গল্প

গল্প

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

রাধাবল্লভ পাঠশালা

নানাবাড়ি থেকে রাজুর পাঠশালার দূরুত্ব পাঁচ মিনিটের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের বাম বরাবর কিছুদূর গিয়ে ডানে মোচড় নিলেই মোড়, সেই মোড়ে রমজান মামার দোকান। সেখানে বিক্রি হয় বিস্কুট, চকলেটসহ গৃহস্থালি জিনিস। তারপর বামের রাস্তার মোড়ে রাধাবল্লভ পাঠশালা। সকাল হলেই এক ঝক্কিঝামেলা। কিছুতেই স্কুলে যাবে না রাজু। অথচ এমন না যে স্কুলে খুব চাপ, স্যারেরা পড়ো রে বলেই ডুব দেয়। কে কী পড়ল সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নাই। তারপরও স্কুল যেতে হবে শুনলেই জ্বর, মাথাব্যথা।

অন্য দিগন্ত পড়া না পারলেও স্কুলকে না নেই। ঠিক নয়টায় হাজির রাজুর নানাবাড়িতে। দিগন্ত আসার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না রাজুর। নানি এসে বলে, ওঠ সোনা, দিগন্ত সেই কখন থেকে বসে আছে, যা পাঠশালায় যা, তোর নানা তোকে চারআনা পয়সা দিবে। পয়সার লোভেই হোক আর দিগন্তের সঙ্গ পাবার আশায়ই হোক রাজু স্কুলে রওনা দেয়। হাফ বিল্ডিং এর এই পাঠশালা শুরু হয় হেডস্যারের হাতের ঘন্টির শব্দে। পড়াশোনা বলতে একটু নামতা পড়া আর টিফিনে চালতা খাওয়া। হজমি খেয়ে পানি খেতে ভালো লাগত বলেই স্কুলকে একদম না বলা হয়নি রাজুর। স্কুলের সামনে রাজবাড়ি। সবাই বলত যাদু মিয়ার বাড়ি। তো সে কোন যাদু তা তো আর জানত না, জানার চেষ্টাও করেনি কখনও তারপরও বাড়িটা টানত তাকে। দিগন্তকে সাথে নিয়ে সুযোগ পেলেই রাজবাড়ির গেটে। বড় লোহার দরজা, সবসময়ই বন্ধ। সেখানে লোকজন থাকত কিন্তু কারা থাকত তা কখনই চোখে পড়েনি,আসলেই চোখে পড়েনি। এই যে কেউ বা কারা সেখানে বাস করে কিন্তু তাদের ঠিক দেখা যায় না, এটাই এক রহস্য মনে হতো। স্কুলের গেটে বিক্রি হতো কাঁচা খেজুর। সেসসবও যে পয়সা দিয়ে কিনে খাওয়া হতো একসময়, এখনকার ছেলেদের বললে বিশ্বাসই করবে না। এখন বার্গার, হটডগের স্বাদ পাওয়া শিশুদের হজমি, কাঁচা খেজুর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক।
আজ টিকা দিতে স্কুলে আসবে সরকারি লোকজন । আগে থেকে বলেনি স্যারেরা, বললে শতকরা  পঞ্চাশজন অনুপস্থিত থাকবে, এটা নিশ্চিত। প্রথম ক্লাস শেষ হয়ে দিগন্ত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে বাথরুম করার জন্য। প্রতিটি ক্লাস শেষে দিগন্তের বাথরুমের কথা বলে বাইরে যাওয়া রুটিন। ঠিক তখনি হেডস্যার সাথে স্কুলের অন্য শিক্ষকরা দুম করে ক্লাসরুমে উপস্থিত। জানলার গ্রিল ছিল না, দিগন্ত চট করে জানলা টপকে চলে যাবে বলে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল তখনি দপ্তরি নিখিল দা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। পালানোর পথ বন্ধ। বিড়বিড় করে কী যেন বলে লাইনে দাঁড়ায় সে ইশারায় কাছে ডাকে রাজুকেও। চিৎকার করে কান্না করার ইচ্ছেটা ঢোক গিলে দমন করে রাজু। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে লিসা তার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড়বড় করে, যদিও সে ভয় পেয়েছে বোঝা যায় তারপরও একদম ভেঙে পরেনি বোঝাই যায়। দিগন্ত ফিসফিস করে বলে আজ না আসলেই ভালো হতো, কেন যে আসলাম আর তোকেও নিয়ে আসলাম। ভয় পাস না। একটা পিঁপড়া কামড়ের মতো মনে হবে। এসব আমি জানি। চল আগা। তবুও টিকার সূঁচটার দিকে ঘুরেফিরে চোখ চলে যাচ্ছে।
ঠিকাদারের সামনে যখন সে দাঁড়িয়ে তখন রীতিমতো কাঁপছে রাজু।
তার কাঁপন দেখে হরেন স্যার বললো, আরে গাধা কাঁপিস ক্যান? তোকে পিঁপড়া কখনও কামড়ায় নাই? লিসার টিকা দেওয়া শেষ, সে তাকিয়ে আছে। শত  চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকিয়ে রাখা গেল না। ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো রাজু। টিকা শেষেও কান্না চলল যতটা না ব্যাথার কারণে তারচেয়েও বেশি লিসার সামনে কেঁদে ফেলার কারণে। বাড়ি ফেরার সারাটা পথ জুড়ে রাজু একটা কথাও বলল না। দিগন্ত লাল আইসক্রিম সাধল হজমি দিয়ে খাওয়ার জন্য, তাও খেল না সে। লিসার সাথে আগামীকাল কেমন করে এ মুখ দেখাবে সে চিন্তাতেই তার মন আরও খারাপ হতে শুরু করল।
লিসা থাকে রংপুর রেডিও সেন্টার স্টাফ কলোনিতে। বাম গালে টোল পড়া লিসার পাশে বসার জন্য ক্লাসের ছেলেদের প্রতিযোগিতা চলে।
দুপুরে রাজুর জ্বর এল শরীর কাঁপিয়ে।  নানি পাউরুটি আর দুধ নিয়ে সাধাসাধি করল বহুক্ষণ কিন্তু একদম খিদে নাই রাজুর। নানি বলত জ্বর আসলে বাঙালিকে খেতে হয় রুটি আর বিহারিদের  ভাত। দিগন্ত বিকালে এসেছিল, বলল মন খারাপ করিস না। কেঁদে ফেলেছিস তো কী হইছে। চল, জিনিস আনছি বলে চোখ টিপে দিলো। ম্যাজিশিয়ানের মতো পকেট থেকে বের করে দেখালো স্টার সিগারেট।
নাহ্ যাব না আজ বাইরে বলেও  কোনও জোরাজুরিই কাজে লাগল না। দিগন্ত প্রায় টেনে নিয়ে গেল বাইরে। নানাবাড়ির পূর্বদিকে লরেন্স ভাইদের বাসা। এখনও কমপ্লিট হয়নি। সেখানে বিকালে কেউ থাকে না, সেইসময় দিগন্ত সেখানে গিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে আসে। ইটের উপর বসে দুজনে সিগারেটে টান দেয়। একটু পরই দমকা কাশি আসে রাজুর, চোখে পানি চলে আসে কাশতে-কাশতে। দিগন্ত হাসতে থাকে রাজুর অবস্থা দেখে। নিয়মিত হওয়ার কারণে একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে ওর মাঝে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রুনু পিসি হারমোনিয়ামে গলা সাধতে বসেছে। দিগন্তের দিদিমা নিশ্চয়ই এ সময় জ্বালিয়েছে ধূপ। দুজনে বাড়ির দিকে রওনা দেয়, আগামীকাল স্কুলে যেতে হবে। লিসা কী আগামীকাল পাঠশালায় আসবে?

রাধাবল্লভ পাঠশালা

রবীন জাকারিয়া

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২১ অপরাহ্ণ

বট গাছের ভূত

আমার বাড়ির চারদিকে মোট ছয়টি স্কুল৷ গাদাগাদি৷ ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ২টি উচ্চ বিদ্যালয়৷ উচ্চ বিদ্যালয় দুটির একটি বয়েজ অন্যটি গার্লস৷ আমার বোধগম্য হয় না যে সরকারের নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার নিয়ম থাকার পরেও এমন গাদাগাদি ছয়টি স্কুল কীভাবে অনুমোদন পেয়েছিল৷ এদেশে সবই সম্ভব৷ 

আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত মুনসীপাড়া কেরামতিয়া প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ উপমহাদেশের নামকরা ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিক ও পীর সাহেব মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ভারত থেকে এদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে৷ তিনি মুনসীপাড়ায় বিয়ে করেন এবং শশুর বাড়িতেই আমৃত্যু অবস্থান করেন৷ মুনসীপাড়া কেরামতিয়া জামে মসজিদ -যেখানে পীর সাহেবের সস্ত্রীক মাজার আছে-সেই কর্তৃপক্ষের অবদানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে এটি শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষা কেন্দ্র দিয়ে৷ পরবর্তীতে এটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়৷ তাই তাঁর নামানুসারে স্কুলটির নামকরন করা হয় কেরামতিয়া ৷ আর মসজিদ থেকে স্কুল পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ হয় মাদরাসা রোড৷ শুধু তাই নয় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে আবাসন ছিল৷ পরবর্তীতে সেখানেই নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হয় মুনসীপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ স্কুল দু’টি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন৷ কেরামতিয়া স্কুল সেসময় রংপুরের অন্যতম ভালো স্কুলের একটি ছিল৷ উপড়ে টিনের দোচালা পাকা লম্বা কাঠামো৷ প্রতি ক্ল্যাশের জন্য আলাদা আলাদা বড় বড় কক্ষ৷ একাডেমিক ভবন, ল্যাবরেটরি আর প্রধান শিক্ষকের বিল্ডিংটা ছিল ছাদ পেটানো৷ সামনে বিশাল মাঠ৷ চারিদিকে প্রাচীন ফলের গাছ৷ আম৷ জাম৷ লিচু৷ কাঁঠাল৷ কত কি৷ মাঠের দুদিকে দুটি অতি পুরাতন গাছ ছিল৷ একটি পাইকর গাছ কিন্ত সকলে বট গাছ বলত৷ অন্যটি ছিল লম্বা কদম গাছ৷ কদম গাছ এত বড় আর ডালপালা ছড়ায় তা কখনো দেখিনি৷ এ গাছ দুটিকে সকলে ভূতুরে বলত৷ এখানে নাকি ভূত আছে৷ গাছের কোঠরে বিষধর সাপের আবাসস্থল৷ 

কদম গাছটির ঠিক নিচে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক মৌলভী খেরাজ আলী অত্র এলাকার মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরি”৷ সে সময় এই লাইব্রেরি সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে৷ বিখ্যাত সব লোকেদের আনাগোনা আর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ এখানে বই পড়তে আসতেন রংপুর মুনসীপাড়ার পুত্রবধু, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নেতা শহিদ জননী জাহানারা ইমাম৷

স্কুলের কোনো প্রাচীর নেই৷ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তা৷ পুরো স্কুরের চারিদিকে প্রশস্ত ড্রেন যেন প্রাচীরের গুরুত্ব কমিয়েছে৷

কেরামতিয়া স্কুলের মাঠ রংপুরের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক ও খেলাধুলার কেন্দ্রবিন্দু সর্বদা৷ সব সময় মাঠে মানুষের আনাগোনা৷ কেউ খেলছে৷ কেউ নিজের গামছা পেতে রেডিওতে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিংবা কোন পথিক গাছের নিচে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷ নব উদ্যম তৈরির আশায়৷ প্রচণ্ড গরমকালে রাতের বেলাতেও নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা মাঠে হাঁটাহাঁটি করে৷

আমরা সব বন্ধু রাতের খাওয়া শেষে মাঠের এককোণে আড্ডা দেই৷ ধুমপান করি৷ কলেজে কোন মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ চলছে৷ কিংবা কাকে ভালো লাগে এইসব৷ চলে রাত ১২-১টা পর্যন্ত৷ স্কুলের নাইট গার্ডের নাম আবুল৷ সে সকলের কাছে পরিচিত আবুল ভাই নামে৷ ভীতু প্রকৃতির মানুষ৷ সহজ-সরল৷ আমরা আড্ডা মারলে সে খুশি হয়৷ গল্প করে৷ তার বেশির ভাগ গল্পই চাপা৷ ভূত-প্রেতের৷ সে বলতে থাকে এই বট গাছে প্রেতাত্মা থাকে৷ তাকে বহুদিন দেখা দিয়েছে৷ কথা বলেছে৷ সে যেন কখনো তার কথার অবাধ্য না হয়৷  কথামতো চললে তাকে সোনার ড্যাগ (হাঁড়ি) দেবে৷ গাছের গোড়ায় শাবল দিয়ে দুই চাপ মাটি তুললেই সে সোনা পাবে৷ আর বেয়াদবি করলে ঘাড় মটকাবে৷ আমি বললাম সোনাগুলো নিচ্ছ না কেন? সে বলল না! লোভ করা যাবে না৷ ও একদিন নিজে থেকেই দেবে৷ সেই আশাতে আছি৷ গাঁজাখুড়ি কাহিনি৷ কিন্ত মুখে বলি না৷ কী দরকার? বরং খুশি রাখলে ওকে দিয়ে সিগারেট আনার কাজটা করানো যায়৷ সেটাই ভাল৷ Win-win conditoin.

পাড়ায় আমাদের Immidiat senior ব্যাচটা খুব ভয়ংকর৷ গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি, নেশা করা, মাস্তানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যে করে না৷ এদের জন্য প্রায় সময় পাড়ায়-পাড়ায় মারামারি লেগে থাকত৷ বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ রেইড করত৷ অগত্যা আমাদেরকেও শহর ছেড়ে পালাতে হতো৷ বিশ্রী৷ কিন্ত কিছু বলা যাবে না৷ ওদের ব্যাচের একটা ভাই ছিল৷ নাম শরিফুল৷ কোরআনে হাফেজ৷ পাড়ার ছোট একটা মসজিদে ইমামতি করায়৷ সময় পেলে শরিফুল ভাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যাংটাকালের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে এটাই নিয়ম৷ কিন্ত ওর বন্ধুরা এতই খারাপ যে কোল্ড ড্রিংকসের নাম করে সুকৌশলে তাকে মদ খাওয়ায় দিত৷ তারপর ওকে একা ছেড়ে দিত৷ মদ খেলে মানুষ গালিগালাজ করে৷ বেশি কথা বলে৷ কিংবা বাড়িতে চলে যায়৷ কিন্ত শরিফুল ভাই মদ খেলে স্কুলে ছাদে কিংবা গাছের ডালে অথবা সারারাত ধরে ড্রেনে পানি ছেঁকত৷ 
প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম মাঠে৷ আবুল ভাই বানানো গল্প বলে যাচ্ছে৷ শুনছি৷ একটা সময় সবাই বাড়ি চলে গেল৷ শুধু আমি, আমার বন্ধু রবু আর আবুল ভাই রয়ে গেলাম৷ বিদ্যুৎ চলে গেছে৷ প্রচণ্ড গরমে ঘুম আসবে না বলে থেকে গেলাম৷ বিদ্যুৎ নেই৷ দোকান পাট বন্ধ৷ অমাবশ্যা কিংবা পূর্ণিমার হিসেব করা হয়নি কখনো৷ কিন্ত আজ খুব অন্ধকার৷ কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কোথাও কেউ নেই নেই৷ কখনো ভূত-প্রেত বিশ্বাস করিনি৷ তাই আবুল ভাইয়ের গল্পকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি৷ কিন্ত এখন ভয় করছে৷ কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়৷ আসলে হবে যেখানে অন্ধকার হয় সেখানে ভূতের ভয়৷ আমি নিশ্চিত মুখে যতই বলি না কেন৷ কোনো বাঁশবাগানে, অশ্বত্থ গাছ, পুরোনো বট গাছের নিচে নিকষ অন্ধকারে ভূতের ভয় পাবে না এমন লোক নেই৷ 
আবুল ভাইকে গল্প থামাতে বললাম রাগী গলায়৷ দূরে বটগাছটার নিচে যে ড্রেন আছে, সেখানে হালকা আলো প্রতিফলন হচ্ছে৷ সবকিছু আবছা আবছা৷ আমরা তিনজন চুপ! তাকিয়ে আছি বট গাছের দিকে৷ দেখলাম ড্রেনের পানি থেকে কী যেন একটা উঠে এল৷ বটগাছটার নিচে দাঁড়াল৷ প্রায় অদৃশ্য মূর্তিটার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু উপরের দিকে সাদাটে আভা৷ সেখান থেকে মাঝে মাঝে তারার মতো আলো চমকাচ্ছে৷ মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে৷ হার্ট বিট বেড়ে গেছে৷ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ অশরীরিটা হঠাৎ জড়ানো কন্ঠে হাঁক দিলো, “আবুল তোরা এদিকে আয়”৷ ভয়ে নিজেদের মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম৷ আর রক্ষে নেই৷ আবার আদেশ করা হলো, “কি রে এখনো আসলি না যে?”
আবুল ভাই ধপাস করে পড়ে গেল৷ কাঁপতে লাগল৷ মুখে ফ্যানা৷ ওরতো মৃগীরোগ আছে বলে জানতাম না৷ ও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ লুঙ্গি স্থানচ্যুত৷ ছিঃ নোংরা৷ শরীরটাও ভালো ভাবে পরিষ্কার করে না৷ মায়া লাগছে৷ ভয় লাগছে৷ হঠাৎ মনে হলো এ অবস্থায় মৃগীরোগিকে চামড়া পোড়া বা চামড়ার স্যান্ডেল নাকে শুঁকাতে হয়৷ সবার পায়ে স্পঞ্জ৷ চামড়া নেই৷ স্পঞ্জের স্যান্ডেলই নাকে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ পর ও ঠিক হলো৷ বললো তোরা যা৷ দেখা কর৷ বেয়াদবি করিস না৷ ঘাড় মটকাবে৷ আর শোন সাথে লোহা কিংবা দেশলাই রাখ৷ ক্ষতি করতে পারবে না৷ বললাম আমাদের ও দুটোর কোনোটাই নেই৷ তাহলে কী হবে? সে তার গোছা থেকে দুটি চাবি খুলে দুজনের হাতে দিয়ে বললো আল্লাহ্ ভরসা৷

শক্তহাতে চাবি হাতে আধমরা ভয়ে দুজন হাঁটতে থাকলাম অশরীরির দিকে৷ চাবি নিয়ে কেন জানি একটু সাহস পেলাম৷ কিন্ত রবু ভয়ে কাঁপতে থাকায় চাবিটা হারিয়ে ফেলল৷ কাছাকাছি প্রায় এসেছি৷ এমন সময় বন্ধু রবু চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল৷ কাটা কলাগাছের মতো৷ যেন ধুপ করে পড়ে চুপ৷ লুঙ্গিতে পেচ্ছাব করে দিয়েছে৷ আকারে ছোট্ট বন্ধুটি দিগম্বর হয়ে যেভাবে পড়ে আছে, যেন ছোট খোকা এইমাত্র বিছানায় হিসু করে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওর বুকটা নাড়লাম৷ কোনো শব্দ নেই৷ ভয়েই শেষে মরে গেল কি না? আচ্ছা রবুর ঘাড়টা মটকালো না-তো? বুক ঢিপ ঢিপ করছে৷ আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকলাম৷ বুকে ফুঁ দিলাম৷  যতটা দূরত্ব রেখে অশরীরির কাছাকাছি যাওয়া যায়৷ অশরীরি বলল, “এত রাতে তোরা এখানে কেন?” কী উত্তর দেব ভাবতেই মাথায় বিদ্যূত খেলে গেল৷ আরেকটু কাছে গেলাম৷ আবছা আলোয় দেখতে পেলাম সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি খুলে মাথায় বেঁধে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন৷ তার মাথায় বাঁধা পাঞ্জাবির বোতামে হালকা আলোর রিফ্লেকশন তারার মতো জ্বলছে৷ সাহস করে আরো একটু কাছে গিয়ে দেখলাম অশরীরি আর কেউ নয় আমাদের মাতাল শরিফুল ভাই৷

বট গাছের ভূত