শৈশবের স্মৃতি
আমার সোনার হরিণ চাই, আমার সোনার হরিণ চাই, হ্যাঁ সেই সোনার হরিণ আমার আনন্দের শৈশব, স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতার অনাবিল প্রশান্তির ক্ষণ ক্ষণ প্রতিটা ক্ষণের নিশ্চিন্ত মাধুর্যময় সময়। আহ্ যদি চাইলেই পেতাম, হাত বাড়ালেই ফিরে আসতো, তবে কেমন হতো, বলো তো? বলছি আমি… আসে না ফিরে, যায় যে সময় চলে তাই তো স্মৃতিতে ভরে থাকে বুক, চোখে থাকে শৈশবের কত না অভিজ্ঞতার সাধের – ভালোবাসার শৈশব।
আসলে এটাই চিরন্তন নিয়ম – সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়, সময় করে না কারো জন্য অপেক্ষা, সময় দিয়ে যায় এক এক ধাপের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের ভাণ্ডার আর আমরা এগিয়ে যাই শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রবীণ থেকে বৃদ্ধকালে। জ্ঞান সঞ্চরণে যা পেয়েছি তা থাক নিজের করে, প্রবীণের পথে আরো বেশি অগ্রসর হতে হতে একদিন বিদায়ী ঘন্টা বাজবে তার আগে সুযোগ এল শৈশবের মুঠোবন্দী স্মৃতিচারণে নিজেকে দাঁড় করানো।
আমার শৈশব বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি ছিল সবসময়ই। তা হলো সবার বাবা আছে আমার কেন বাবা নেই? হ্যাঁ আমার ছোটবেলায় বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন এই দুঃখটা শত হাসি-আনন্দ, দুষ্টুমীর মধ্যে দিয়েও আমায় একটা সময় একাকিত্বের হৃদয়ে নিশ্চুপ করে রাখত। তবে হ্যাঁ বাবা না থাকলেও আর্থিক কোনো কষ্ট ছিল না, স্বাচ্ছন্দ্যেই মা আমাদের মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, বাকিটা আল্লাহর দয়া।
মৃত্যু অবধারিত, চিরন্তন যাত্রাপথ….. তবে আজ প্রবীণতম মানুষের মাপকাঠিতে এসেও মনটা খুঁজে কোথাও… সেই আপন জনদের কাছে পেলে, কাছে পেলে স্কুলের খেলার সাথী ভুলে যাই বয়স হয়েছে। পেছনে ফিরে যাই সেই সহজ-সরল, অবোধ মধুর শৈশবে। মানুষ যত বড় সফলতা বা পূর্ণতার পথ খুঁজে পাক একটা সময় সে একাকী মুহূর্তে বা নাতি-পুতিনের শৈশবকালে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গোপনে অনুভব করে যেন এক তীক্ষ্ণ হাহাকার। ভালোবাসা পেতে চায়, সেই যে বাবা- মা, পরিবারের সকলের স্নেহ মমতায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায়। দেবার কিচ্ছু থাকে না তখন, থাকে শুধু নেবার সমস্ত হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি।
আজ আমার বসত একদম একাকী, নিঃসঙ্গ নীরবতায় ঢেকে থাকে জীবনের আঙ্গিনা তাই আমি বারবার ফিরে যাই আমার ছোট্ট বেলায়…..ছোট্ট মেয়ে, মা- বোনদের আদরে আদরে দিন কেটে যাওয়া যদিও একটি ভাই আমার সাত বছরের ছোট কিন্তু হলে হবে কী, আমারি আহ্লাদী বেশি, প্রাপ্তিও বেশি। বাড়ির গল্প বাকি থাক। বন্ধু মহলেও কি যে পবিত্র আর নিগূঢ় ভালোবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে তা বলার অবকাশ রাখে না। জীবন বৈচিত্র্যময়তায় আর যাই হোক শৈশবের সম্পর্ক আর স্মৃতিতে কোনো নেতিবাচক জিজ্ঞাসার প্রশ্ন থাকে না, থাকে না স্বার্থপরতা আর কুটিল মনোভাব। বলি তবে ছোট্ট একটি ঘটনা – আমি ছোট্ট বেলায় পড়তাম পুলিশ লাইন প্রাইমারি স্কুলে ছেলে – মেয়ে একত্রে। টিচাররা ছিল দারুণ রাগী। আমরা দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে ছিলাম ভীষণ বন্ধু আর বাকি সকলের সঙ্গেই ছিল সুসম্পর্ক মানে দারুণ সুন্দর মেলবন্ধন। আমরা একসঙ্গে খেলতাম, এমনকি রান্নাপাটি এবাড়ি, ওবাড়ি ইট দিয়ে ভাগ করে আলাদা চিহ্ন নির্ধারণ করতাম। ক্লাশে একদিন ইতিহাস স্যার একই সঙ্গে ৫ কি ৬ পাতা পড়া মুখস্ত করতে দিয়েছিল। আমরা বারণ করলেও স্যার টেবিলে লম্বা চিকন কঞ্চি দিয়ে একটা জোড়ে শব্দ করে – কালকেই পড়া চাই বলে চলে গেল। সাব্বির ছিল প্রথম, মমিন দ্বিতীয় আর আমি তৃতীয়, বরাবরই এমনই রেজাল্ট। কখনো কখনো মমিন আর আমার মধ্যে পাল্টাপাল্টি হতো রেজাল্ট। সাব্বির ছিল একটু প্রতিবন্ধী মানে একটি পা ছোট তাই স্বাভাবিক হাঁটাচলা ছিল না কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্কে কোনোই বাঁধা ছিল না। আমরা সকলে ওকে খুব ভালোবাসতাম, সবসময়ই প্রথম হতো। এবার পড়া কী হবে সে প্রসঙ্গ বলি – সকলে ঠিক করলাম কেউ পড়ে আসব না। পরদিন স্যার এলেন, পেছন থেকে পড়া ধরছেন, যেই হৃদয় স্যার পড়া হয় নি বলতেই ওকে বেঞ্চে হাঁটু ভাজ করে ( লিনডাউন যেটাকে বলে৷ ) দাঁড়াতে বলে চেয়ারে বসে বললেন পড়া যাদের হয়েছে তারা বসে থাকো বাকি সকলে বেঞ্চে লিনডাউন হও। আমরা সকলে তাই হলাম। স্যার উঠলেন এখনও শিউরে ওঠে শরীর। পেছন থেকে শুরু করলেন মারা। হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি এক এক করে সকলকে সেই চিকন কঞ্চি দিয়ে হাতের তালায় মারা শুরু করলেন। সত্যি বলতে কি এই মার আমি কখনো পাইনি। ছেলেদের প্রথম বেঞ্চ বাকি। মেয়েদের প্রথম বেঞ্চে এলো, আমি কিনারে অন্যপাশ থেকে মারতে মারতে আমার কাছে এলো, সাব্বির, মমিন অন্যরা সকলে তাকিয়ে আছে। আমি হাত বের করলাম কঞ্চির পাঁচটা মার খেলাম জীবনের প্রথম। সকলের হাতে লাল দাগ হয়ে গেছে, চোখে পানি। আমার পাশেই একটু ফাঁক দিয়ে ছেলেদের লাইন শুরু। সবশেষে এলো সাব্বির, সেই বন্ধুটি বেঞ্চের উপরে ওভাবে থাকতেই পারছিল না, খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওকে ২ টা মেরেছে তিনবারের পর সাব্বির পড়ে যায়। আমি জবা ছুটে যাই অন্যান্য ছেলেরা ওকে ধরে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। আমরা খুব হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দেই, স্যার চলে যান। স্যারদের রুমে ঢুকে আমি হেড স্যারকে বলে পানির গ্লাস আর জগ আনি, মমিন পানি খাইয়ে দেয় সাব্বিরকে অতঃপর আমরা সকলে পানি খাই আর দারুণ হৈচৈ শুরু হয় ক্লাসে। হেড স্যার হৈচৈ শুনে ক্লাসে আসেন। সাব্বিরকে দেখেন আর সবকথা শোনেন। শেষ ক্লাসের ছুটি হলে আমরা সকলে হেড স্যারের রুমে যাই আবারো। স্যার আমাদের দেখে বললেন – তোমরা যাও আমি ব্যাপারটা দেখব। মমিন সাব্বিরকে নিয়ে যায় রিক্সায়, আমরাও চলে যাই বাসায়। পরদিন স্কুল যেতে পারি নি, জ্বর এসেছিল। আগের সময় পুলিশ লাইন স্কুল ছিল দারুণ কড়াকড়ি। তারপর থেকে আর ঐ স্যারকে দেখি নি। ঘটনাটি দুঃখের ছিল কিন্তু আমরাও ঐ চতুর্থ শ্রেণি থেকে সেদিন শিখেছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।
এমনি অনেক ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা জড়ানো হাসি আনন্দে ভরা ছিল ভালোলাগার শৈশব। জানি না সেই বন্ধুরা / সহপাঠীরা আজ কোথায় কেমন আছে, কী করছে…….।
আরও কত স্মৃতি….. কিন্তু সকলের লেখার সুযোগ রাখতে হবে তাই এতটুকুতেই থাক স্মৃতি কথা। আজ চোখে পানি আসে সেদিনের কথা মনে করে যে, মা – বাবারা কত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দিন পাড় করে থাকে সন্তানদের নিয়ে, নিজেরা কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে।
আজ আমরা প্রবীণ, চারদিকে শুধু কৃত্রিমতা, জীবন কী তা হারে হারে বুঝতে পারছি বলে দুঃশ্চিন্তাহীন-আদর-সোহাগে ভরা শৈশব সামনে এসে দাঁড়ায়। শৈশব তুমি জীবন পাতায় এক স্বর্ণখণ্ড। যা জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে সারাজীবন।