তারা ভাড়ায় সাইকেল এনেছে বলে আমাকে চালাতে দিতে রাজি নয়। অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছি, ভাড়াতেও সাইকেল পাওয়া যায়! অনেক ভাবনার পর এক পর্যায়ে ভাড়ার সাইকেল দিয়ে বাইসাইকেল চালানো শেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের পাশের বাড়ির সমবয়সী জাকির, পাপ্পু সিরাজ রেজ্জাককে ধরে ভাড়ায় সাইকেল এনে দিতে রাজি করাই, তবে জুড়ে দেয় শর্ত। তাদের শর্ত হলো- প্রতি ঘণ্টারসাইকেল  ভাড়া তিনটাকা, তারা ভাড়ায় সাইকেল এনে দিবে কিন্তু এজন্য আমার টাকায় তাদের একঘণ্টা সাইকেল চালাতে দিতে হবে। আমি তাতেই রাজি হয়ে যাই।
যাহোক আমার বাসায় রাখা টাকা জমানোর মাটির ব্যাংক সবার অগোচরে ভেঙে টাকা নিয়ে তাদের সাথে ভাড়ায় সাইকেল নিতে যাই। রংপুর স্টেশন রোডস্থ ঘোড়াপীর মাজারের কাছে  গোলাম রসুলের সাইকেল গ্যারেজে। গোলাম রসুল দীর্ঘদিন থেকে সাইকেল ভাড়া দিয়ে আমার মতো বয়সের ছেলেদের কাছ থেকে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন, কারণ তিনি সবাইকে বিশ্বাস করে ভাড়ার বিনিময়ে সাইকেল চালাতে দেন। ছিপছিপে গড়নের লম্বা আর পান খেকো মানুষ গোলাম রসুল। দ্বৈত মেজাজের মানুষ। কারো সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলেন, কারো সঙ্গে দেখান নমনীয়তা। তিনিই রংপরে প্রথম ভাড়ায় চালিত সাইকেলের ব্যবসায়ী।

যা হোক সব শর্ত মেনে নিয়ে তিন ঘণ্টার জন্য সাইকেল আনা হলো। তাদের ভাগে যে একঘণ্টা দিতে চেয়েছিলাম সেটা তারা আগে চালিয়ে সাইকেল আমার হাতে তুলে দেয়। মহা আনন্দে সাইকেল হাতে নিয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার উপক্রম। কিন্তু প্রথমেই সাইকেলের চাকার দিকে চোখ যেতেই হতবাক! সামনের চাকা ছোট আর পিছনের চাকা সাইজে বেশ বড়, এই চাকা ছোটবড় হলে কোন্ ধরণের ক্ষতি হয় তা আমার জানা নেই। মরিচার প্রলেপে রিং দুটো অনেক মোটা আর বেশ ওজনদার মনে হয়েছে। সাইকেলের বেল তো দূরের কথা বিভিন্ন জায়গায় ওয়েল্ডিং করা হ্যান্ডেলের কানে ব্রেকের বার ও ব্রেক সু কিছুই নেই। যে কারণে ব্রেক ধরে সাইকেল থামানোর কোনো ব্যাবস্থা থাকবার কথা নয়। এবার সাইকেলের হ্যান্ডেল দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বিশাল এক মাঠের মাঝখানে নিয়ে তার উপর উঠতে চেষ্টা শুরু করি, এক সময় উপরে উঠে দু’পা মাটিতে স্পর্শ করে হাঁটতে থাকি, মাঝে মাঝে প্যাডেলে পা-দুখানা তুলে দেবার বৃথাচেষ্টা। আবার চেষ্টা- আবার চেষ্টা। এভাবে কিছুক্ষণ ব্যর্থ হবার পর আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে পাপ্পু। সাইকেলের পিছন দিকে ধরে আমাকে সাইকেল চালানো শিখতে সাহায্য করে। তার সহযোগিতা নিয়ে সিটে বসে যে বিড়ম্বনা আমাকে গ্রাস করে তা হলো- কাঠ দিয়ে তৈরি ফাটল ধরা ড্রাইভিং সিটের চিপায় আটকে চিমটি কাটতে থাকে প্যান্ট এবং… তবুও চিনচিনে ব্যথা নিয়ে প্যাডেল ঘুরাতে থাকি।
থাকি। পাপ্পু বেশ কিছুক্ষণ সাইকেল ধরে রাখার পর হাত ছেড়ে দেয়, আমি পড়ে যাবো এমন মুহূর্তে আবার ধরে রাখে, এমন ধরা ছাড়ার মধ্যে এক সময় ছেলেটি সাইকেলের পিছন থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পিছু হটে। কাঁপাকাঁপা হাত, পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চালাতে থাকি সাধের বাইসাইকেল আর নান্টু ঘটক সিনেমার সেই আলোচিত গান ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া, ঢাকা শহর দেখবো আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা, ও-হ-ও… পাবলিক ভাই সাইকেলের ব্রেক নাই’..

গানটি শেষ হতে না হতেই একদল কুকুরের আবির্ভাব হলো আমার সাইকেলের সামনে, কূল রাখি না মান রাখি অবস্থা শুরু হয়। কুকুরের গ্রুপটি দু দলে বিভক্ত হয়ে তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে আমার সাইকেলের সামনে, অবস্থার বেগতিক দেখে জোড়ে জোড়ে প্যাডেল চালানোর বৃথা চেষ্টায় এক সময় মুখ থুবড়ে মাটিতে পতিত হই সাইকেল সমেত। লজ্জা ও ভয় নিয়ে কোনোরকম উঠে গা থেকে ধূলা ঝাড়ছিলাম আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম কেউ আবার দেখে ফেলে নাকি। ধুলির সাথে সব লজ্জা আর ভয়কে ঝেড়ে আবার সাইকেলে চেপে বসে চালানো শুরু করি। 

এভাবে চালাতে চালাতে সারা মাঠ ঘুরছি আর ঘুরছি। মনে হয়-‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ গানের সাথে চলতে থাকে আমার হাওয়াই সাইকেল। অনেক্ষণ চালানোর পর সাইকেল থেকে নামব মনে করে গতি কমাতে থাকি, কিন্তু বিধিবাম! সাইকেলে তো ব্রেকই নেই! নামতে পারি না সাইকেল থেকে, কেনো নামতে পারিনা-কিভাবে নামতে হয় তা তো জানি না। সাইকেল থেকে নামার ভাবনায় আবারো হাত কাঁপতে শুরু হয়। হাত যখন কাঁপছেই কী আর করার, আবার চালাতে শুরু করি। কিন্তু নামতে যে হবে আমাকে, পিছন ফিরে দেখি আমার স্বজনরা কেউ নেই। মহাবিপদেও চালাই সাইকেল। এক সময় মাথায় হঠাৎ বুদ্ধির উদয় হয়, যেই বুদ্ধি সেই কাজ। মাঠের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে গিয়ে সাইকেলসহ গা ঘেঁষে নামতে হবে। আর সেখানেই ঘটে আর এক বিড়ম্বনা- সাথে সাথে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যাই মাটিতে, তখন আমার টাকায় ভাড়া করা বাইসাইকেলটি আমারই গায়ের উপর অবস্থান করছিল। সাইকেলের নিচে থেকেও বুঝতে পারছিলাম প্যাডেলের মাথায় পা লেগে বেশ অনেক খানি জায়গা কেটে গিয়েছে। রক্ত ঝরছে কেটে যাওয়া স্থান থেকে। আঘাতের চোটে  কিছুক্ষণ পর দেখি কোত্থেকে যেন দৌড়ে এলো বন্ধুরা, তারা সাইকেলের রাহুগ্রাস থেকে আমাকে মুক্ত করে, দুজন আমার দুহাত তাদের কাধের উপর নিয়ে গাছের ছায়ায় বসায়। ক্ষতস্থানে দুর্বাঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দেয়। সেখানে কিছুক্ষণ চিকিৎসার পর আমাদের বাসার অদূরে রেখে তারা ভাড়ার সাইকেল নিয়ে চলে যায়। আহত আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসায় যাই। পরে অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলে সে যাত্রায় বাবার কাছ থেকে রক্ষা পেলেও মা ঘটনাটি বুঝতে পেরে অনেক শাসিয়েছিল এবং সাধারণ ক্ষমা করে সাবধান করে দিয়েছিলেন। এতো কিছুর পরও মাঝে মাঝে ভাড়ার সাইকেল চালিয়ে বাইসাইকেল চালানো শিখেছিলাম আমি…

সাইকেল - সোহানুর রহমান শাহীন

মাসুম মোরশেদ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

আমার ছেলেবেলা 

ছোটবেলা মানে কী?

– সারাদিন মার্বেল খেলা।

হ্যাঁ, আমার ছেলেবেলা ছিল মার্বেলময়।

ছালেক মার্কেট থেকে কেনা লন্ড্রা ইংলিশ হাফপ্যান্ট। তার ডানে-বামে ইয়াবড় পকেট।হাঁটলে ঝুনঝুন করে মার্বেল বাজে। বেল্ট ছিল না। কালো শিঁকাই (মোটা কালো সুতা) কোমরে থাকতো। তাতে প্যান্ট আটকাতাম।দৌড়ালে দু’হাত প্যান্টের দু’পকেট ঢুকিয়ে চেপে ধরে দম বন্ধ করে দৌড়াতাম। তারপরও কখনও প্যান্ট খুলে মাটিতে পড়তো মার্বেলের ভারে। দ্রুত এদিক-সেদিক চেয়ে ফিক করে হেসে কায়দা করে সেটি তুলে আবার দৌড়।

খেলায় হাত চালু ছিল। ব্রেন ছিল সার্প। খুব কৌশলী ছিলাম। ফলে কেউ পারতো না।  সেরা ছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, হাত নয় মাথা দিয়ে খেলতে হয়।

সারাদিন খেলতাম। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু মার্বেল আর মার্বেল। মার্বেলের টোক্কা, টাকুর, ইঞ্চি, টু-টাচ, হাফবেল, পুট, গাঁড়া কতশত যে খেলা!

সারাদিন খেলি। লাভ করি প্রচুর। একটা দুটো করে সারাদিনে ত্রিশ চল্লিশ বা তারও বেশি। টাকায় দশটি মার্বেল পাওয়া যেত। বিক্রি করি তৎক্ষণাৎ। দিনে দুই-চারটাকা অনায়াসে লাভ হতো। তা দিয়ে মুড়ি, চানাচুর কিনে খেতাম। বেশি লাভ হলে পাড়ার মোড়ে গণি মিয়ার হোটেলের পরোটা। হেব্বি জমত সেদিন।

দোয়ানী বিড়ির খোলান, ডাড়ার পাড়, গাবার ছমছলের বিশালখুলিবাড়ি, নয়ার দিঘির পাড়, ময়জার খুলি পাড়ার সর্বত্র-পাড়াময় আমি আর মার্বেল। 
জাপানি, চায়নিজ, জলজলিয়া বেলজিয়াম মার্বেল। ছোট মার্বেলকে বলতাম বিচ্ছু মার্বেল। নিয়মিত ছোটদের সাথে, বড়দের সাথে খেলেছিলাম।

যেদিন সোনার চাঁদ বিড়ির কাজ বন্ধ সেদিন ধুমসে খেলা। দোয়ানীটারির অনেকেই তখন সোনার চাঁদ বিড়ির কারিগর। আমি আজিজ (ভরসা) বিড়ির কারিগর। আজিজ বিড়ির কাজ বন্ধ থাকে শুক্রবার। সেদিন পাড়া জুড়ে ছোটদের মার্বেল খেলা, মাটিতে দাগ টেনে ছক্কা খেলা কিংবা বোর্ডের সাপ-লুডুতে বাজি আর বড়দের মধ্যে যারা উঠতি বয়সের তারা তাস পিটায়।
টাকার খেলা। বাজি। জুয়া।
মধ্য বয়সীরা স্প্রেটট্রাম আর মুরুব্বীরা মেরিস টুয়েন্টি নাইন।

শুক্রবার যেন চাঁদরাত। সারাসপ্তাহ টাকা-পয়সা জমায় সবাই মার্বেল, ছক্কা, তাস খেলার জন্য।

আমরা ছোটরা সবাই প্রতিদিন স্কুলে যাই। কিন্তু পড়াশোনা করি না। নিয়মিত স্যারদের বেতের মার খাই, কানমলা খাই-খুব ভাল লাগে। বরং স্যারের মার না খেলে ভাল লাগে না। আর পড়াশোনা করে শুধু লিটন, মেহেদী, রানারা। আমি পরীক্ষার আগের রাত ভোর পর্যন্ত পড়ে পগারপাড়।

মার্বেল খেলায় আমার সমকক্ষ মাত্র একজন ছিল পাড়ায়। একসাথে পড়তামও। ফিরোজ কবির ভুট্টু। ভুট্টু নামে সবাই ডাকি। সেয়ানা প্লেয়ার! ধূর্ত!

লেখাপড়ায় সে ডাব্বা খেত। ভুট্টু ছিল বাপের একছেলে, ডানপিটে। সে ফুটবলেও চৌকষ ছিল। ফলে তার নামডাক ছিল বেশ। আমিও ফুটবল খেলতাম। গোলকিপার। তবে চলনসই।

কতশত কথা মনে পড়ছে, সেসব দিন যদি আবার ফিরে পেতাম!

আমার ছেলেবেলা - মাসুম মোরশেদ

প্রমথ রায়

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২৩ অপরাহ্ণ

আমার এলেবেলে শৈশব

আমার শৈশবের কথা বলতে গেলে প্রথমে মনে পড়ে কোনো কালবৈশাখি ঝড়ে আমি আমার মায়ের কোলে মানুষের ঘরের পিছনের চালার নিচে। আমরা অতি দরিদ্র হওয়ায় আমাদের খড়ের ঘর দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ত ও খুটি নড়বড়ে হওয়ায় যেকোনো সময় ঘর উড়ে যেতে পারে। গিয়েছিলোও দুবার। ছোটোবেলায় ঝড় আসলেই আমি খাটের নিচে লুকাতাম যাতে ঘর পড়লেও কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়। শৈশবের বৃষ্টিতে আমার অনেক স্মৃতি। এই বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে আমার সাঁতার শিখি। সাঁতার শিখতে গিয়ে পুকুরের জল গিয়ে মায়ের কাছে মাইর খাই। আমি কখনো মাছ মারতে পারতাম না। এক বৃষ্টির দিনে দুটি রুই মাছসহ অনেক মাছ পেলাম। বর্ষাকালে আমরা বন্ধুরা মিলে কলার গাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে বৃষ্টির পানিতে ভেসে বেড়াতাম। খুব ছোটোবেলায় আমাদের ছাতা ছিলো না। মানকচু বা কলার পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতাম। কখনো কখনো প্লাস্টিকের বস্তা উল্টিয়ে মাথায় দিতাম। পরে আসলো বাঁশ পাতা দিয়ে বাঁশের তৈরি ছাতা।

আমরা শৈশবে বন্ধুরা মিলে কলার পাতা দিয়ে ঘর বানাতাম। আবার কখনো কখনো মাটি দিয়ে পাকা ঘর বানাতাম আর রাজমিস্ত্রি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আবার কখনো বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করতাম কেউ হব বাসের ড্রাইভার, কেউ হেল্পার, কেউ কন্ডাক্টর।

আমাদের খুব শৈশবের খেলা ছিলো কাঠাল পাতা দিয়ে নইয়া খেলা। পরে ম্যাচের প্যাকেট দিয়ে খেলতাম। পরে মার্বেল ও পয়সা খেলা শুরু করলাম। একবার কয়েকজন মিলে একটি ফুটবল কিনলাম। পরে ঝগড়া লেগে সে বল কেটে ফেলে ফুটবল খেলার ইতি টালাম। ক্রিকেট খেলতে খেলতে যুবক হয়ে গেলাম।

আমাদের শৈশবে টিভি নাই বললেই চলে। আমাদের পাড়ায় একজন রিকন্ডিশন্ড টিভি কিনল। প্রতি শুক্রবার বিকাল ৩ টায় বিটিভিতে বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য আমরা পাড়া থেকে পাড়ায় ঘুরতাম। তখন জনপ্রিয় সিরিয়াল ছিলো, আলিবাবা চল্লিশ চোর, সিন্দাবাদ, আলিফ লায়লা, ভারতীয় জয় হনুমান। এগুলো দেখার জন্য রাতে রাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম।

শৈশবে আমার ফল চুরির করার অভিজ্ঞতা ছিলো না। আমাদের পাড়ায় এক ছেলে গরুর রাখাল হয়ে কাজ করতে এল। সে আমাদেরকে নিয়ে টিম বানাল এবং আমরা রাতে মানুষের ফলমূল চুরি করা শুরু করলাম। মানুষ ধান কেটে জমিতে শুকোতে দেয়, সেগুলো দিয়ে ভাপা পিঠা খেতাম। আমাদের এই দলটি যাত্রাগান দেখা ও ভিসিআর দেখায় ছিলাম নিয়মিত। এগুলোতে চলতো জুয়া খেলা। আমিও খেলতাম। বেশ লাভও করেছিলাম। 

খুব শৈশবে আমরা সুপারির খোলোস দিয়ে গাড়ি টানতাম। পরে বাঁশের মুড়া গোল করে চাকা বানিয়ে গাড়ি চালাতাম। এরপর ভ্যানের বিয়ারিং দিয়ে গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। আমি মানুষের সাইকেল দিয়ে একাই একাই সাইকেল চালানো শিখি। প্রথমে ফ্রকের ভিতরে পা ঢুকিয়ে,  যেটাকে বলে ‘হাফ প্যাডেল’। পরে আস্তে আস্তে সিটে চড়ে। সিটে চড়ে চালাতে গিয়ে আমি দুবার এক্সিডেন্ট করি। গিয়ারের কাটা পায়ে ঢুকে যায়।

আমার শৈশবে আমার বাবা একবার একটা রিকন্ডিশন্ড রেডিও কিনেছিল। তখনও টিভি আসেনি।  তাই রেডিওটি আমাদের পরিবারে বেশ সমীহ ছিল। একদিন এটা আমি নস্ট করে ফেললাম। এটার জন্য আমার বাবা আমাকে মারতে উদ্যোত হওয়ার আমি দিলাম দৌড়। আমার বাবাও আমার পিছু পিছু দৌড়ায়। ঐদিন দেখেছি বাবার রাগ।

আমরা পড়াশুনা করেছি কেরোসিনের ল্যাম্প দিয়ে। পরে পেয়েছি হারিকেন। আমার পড়াশোনা শুরু খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত ফিডার স্কুলে। বাঁশের টংয়ে বসে মদনমোহন তর্কালংকার রচিত গোলাপি রংয়ের ‘প্রভাতি’ বই পড়তাম। পরে পড়লাম গণ সংগঠন স্কুলে। এখানে পড়েছি মাদুরে বসে। ভালো ছাত্র হওয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দূরের একটি সংগঠন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলো। দূরে হওয়ায় এক সপ্তাহ স্কুলে গিয়ে আর গেলাম না। তারপর দুএকটি স্কুল ঘুরে চতুর্থ শ্রেণি না পড়ে ঐ বছরে বাড়ির কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এ স্কুলে আবার শিক্ষকের পাকা চুল তুলে দিতে হতো। এতগুলো ক্লাস ডিঙিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সবগুলো বিষয়ে ফেল করলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমি এতটাই বোকা ছিলাম, স্কুল পালিয়ে আসতে গিয়ে আমার বই রেখে অন্যের বই নিয়ে আসতাম। পরে বই ফেরত দিতে গিয়ে স্যারের কাছে মার খেতাম। পরীক্ষায় নকল আনতে গিয়ে স্যারের সামনে ধরা পড়তাম। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সবগুলো বিষয়ে ফেল করে দিনাজপুরে খ্রিস্টান বোর্ডিং এ পড়তে গেলাম। ওখানে আবার আমার বন্ধু তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ায় আমাকেও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করাল। বোর্ডিং এ আবার খাওয়াতো গমের ভাত, যা আমার একদম সহ্য হয় না। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে আর গেলাম না। আমার বাবা রাগ হয়ে আমার পড়াশুনা বন্ধ করতে চাইল। আমি নিজে আর এক গণসংঠন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। আমাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি। আমি সামনের দিকে এগুতে থাকলাম আর আমার শৈশবগুলো হারিয়ে কৈশোর,  যৌবন ও ত্রিশোর্ধে পৌঁছে গেছে।

আমার এলেবেলে শৈশব - প্রমথ রায়

মুগ্ধতা.কম

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

শান্ত কিন্তু দুষ্টমির শৈশব 

এক. কানে ছোলা বুট ঢুকানো:

আমাদের অনেকের জীবনের শৈশবটা দুষ্টুমিতে ভরা। আমার শৈশব কেটেছে অতি শান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে। আব্বা ছিলো অনেক রাগী। তখন আমরা দুই বোন আর আমি। তাই ভিতরে ভিতরে দুষ্ট মিষ্ট ভরা থাকলেও প্রকাশ হতো না বললেই চলে। আমার বয়স তখন তিন কিংবা চার। রমজান মাসের ইফতারে প্রতিদিন থাকত ছোলা। একদিন আমার মেজ বোন আর আমি শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোলা ঢুকানোর খেলায় মেতে ছিলাম। 

আমার বোন কানে ঢুকিয়ে বের করতে পারলেও আমি পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ছোলা কানের পানি পেয়ে বড় হওয়ায় আর বের করতে পারছিলাম না। কানে ব্যাথা-বেদনা শুরু হওয়ায় বাবা-মাকে জানাতে বাধ্য হলাম। বাবা মায়ের টেনশনে সেকি অবস্থা। কানে বেশ কিছুক্ষণ ঢুকে থাকার কারণে কানের ভিতরে ধীরে ধীরে ফুলে আরো বড় হয়ে উঠেছিলো ছোলা। ব্যথাও বাড়ছিল।  অনেক চেষ্টার পরও বের করতে পারায় হাসপাতালে নিয়ে অজ্ঞান করে ছোলা বের করেছিলো ডাক্তার। সামান্য বড় হয়ে শুনেছিলাম সেই তুলকালাম ঘটনা। আশ্চর্য বিষয় হলো আমার ছেলে এইরকমই ঘটনা ঘটালো। তবে আমার মতো ছোলা ঢুকায়নি। কানে ঢুকিয়েছিলো একটি পুথি। ভয় উৎকন্ঠা নিয়ে চিমটা দিয়ে বের করতে সক্ষম হয়েছি। ছেলে ফারিহান খুব সামান্যই ব্যাথা পেয়েছে। মহান আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন বড় দূর্ঘটনা থেকে। আলহামদুলিল্লাহ। 

দুই. হারিয়ে যাওয়ার গল্প:

এবার বলি শৈশবে আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। আমার বয়স তখন দুই কি তিন। আমরা সবে মাত্র তাজহাটের বাসায় উঠেছি। একদিন এক লোকের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে গিয়েছিলাম। তখন এলাকায় বাড়িঘর ছিলো খুবই কম। আমাকে এক মহিলা পেয়ে চিনে ফেলে এবং বাসায় পৌঁছে দেয়। আব্বা নাকি শার্ট প্যান্ট পড়ে মোটরসাইকেল বের করছিল আমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। তাতেই বোঝা যাচ্ছিল আমাকে হারানো নিয়ে বাসায় বেশ হৈচৈ হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার মেয়েও ছোট বেলায় এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল।  হয়তো পৃথিবীতে কিছু ঘটনা এভাবেই ঘুরে ফিরে আসে। আমাদের মেয়ে আসফি হারিয়ে যাওয়ার সময় বয়স ছিলো দুই/তিন বছর। তখন শাড়ি পড়া মহিলা দেখলেই তাকে মা করে ডাকত। যেমন আসফির মায়ের স্কুলের সব ম্যাডামসহ তার নানি, খালাকেও মা বলেই ডাকত। যদিও সেই মা ডাকা অতি অল্পদিন স্থায়ী ছিল।

একদিন বাসায় আসা এক শাড়ি পড়া মহিলার পিছে পিছে আসফি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। সেই মহিলা অবশ্য খেয়ালই করেনি। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর সেই মহিলাকে হারিয়ে ফেলে আসফি। একা হয়ে যাওয়ায় এক বাসার সামনে কান্না করতে থাকে। কান্না করার সময় সেই বাসার এক মহিলা সেটা খেয়াল করে, আর বুঝতে পারে এটা মিলন ভাইয়ের মেয়ে। দ্রুততার সাথে সেই বাড়ির বউ মা আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। মজার ব্যপার হচ্ছে আমি যখন ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম তখন সেই বাড়ির বউ আমাকে একই ভাবে পেয়ে আমাকে বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় সেই বউ এর ছেলের বউ।
আরও কাকতালীয় ঘটনা হলো আসফির মাও হারিয়ে গিয়েছিল ছোট বেলায়। তবে আসফির মায়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক বেদনাময়। আসফির মায়ের নামটা জানিয়ে রাখলে গল্প বলতে সুবিধা হবে। নাম সুচনা। সুচনার বয়স তখন দুই আড়াই বছর হবে। ওরা তখন নাটোর জেলায় পুলিশ কোয়ার্টারে থাকত। একদিন সুচনারা নানা ওদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। কয়েকদিন থাকার পর সকালের দিকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সবারই মন খারাপ সুচনার মা তার বাবাকে বিদায় দিয়ে সুচনার ছোট বোনকে নিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আর এদিকে সুচনা নানার পিছু নেয়। কিন্তু নানা খেয়াল করে না। একসময় কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে যায় সে। পাহারারত সিপাইও খেয়াল করে না।
একা একা এক কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে গ্রামে ঢুকে যায়। এক স্কুল ছাত্র তাকে রাস্তায় কান্না করতে দেখে জিজ্ঞেস করেও বাবা মায়ের নাম বলতে পারে না। সে সুচনাকে বাসায় নিয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়। এক মেয়ে পাওয়া গেছে এই খবর আসে পাশে ছড়িয়ে যায়।
সেই গ্রামে পুলিশের এক কনস্টেবল  দুপুরে খেতে এসেছিলেন বাসায়। তার কানেও চলে আসে খবরটা। তিনি দ্রুত যান সেই ছেলের বাসায়। থানায় হৈ চৈ উঠেছে দারোগা স্যারের মেয়ে হারিয়েছে।
তিনি সুচনাকে দেখেই চিনতে পারেন যে এটি ফজল দারোগার মেয়ে। আমার শশুরের বাবার নাম আবুল ফজল।সেই কনস্টেবল সাথে সাথে তার স্যারের মেয়েকে নিয়ে কোয়ার্টারে বুঝিয়ে দেয়। এদিকে বড় মেয়েকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে আসফির নানি অজ্ঞান প্রায়। সেই কনস্টেবল বড় মেয়ে সুচনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আরেক নতুন পৃথিবী ফিরে পেয়েছিল ওরা। আরও অতি আশ্চর্যজনক হলো আমাদের ছেলেও ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। ওদের মা ও খালার সাথে মার্কেটে শপিং করার সময় হঠাৎ খুঁজে পাচ্ছিল না ফারিহানকে। আশেপাশে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল এক লোকের কোলে। এভাবে শৈশব গুলো আনন্দ বেদনার মিশ্রিত হয়ে বেড়ে উঠি আমরা। বড় হলেই শৈশবের ঘটনাগুলো দিয়ে গল্প তৈরি হয়।

শান্ত কিন্তু দুষ্টমির শৈশব - আসহাদুজ্জামান মিলন

মুগ্ধতা.কম

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

শৈশবের স্মৃতি

আমার সোনার হরিণ চাই, আমার সোনার হরিণ চাই, হ্যাঁ সেই সোনার হরিণ আমার আনন্দের শৈশব, স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতার অনাবিল প্রশান্তির ক্ষণ ক্ষণ প্রতিটা ক্ষণের নিশ্চিন্ত মাধুর্যময় সময়। আহ্ যদি চাইলেই পেতাম, হাত বাড়ালেই ফিরে আসতো, তবে কেমন হতো, বলো তো? বলছি আমি… আসে না ফিরে, যায় যে সময় চলে তাই তো স্মৃতিতে ভরে থাকে বুক, চোখে থাকে শৈশবের কত না অভিজ্ঞতার সাধের – ভালোবাসার শৈশব।

আসলে এটাই চিরন্তন নিয়ম – সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়, সময় করে না কারো জন্য অপেক্ষা, সময় দিয়ে যায় এক এক ধাপের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের ভাণ্ডার আর আমরা এগিয়ে যাই শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রবীণ থেকে বৃদ্ধকালে। জ্ঞান সঞ্চরণে যা পেয়েছি তা থাক নিজের করে, প্রবীণের পথে আরো বেশি অগ্রসর হতে হতে একদিন বিদায়ী ঘন্টা বাজবে তার আগে সুযোগ এল শৈশবের মুঠোবন্দী স্মৃতিচারণে নিজেকে দাঁড় করানো।

আমার শৈশব বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি ছিল সবসময়ই। তা হলো সবার বাবা আছে আমার কেন বাবা নেই? হ্যাঁ আমার ছোটবেলায় বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন এই দুঃখটা শত হাসি-আনন্দ, দুষ্টুমীর মধ্যে দিয়েও আমায় একটা সময় একাকিত্বের হৃদয়ে নিশ্চুপ করে রাখত। তবে হ্যাঁ বাবা না থাকলেও আর্থিক কোনো কষ্ট ছিল না, স্বাচ্ছন্দ্যেই মা আমাদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, বাকিটা আল্লাহর দয়া।

মৃত্যু অবধারিত, চিরন্তন যাত্রাপথ….. তবে আজ প্রবীণতম মানুষের মাপকাঠিতে এসেও মনটা খুঁজে  কোথাও… সেই আপন জনদের কাছে পেলে, কাছে পেলে স্কুলের খেলার সাথী ভুলে যাই বয়স হয়েছে। পেছনে ফিরে যাই সেই সহজ-সরল, অবোধ মধুর শৈশবে। মানুষ যত বড় সফলতা বা পূর্ণতার পথ খুঁজে পাক একটা সময় সে একাকী মুহূর্তে বা নাতি-পুতিনের শৈশবকালে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গোপনে অনুভব করে যেন এক তীক্ষ্ণ হাহাকার। ভালোবাসা পেতে চায়, সেই যে বাবা- মা, পরিবারের সকলের স্নেহ মমতায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। দেবার কিচ্ছু থাকে না তখন, থাকে শুধু নেবার সমস্ত হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি।

আজ আমার বসত একদম একাকী, নিঃসঙ্গ নীরবতায় ঢেকে থাকে জীবনের আঙ্গিনা তাই আমি বারবার ফিরে যাই আমার ছোট্ট বেলায়…..ছোট্ট মেয়ে, মা- বোনদের আদরে আদরে দিন কেটে যাওয়া যদিও একটি ভাই আমার সাত বছরের ছোট কিন্তু হলে হবে কী, আমারি আহ্লাদী বেশি, প্রাপ্তিও বেশি। বাড়ির গল্প বাকি থাক। বন্ধু মহলেও কি যে পবিত্র আর নিগূঢ় ভালোবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে তা বলার অবকাশ রাখে না। জীবন বৈচিত্র্যময়তায় আর যাই হোক শৈশবের সম্পর্ক আর স্মৃতিতে কোনো নেতিবাচক জিজ্ঞাসার প্রশ্ন থাকে না, থাকে না স্বার্থপরতা আর কুটিল মনোভাব। বলি তবে ছোট্ট একটি ঘটনা – আমি ছোট্ট বেলায় পড়তাম পুলিশ লাইন প্রাইমারি স্কুলে ছেলে – মেয়ে একত্রে। টিচাররা ছিল দারুণ রাগী। আমরা দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে ছিলাম ভীষণ বন্ধু আর বাকি সকলের সঙ্গেই ছিল সুসম্পর্ক মানে দারুণ সুন্দর মেলবন্ধন। আমরা একসঙ্গে খেলতাম, এমনকি রান্নাপাটি এবাড়ি, ওবাড়ি ইট দিয়ে ভাগ করে আলাদা চিহ্ন নির্ধারণ করতাম। ক্লাশে একদিন ইতিহাস স্যার একই সঙ্গে ৫ কি ৬ পাতা পড়া মুখস্ত করতে দিয়েছিল। আমরা বারণ করলেও স্যার টেবিলে লম্বা চিকন কঞ্চি  দিয়ে একটা জোড়ে শব্দ করে – কালকেই পড়া চাই বলে চলে গেল। সাব্বির ছিল প্রথম, মমিন দ্বিতীয় আর আমি তৃতীয়, বরাবরই এমনই রেজাল্ট। কখনো কখনো মমিন আর আমার মধ্যে পাল্টাপাল্টি হতো রেজাল্ট। সাব্বির ছিল একটু প্রতিবন্ধী মানে একটি পা ছোট তাই স্বাভাবিক হাঁটাচলা ছিল না কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্কে কোনোই বাঁধা ছিল না। আমরা সকলে ওকে খুব ভালোবাসতাম, সবসময়ই প্রথম হতো। এবার পড়া কী হবে সে প্রসঙ্গ বলি – সকলে ঠিক করলাম কেউ পড়ে আসব না। পরদিন স্যার এলেন, পেছন থেকে পড়া ধরছেন, যেই হৃদয় স্যার পড়া হয় নি বলতেই ওকে বেঞ্চে হাঁটু ভাজ করে ( লিনডাউন যেটাকে বলে৷ ) দাঁড়াতে বলে চেয়ারে বসে বললেন পড়া যাদের হয়েছে তারা বসে থাকো বাকি সকলে বেঞ্চে লিনডাউন হও। আমরা সকলে তাই হলাম। স্যার উঠলেন এখনও শিউরে ওঠে শরীর। পেছন থেকে শুরু করলেন মারা। হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি এক এক করে সকলকে সেই চিকন কঞ্চি দিয়ে হাতের তালায় মারা শুরু করলেন। সত্যি বলতে কি এই মার আমি কখনো পাইনি। ছেলেদের প্রথম বেঞ্চ বাকি। মেয়েদের প্রথম বেঞ্চে এলো, আমি কিনারে অন্যপাশ থেকে মারতে মারতে আমার কাছে এলো, সাব্বির, মমিন অন্যরা সকলে তাকিয়ে আছে। আমি হাত বের করলাম কঞ্চির পাঁচটা মার খেলাম জীবনের প্রথম। সকলের হাতে লাল দাগ হয়ে গেছে, চোখে পানি। আমার পাশেই একটু ফাঁক দিয়ে ছেলেদের লাইন শুরু। সবশেষে এলো সাব্বির, সেই বন্ধুটি বেঞ্চের উপরে ওভাবে থাকতেই পারছিল না, খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওকে ২ টা মেরেছে তিনবারের পর সাব্বির পড়ে যায়। আমি জবা ছুটে যাই অন্যান্য ছেলেরা ওকে ধরে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। আমরা খুব হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দেই, স্যার চলে যান। স্যারদের রুমে ঢুকে আমি হেড স্যারকে বলে পানির গ্লাস আর জগ আনি, মমিন পানি খাইয়ে দেয় সাব্বিরকে অতঃপর আমরা সকলে পানি খাই আর দারুণ হৈচৈ শুরু হয় ক্লাসে। হেড স্যার হৈচৈ শুনে ক্লাসে আসেন। সাব্বিরকে দেখেন আর সবকথা শোনেন। শেষ ক্লাসের ছুটি হলে আমরা সকলে হেড স্যারের রুমে যাই আবারো। স্যার আমাদের দেখে বললেন – তোমরা যাও আমি ব্যাপারটা দেখব। মমিন সাব্বিরকে নিয়ে যায় রিক্সায়, আমরাও চলে যাই বাসায়। পরদিন স্কুল যেতে পারি নি, জ্বর এসেছিল। আগের সময় পুলিশ লাইন স্কুল ছিল দারুণ কড়াকড়ি। তারপর থেকে আর ঐ স্যারকে দেখি নি। ঘটনাটি দুঃখের ছিল কিন্তু আমরাও ঐ চতুর্থ শ্রেণি থেকে সেদিন শিখেছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।

এমনি অনেক ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা জড়ানো হাসি আনন্দে ভরা ছিল ভালোলাগার শৈশব। জানি না সেই বন্ধুরা / সহপাঠীরা আজ কোথায় কেমন আছে, কী করছে…….।

আরও কত স্মৃতি….. কিন্তু সকলের লেখার সুযোগ রাখতে হবে তাই এতটুকুতেই থাক স্মৃতি কথা। আজ চোখে পানি আসে সেদিনের কথা মনে করে যে, মা – বাবারা কত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দিন পাড় করে থাকে সন্তানদের নিয়ে, নিজেরা কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে।

আজ আমরা প্রবীণ, চারদিকে শুধু কৃত্রিমতা, জীবন কী তা হারে হারে বুঝতে পারছি বলে দুঃশ্চিন্তাহীন-আদর-সোহাগে ভরা শৈশব সামনে এসে দাঁড়ায়। শৈশব তুমি জীবন পাতায় এক স্বর্ণখণ্ড। যা জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে সারাজীবন।

শৈশবের স্মৃতি - হেলেন আরা সিডনী

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

রাধাবল্লভ পাঠশালা

নানাবাড়ি থেকে রাজুর পাঠশালার দূরুত্ব পাঁচ মিনিটের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের বাম বরাবর কিছুদূর গিয়ে ডানে মোচড় নিলেই মোড়, সেই মোড়ে রমজান মামার দোকান। সেখানে বিক্রি হয় বিস্কুট, চকলেটসহ গৃহস্থালি জিনিস। তারপর বামের রাস্তার মোড়ে রাধাবল্লভ পাঠশালা। সকাল হলেই এক ঝক্কিঝামেলা। কিছুতেই স্কুলে যাবে না রাজু। অথচ এমন না যে স্কুলে খুব চাপ, স্যারেরা পড়ো রে বলেই ডুব দেয়। কে কী পড়ল সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নাই। তারপরও স্কুল যেতে হবে শুনলেই জ্বর, মাথাব্যথা।

অন্য দিগন্ত পড়া না পারলেও স্কুলকে না নেই। ঠিক নয়টায় হাজির রাজুর নানাবাড়িতে। দিগন্ত আসার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না রাজুর। নানি এসে বলে, ওঠ সোনা, দিগন্ত সেই কখন থেকে বসে আছে, যা পাঠশালায় যা, তোর নানা তোকে চারআনা পয়সা দিবে। পয়সার লোভেই হোক আর দিগন্তের সঙ্গ পাবার আশায়ই হোক রাজু স্কুলে রওনা দেয়। হাফ বিল্ডিং এর এই পাঠশালা শুরু হয় হেডস্যারের হাতের ঘন্টির শব্দে। পড়াশোনা বলতে একটু নামতা পড়া আর টিফিনে চালতা খাওয়া। হজমি খেয়ে পানি খেতে ভালো লাগত বলেই স্কুলকে একদম না বলা হয়নি রাজুর। স্কুলের সামনে রাজবাড়ি। সবাই বলত যাদু মিয়ার বাড়ি। তো সে কোন যাদু তা তো আর জানত না, জানার চেষ্টাও করেনি কখনও তারপরও বাড়িটা টানত তাকে। দিগন্তকে সাথে নিয়ে সুযোগ পেলেই রাজবাড়ির গেটে। বড় লোহার দরজা, সবসময়ই বন্ধ। সেখানে লোকজন থাকত কিন্তু কারা থাকত তা কখনই চোখে পড়েনি,আসলেই চোখে পড়েনি। এই যে কেউ বা কারা সেখানে বাস করে কিন্তু তাদের ঠিক দেখা যায় না, এটাই এক রহস্য মনে হতো। স্কুলের গেটে বিক্রি হতো কাঁচা খেজুর। সেসসবও যে পয়সা দিয়ে কিনে খাওয়া হতো একসময়, এখনকার ছেলেদের বললে বিশ্বাসই করবে না। এখন বার্গার, হটডগের স্বাদ পাওয়া শিশুদের হজমি, কাঁচা খেজুর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক।
আজ টিকা দিতে স্কুলে আসবে সরকারি লোকজন । আগে থেকে বলেনি স্যারেরা, বললে শতকরা  পঞ্চাশজন অনুপস্থিত থাকবে, এটা নিশ্চিত। প্রথম ক্লাস শেষ হয়ে দিগন্ত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে বাথরুম করার জন্য। প্রতিটি ক্লাস শেষে দিগন্তের বাথরুমের কথা বলে বাইরে যাওয়া রুটিন। ঠিক তখনি হেডস্যার সাথে স্কুলের অন্য শিক্ষকরা দুম করে ক্লাসরুমে উপস্থিত। জানলার গ্রিল ছিল না, দিগন্ত চট করে জানলা টপকে চলে যাবে বলে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল তখনি দপ্তরি নিখিল দা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। পালানোর পথ বন্ধ। বিড়বিড় করে কী যেন বলে লাইনে দাঁড়ায় সে ইশারায় কাছে ডাকে রাজুকেও। চিৎকার করে কান্না করার ইচ্ছেটা ঢোক গিলে দমন করে রাজু। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে লিসা তার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড়বড় করে, যদিও সে ভয় পেয়েছে বোঝা যায় তারপরও একদম ভেঙে পরেনি বোঝাই যায়। দিগন্ত ফিসফিস করে বলে আজ না আসলেই ভালো হতো, কেন যে আসলাম আর তোকেও নিয়ে আসলাম। ভয় পাস না। একটা পিঁপড়া কামড়ের মতো মনে হবে। এসব আমি জানি। চল আগা। তবুও টিকার সূঁচটার দিকে ঘুরেফিরে চোখ চলে যাচ্ছে।
ঠিকাদারের সামনে যখন সে দাঁড়িয়ে তখন রীতিমতো কাঁপছে রাজু।
তার কাঁপন দেখে হরেন স্যার বললো, আরে গাধা কাঁপিস ক্যান? তোকে পিঁপড়া কখনও কামড়ায় নাই? লিসার টিকা দেওয়া শেষ, সে তাকিয়ে আছে। শত  চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকিয়ে রাখা গেল না। ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো রাজু। টিকা শেষেও কান্না চলল যতটা না ব্যাথার কারণে তারচেয়েও বেশি লিসার সামনে কেঁদে ফেলার কারণে। বাড়ি ফেরার সারাটা পথ জুড়ে রাজু একটা কথাও বলল না। দিগন্ত লাল আইসক্রিম সাধল হজমি দিয়ে খাওয়ার জন্য, তাও খেল না সে। লিসার সাথে আগামীকাল কেমন করে এ মুখ দেখাবে সে চিন্তাতেই তার মন আরও খারাপ হতে শুরু করল।
লিসা থাকে রংপুর রেডিও সেন্টার স্টাফ কলোনিতে। বাম গালে টোল পড়া লিসার পাশে বসার জন্য ক্লাসের ছেলেদের প্রতিযোগিতা চলে।
দুপুরে রাজুর জ্বর এল শরীর কাঁপিয়ে।  নানি পাউরুটি আর দুধ নিয়ে সাধাসাধি করল বহুক্ষণ কিন্তু একদম খিদে নাই রাজুর। নানি বলত জ্বর আসলে বাঙালিকে খেতে হয় রুটি আর বিহারিদের  ভাত। দিগন্ত বিকালে এসেছিল, বলল মন খারাপ করিস না। কেঁদে ফেলেছিস তো কী হইছে। চল, জিনিস আনছি বলে চোখ টিপে দিলো। ম্যাজিশিয়ানের মতো পকেট থেকে বের করে দেখালো স্টার সিগারেট।
নাহ্ যাব না আজ বাইরে বলেও  কোনও জোরাজুরিই কাজে লাগল না। দিগন্ত প্রায় টেনে নিয়ে গেল বাইরে। নানাবাড়ির পূর্বদিকে লরেন্স ভাইদের বাসা। এখনও কমপ্লিট হয়নি। সেখানে বিকালে কেউ থাকে না, সেইসময় দিগন্ত সেখানে গিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে আসে। ইটের উপর বসে দুজনে সিগারেটে টান দেয়। একটু পরই দমকা কাশি আসে রাজুর, চোখে পানি চলে আসে কাশতে-কাশতে। দিগন্ত হাসতে থাকে রাজুর অবস্থা দেখে। নিয়মিত হওয়ার কারণে একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে ওর মাঝে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রুনু পিসি হারমোনিয়ামে গলা সাধতে বসেছে। দিগন্তের দিদিমা নিশ্চয়ই এ সময় জ্বালিয়েছে ধূপ। দুজনে বাড়ির দিকে রওনা দেয়, আগামীকাল স্কুলে যেতে হবে। লিসা কী আগামীকাল পাঠশালায় আসবে?

রাধাবল্লভ পাঠশালা

রবীন জাকারিয়া

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২১ অপরাহ্ণ

বট গাছের ভূত

আমার বাড়ির চারদিকে মোট ছয়টি স্কুল৷ গাদাগাদি৷ ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ২টি উচ্চ বিদ্যালয়৷ উচ্চ বিদ্যালয় দুটির একটি বয়েজ অন্যটি গার্লস৷ আমার বোধগম্য হয় না যে সরকারের নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার নিয়ম থাকার পরেও এমন গাদাগাদি ছয়টি স্কুল কীভাবে অনুমোদন পেয়েছিল৷ এদেশে সবই সম্ভব৷ 

আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত মুনসীপাড়া কেরামতিয়া প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ উপমহাদেশের নামকরা ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিক ও পীর সাহেব মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ভারত থেকে এদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে৷ তিনি মুনসীপাড়ায় বিয়ে করেন এবং শশুর বাড়িতেই আমৃত্যু অবস্থান করেন৷ মুনসীপাড়া কেরামতিয়া জামে মসজিদ -যেখানে পীর সাহেবের সস্ত্রীক মাজার আছে-সেই কর্তৃপক্ষের অবদানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে এটি শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষা কেন্দ্র দিয়ে৷ পরবর্তীতে এটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়৷ তাই তাঁর নামানুসারে স্কুলটির নামকরন করা হয় কেরামতিয়া ৷ আর মসজিদ থেকে স্কুল পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ হয় মাদরাসা রোড৷ শুধু তাই নয় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে আবাসন ছিল৷ পরবর্তীতে সেখানেই নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হয় মুনসীপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ স্কুল দু’টি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন৷ কেরামতিয়া স্কুল সেসময় রংপুরের অন্যতম ভালো স্কুলের একটি ছিল৷ উপড়ে টিনের দোচালা পাকা লম্বা কাঠামো৷ প্রতি ক্ল্যাশের জন্য আলাদা আলাদা বড় বড় কক্ষ৷ একাডেমিক ভবন, ল্যাবরেটরি আর প্রধান শিক্ষকের বিল্ডিংটা ছিল ছাদ পেটানো৷ সামনে বিশাল মাঠ৷ চারিদিকে প্রাচীন ফলের গাছ৷ আম৷ জাম৷ লিচু৷ কাঁঠাল৷ কত কি৷ মাঠের দুদিকে দুটি অতি পুরাতন গাছ ছিল৷ একটি পাইকর গাছ কিন্ত সকলে বট গাছ বলত৷ অন্যটি ছিল লম্বা কদম গাছ৷ কদম গাছ এত বড় আর ডালপালা ছড়ায় তা কখনো দেখিনি৷ এ গাছ দুটিকে সকলে ভূতুরে বলত৷ এখানে নাকি ভূত আছে৷ গাছের কোঠরে বিষধর সাপের আবাসস্থল৷ 

কদম গাছটির ঠিক নিচে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক মৌলভী খেরাজ আলী অত্র এলাকার মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরি”৷ সে সময় এই লাইব্রেরি সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে৷ বিখ্যাত সব লোকেদের আনাগোনা আর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ এখানে বই পড়তে আসতেন রংপুর মুনসীপাড়ার পুত্রবধু, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নেতা শহিদ জননী জাহানারা ইমাম৷

স্কুলের কোনো প্রাচীর নেই৷ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তা৷ পুরো স্কুরের চারিদিকে প্রশস্ত ড্রেন যেন প্রাচীরের গুরুত্ব কমিয়েছে৷

কেরামতিয়া স্কুলের মাঠ রংপুরের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক ও খেলাধুলার কেন্দ্রবিন্দু সর্বদা৷ সব সময় মাঠে মানুষের আনাগোনা৷ কেউ খেলছে৷ কেউ নিজের গামছা পেতে রেডিওতে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিংবা কোন পথিক গাছের নিচে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷ নব উদ্যম তৈরির আশায়৷ প্রচণ্ড গরমকালে রাতের বেলাতেও নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা মাঠে হাঁটাহাঁটি করে৷

আমরা সব বন্ধু রাতের খাওয়া শেষে মাঠের এককোণে আড্ডা দেই৷ ধুমপান করি৷ কলেজে কোন মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ চলছে৷ কিংবা কাকে ভালো লাগে এইসব৷ চলে রাত ১২-১টা পর্যন্ত৷ স্কুলের নাইট গার্ডের নাম আবুল৷ সে সকলের কাছে পরিচিত আবুল ভাই নামে৷ ভীতু প্রকৃতির মানুষ৷ সহজ-সরল৷ আমরা আড্ডা মারলে সে খুশি হয়৷ গল্প করে৷ তার বেশির ভাগ গল্পই চাপা৷ ভূত-প্রেতের৷ সে বলতে থাকে এই বট গাছে প্রেতাত্মা থাকে৷ তাকে বহুদিন দেখা দিয়েছে৷ কথা বলেছে৷ সে যেন কখনো তার কথার অবাধ্য না হয়৷  কথামতো চললে তাকে সোনার ড্যাগ (হাঁড়ি) দেবে৷ গাছের গোড়ায় শাবল দিয়ে দুই চাপ মাটি তুললেই সে সোনা পাবে৷ আর বেয়াদবি করলে ঘাড় মটকাবে৷ আমি বললাম সোনাগুলো নিচ্ছ না কেন? সে বলল না! লোভ করা যাবে না৷ ও একদিন নিজে থেকেই দেবে৷ সেই আশাতে আছি৷ গাঁজাখুড়ি কাহিনি৷ কিন্ত মুখে বলি না৷ কী দরকার? বরং খুশি রাখলে ওকে দিয়ে সিগারেট আনার কাজটা করানো যায়৷ সেটাই ভাল৷ Win-win conditoin.

পাড়ায় আমাদের Immidiat senior ব্যাচটা খুব ভয়ংকর৷ গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি, নেশা করা, মাস্তানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যে করে না৷ এদের জন্য প্রায় সময় পাড়ায়-পাড়ায় মারামারি লেগে থাকত৷ বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ রেইড করত৷ অগত্যা আমাদেরকেও শহর ছেড়ে পালাতে হতো৷ বিশ্রী৷ কিন্ত কিছু বলা যাবে না৷ ওদের ব্যাচের একটা ভাই ছিল৷ নাম শরিফুল৷ কোরআনে হাফেজ৷ পাড়ার ছোট একটা মসজিদে ইমামতি করায়৷ সময় পেলে শরিফুল ভাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যাংটাকালের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে এটাই নিয়ম৷ কিন্ত ওর বন্ধুরা এতই খারাপ যে কোল্ড ড্রিংকসের নাম করে সুকৌশলে তাকে মদ খাওয়ায় দিত৷ তারপর ওকে একা ছেড়ে দিত৷ মদ খেলে মানুষ গালিগালাজ করে৷ বেশি কথা বলে৷ কিংবা বাড়িতে চলে যায়৷ কিন্ত শরিফুল ভাই মদ খেলে স্কুলে ছাদে কিংবা গাছের ডালে অথবা সারারাত ধরে ড্রেনে পানি ছেঁকত৷ 
প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম মাঠে৷ আবুল ভাই বানানো গল্প বলে যাচ্ছে৷ শুনছি৷ একটা সময় সবাই বাড়ি চলে গেল৷ শুধু আমি, আমার বন্ধু রবু আর আবুল ভাই রয়ে গেলাম৷ বিদ্যুৎ চলে গেছে৷ প্রচণ্ড গরমে ঘুম আসবে না বলে থেকে গেলাম৷ বিদ্যুৎ নেই৷ দোকান পাট বন্ধ৷ অমাবশ্যা কিংবা পূর্ণিমার হিসেব করা হয়নি কখনো৷ কিন্ত আজ খুব অন্ধকার৷ কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কোথাও কেউ নেই নেই৷ কখনো ভূত-প্রেত বিশ্বাস করিনি৷ তাই আবুল ভাইয়ের গল্পকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি৷ কিন্ত এখন ভয় করছে৷ কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়৷ আসলে হবে যেখানে অন্ধকার হয় সেখানে ভূতের ভয়৷ আমি নিশ্চিত মুখে যতই বলি না কেন৷ কোনো বাঁশবাগানে, অশ্বত্থ গাছ, পুরোনো বট গাছের নিচে নিকষ অন্ধকারে ভূতের ভয় পাবে না এমন লোক নেই৷ 
আবুল ভাইকে গল্প থামাতে বললাম রাগী গলায়৷ দূরে বটগাছটার নিচে যে ড্রেন আছে, সেখানে হালকা আলো প্রতিফলন হচ্ছে৷ সবকিছু আবছা আবছা৷ আমরা তিনজন চুপ! তাকিয়ে আছি বট গাছের দিকে৷ দেখলাম ড্রেনের পানি থেকে কী যেন একটা উঠে এল৷ বটগাছটার নিচে দাঁড়াল৷ প্রায় অদৃশ্য মূর্তিটার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু উপরের দিকে সাদাটে আভা৷ সেখান থেকে মাঝে মাঝে তারার মতো আলো চমকাচ্ছে৷ মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে৷ হার্ট বিট বেড়ে গেছে৷ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ অশরীরিটা হঠাৎ জড়ানো কন্ঠে হাঁক দিলো, “আবুল তোরা এদিকে আয়”৷ ভয়ে নিজেদের মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম৷ আর রক্ষে নেই৷ আবার আদেশ করা হলো, “কি রে এখনো আসলি না যে?”
আবুল ভাই ধপাস করে পড়ে গেল৷ কাঁপতে লাগল৷ মুখে ফ্যানা৷ ওরতো মৃগীরোগ আছে বলে জানতাম না৷ ও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ লুঙ্গি স্থানচ্যুত৷ ছিঃ নোংরা৷ শরীরটাও ভালো ভাবে পরিষ্কার করে না৷ মায়া লাগছে৷ ভয় লাগছে৷ হঠাৎ মনে হলো এ অবস্থায় মৃগীরোগিকে চামড়া পোড়া বা চামড়ার স্যান্ডেল নাকে শুঁকাতে হয়৷ সবার পায়ে স্পঞ্জ৷ চামড়া নেই৷ স্পঞ্জের স্যান্ডেলই নাকে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ পর ও ঠিক হলো৷ বললো তোরা যা৷ দেখা কর৷ বেয়াদবি করিস না৷ ঘাড় মটকাবে৷ আর শোন সাথে লোহা কিংবা দেশলাই রাখ৷ ক্ষতি করতে পারবে না৷ বললাম আমাদের ও দুটোর কোনোটাই নেই৷ তাহলে কী হবে? সে তার গোছা থেকে দুটি চাবি খুলে দুজনের হাতে দিয়ে বললো আল্লাহ্ ভরসা৷

শক্তহাতে চাবি হাতে আধমরা ভয়ে দুজন হাঁটতে থাকলাম অশরীরির দিকে৷ চাবি নিয়ে কেন জানি একটু সাহস পেলাম৷ কিন্ত রবু ভয়ে কাঁপতে থাকায় চাবিটা হারিয়ে ফেলল৷ কাছাকাছি প্রায় এসেছি৷ এমন সময় বন্ধু রবু চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল৷ কাটা কলাগাছের মতো৷ যেন ধুপ করে পড়ে চুপ৷ লুঙ্গিতে পেচ্ছাব করে দিয়েছে৷ আকারে ছোট্ট বন্ধুটি দিগম্বর হয়ে যেভাবে পড়ে আছে, যেন ছোট খোকা এইমাত্র বিছানায় হিসু করে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওর বুকটা নাড়লাম৷ কোনো শব্দ নেই৷ ভয়েই শেষে মরে গেল কি না? আচ্ছা রবুর ঘাড়টা মটকালো না-তো? বুক ঢিপ ঢিপ করছে৷ আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকলাম৷ বুকে ফুঁ দিলাম৷  যতটা দূরত্ব রেখে অশরীরির কাছাকাছি যাওয়া যায়৷ অশরীরি বলল, “এত রাতে তোরা এখানে কেন?” কী উত্তর দেব ভাবতেই মাথায় বিদ্যূত খেলে গেল৷ আরেকটু কাছে গেলাম৷ আবছা আলোয় দেখতে পেলাম সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি খুলে মাথায় বেঁধে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন৷ তার মাথায় বাঁধা পাঞ্জাবির বোতামে হালকা আলোর রিফ্লেকশন তারার মতো জ্বলছে৷ সাহস করে আরো একটু কাছে গিয়ে দেখলাম অশরীরি আর কেউ নয় আমাদের মাতাল শরিফুল ভাই৷

বট গাছের ভূত