মনোসামাজিক পরামর্শ

মনোসামাজিক পরামর্শ

সিরাজুম মনিরা

২ জুলাই, ২০২০ , ৯:০৪ অপরাহ্ণ

করোনা পরিস্থিতিতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যত্ন

কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীর জন্য একটি বৈশ্বিক দূর্যোগ। আর যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা সংকটে বয়স্ক ব্যক্তিদের ঝুঁকির মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই বয়সের ব্যক্তিদের জন্য ডিমেনশিয়া একটি কঠিন মস্তিষ্কের রোগ।

বিশ্বব্যাপী ৫০ মিলিয়ন মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত এবং প্রতি ৩ সেকেন্ডে ১ জন করে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীতে বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য ডিমেনশিয়া একটি মহামারিতে রূপ নিচ্ছে। ডিমেনশিয়া এবং কোভিড-১৯ মহামারি উভয়ে একত্রে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও উপাত্ত জানার সুযোগ বেশ সীমিত। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া একটি প্রধান সমস্যা। এর ফলে তাদের জন্য কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সুরক্ষা পদ্ধতি যেমন – বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরিধান করা ইত্যাদি মনে রাখা বেশ কঠিন। এছাড়া তাদের কগনেটিভ সমস্যা থাকায় প্রচারিত জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য বোঝা ও বেশ কঠিন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে অবহেলা এবং কোয়ারেনটাইনের অপর্যাপ্ত ব্যাবস্থা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকি বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলতে পারে।


কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধে সরকার লকডাউন, কোয়ারেনটাইন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করছে। আমাদের দেশে বয়স্ক ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রধানত তাদের পরিবারের সাথেই বাস করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিক বাসায় অবস্থান করতে হচ্ছে এবং আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমনকি বাহিরে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এছাড়া আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে পারদর্শিতা না থাকায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ নেই বললেই চলে। এর ফলে তারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখছে এবং নিজেদের পরিত্যাক্ত ভাবছে। এসকল বিষয় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা একদিকে করোনা সংক্রমণের ভয় এবং অন্যদিকে লকডাউনের ফলে দীর্ঘদিন ঘরে অবস্থান করা নিয়ে উদ্বেগ ও বিষন্নতা, একই সাথে দুটি বিষয় নিয়ে বেশ চাপ অনুভব করছে। এছাড়া করোনায় কাছের মানুষের মৃত্যু তাদের মানসিকভাবে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। একইসাথে পরিবারের সদস্যবৃন্দ যারা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিক যত্ন করে তাদের মাঝেও উদ্বেগ ও বিষন্নতা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে। এছাড়াও সার্বক্ষণিক যত্ন ও সেবা করার কাজে নিয়োজিত থাকার ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে ও বার্ন আউটের শিকার হচ্ছে।

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নানাবিধ দীর্ঘমেয়াদি জটিল ও কঠিন রোগ থাকে যার জন্য তাদের প্রায়শই হাসপাতালে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিকট যেতে হয়। কিন্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি বাড়তি চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত সেবার সুযোগ সুবিধা নেই পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যয়ও অধিক। এসকল বিষয় ও পরিবারের জন্য বেশ উদ্বেগের কারণ।

বর্তমান বৈশ্বিক মহামারিতে বিশেষজ্ঞগণ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তার উপর জোর দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কাউন্সেলিং সেবার উপরও গুরুত্বারোপ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে এতে কোভিড-১৯ এবং ডিমেনশিয়া উভয়ের জটিল প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। আলঝাইমার ডিজিজ ইন্টারন্যাশনাল নামক সংস্থাটি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য অতি দ্রুততার সাথে নানাবিধ সহায়তা প্রদানেরউপর জোর দিয়েছে। এই সংস্থাটির মতে ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মনোসামাজিক সহায়তা প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। তবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিতের লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী পেশাজীবি, সমাজকর্মী এবং নানাবিধ সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে যৌথভাবে একত্রে কাজ করা প্রয়োজন।

করণীয়:

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার তাদের নিজেদের মানসিকভাবে ভালো থাকা ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক সুস্থতার জন্য নিম্ন লিখিত কাজগুলো চর্চা করতে পারে –

» ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি সম্বলিত তথ্যসমূহ ছবিসহকারে সহজ ভাষায় লিফলেট তৈরি করে বাসার কিছু নিদির্ষ্ট জায়গায় লাগিয়ে রাখা। এতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যবিধি ভুলেগেলেও লিফলেট দেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সহজ হবে।

» গৃহ পরিমণ্ডলে করা সম্ভব এমন কিছু বিনোদনমূলক কাজ বাসার সকলে মিলে আয়োজন করা। এতে লকডাউনের কারনে দীর্ঘদিন বাসায় অবস্থান করার ফলে সৃষ্ট একঘেয়েমি দূর করা কিছুটা হলেও সম্ভব হবে এবং পরিবারের সকলের সাথে ভালো সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হবে।

» আত্মীয়-স্বজন ও কাছের মানুষজনের সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাবস্থা করে দেয়া।

» ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করে বাসার ভিতরে কিছু আনন্দদায়ক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা। এটি তাদের বিষন্নতা ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করবে।

» চাপ কমানোর উপায় হিসেবে শিথিলায়ন চর্চা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার কেয়ারগিভারের জন্য একটি বেশ ফলপ্রসূ উপায়।

» করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য সহজ ভাষায় ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে জানানো।

» ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির আচরনগত ও আবেগীয় সমস্যা দেখা দিলে প্রয়োজনে চিকিৎসামনোবিজ্ঞানী ও মনরোগবিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।

» পরিবারের একজন ব্যক্তিই সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করার দায়িত্ব না নিয়ে অন্যান্য সদস্যদেরও সম্পৃক্ত করা । এতে কেয়ারগিভারের বার্ন আউটের সম্ভাবনা ও চাপ কমবে।

সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদা ও যত্ন সম্পর্কে পরিবার ও সকলের মাঝে সচেতনতা অতীব জরুরী।

করোনা পরিস্থিতিতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যত্ন

সাবিনা ইয়াসমিন

৩০ জুন, ২০২০ , ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

করোনা আতঙ্ক ও আত্মহত্যা-প্রবণতা

কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে পরাজিত গোটা বিশ্ব এত এত উন্নত প্রযুক্তি একের পর এক গবেষণা তবুও কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, ভয় উদ্বেগ মানুষকে আরও চেপে ধরেছে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে হাঁফিয়ে উঠেছে দিনের পর দিন। ফলে এইসব মানসিক চাপ, ভয় বা অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করতে না পেরে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। বিগত মহামারিগুলোর (যেমন সার্স, প্লেগ) দিকে তাকালে দেখা যায়, আত্মহত্যার সাথে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। মহামারি বাড়লে বাড়ে। কোভিড-১৯ মাহামারিতেও বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা দেখা গিয়েছে।

জার্মানীর হোসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী থমাস শেফার, যুক্তরাষ্টের এমিলি এমনকি মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জাহিদুল আত্মহত্যা করে এই করোনার কারনে। মহামারিতে এমনিতেই মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে সেখানে যদি মানুষ আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাহলে মহামারির অন্যান্য বিষয়গুলোর সাথে আত্মহত্যার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ। কেন মানুষ আত্মহত্যা করছে তার কারণগুলো জানা দরকার।

আত্মহত্যা-প্রবণতার কারণ

কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, করোনার এই দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তা, ভয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, একঘেয়েমি ও বন্দি জীবন, বিনোদনের অভাব, মানুষের চাকুরি হারানোর ফলে বাড়তি মানসিক চাপ ও উদ্বেগের সাথে যখন মানুষের দ্বন্দ্ব দেখা যায় তখন এই ভয়াবহ প্রবণতা আসে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগ যেমন বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসওর্ডার পারর্সনালিটি ডিসঅর্ডার, মাদক সেবন বেড়ে যায় ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আত্মহত্যা একদিনের ফল না। দীর্ঘদিনের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ফলে মানুষ একমূহুর্ত এসে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আত্মহত্যার কারণ জানার পাশাপাশি আত্মহত্যার জন্য কতগুলো পূর্ব সতর্কতামূলক চিহ্ন (ডধৎহরহম ঝরমহ) রয়েছে। তাই একজন মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে কিনা তা নিম্নলিখিত চিহ্ন বা আচরণ দ্বারা আগে থেকেই অনুমান করা যায়।

যেভাবে বুঝবেন কেউ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে

ক. নিজেকে শেষ করে দেয়ার অথবা নিজেকে হত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করা।

খ. সবসময় হতাশ লাগছে বা ভীষণ একা লাগছে, বেঁচে থাকার কোন মানে নাই, মরে যাওয়াই ভালো এসব কথা বললে।

গ. নিজেকে শেষ করার পরিকল্পনা করা যেমন ওষুধ কিনে রাখা, দড়ি কিনে রাখা, ব্লেড সংগ্রহ করে রাখা

ঘ. কোন সমস্যায় পড়লে সমাধান খুঁজে না পাওয়া

ঙ. অন্যদের ওপর বোঝা হয়ে গেছি এমন বললে

চ. প্রায়ই মাদক বা অন্য কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য বেশি পরিমানণ সেবন করলে

ছ. সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে।

জ. উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন আচরণ করলে।

ঝ. সবার কাছ থেকে বিদায় নিলে।

ঞ. নিজের পছন্দনীয় জিনিস বা সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে অন্যদের দান করলে।

ট. অল্পকিছুতেই আত্মহত্যার চেষ্টা করলে।

ঠ. প্রায়ই মরার কথা বললে।

ড. খাওয়া বা ঘুমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসলে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে পরিবার, বন্ধু, সমাজ সবাইকে। করোনা পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষ গৃহবন্দী এবং আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধে কতগুলো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে যা করতে হবে

» আত্মহত্যার ওয়ার্নিং সাইনগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

» সারাক্ষণ মোবাইল টিভি, পত্রিকায় করোনার খবর দেখা যাবে না এবং সব তথ্য বিশ্বাস করা যাবে না। গ্রহণযোগ্য মিডিয়া বা সোর্স এর প্রদানকৃত তথ্য বিশ্বাস করতে হবে।

» কারো মধ্যে আগে থেকে মানসিক সমস্যা থেকে থাকলে তাকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে যে হঠাৎ তার আচরণের কোন পরিবর্তন হয় কি না। যদি হয় তাহলে ততক্ষণাৎ কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

» কারো মধ্যে হঠাৎ হতাশা, মন খারাপ দেখলে তাকে সময় দিতে হবে, তার সাথে কথা বলতে হবে এবং তার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে।

» যেহেতু বেশিরভাগ সময় বাসায় কাটছে তাই সময়টাকে বিভিন্ন আনন্দদায়ক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। যেমনঃ সিনেমা দেখা, গানশোনা, পরিবারের সবার সাথে গল্প করা, বাচ্চাদের সাথে নিয়ে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে অথবা খেলা করা, শখের কাজ করা, পশুপালন করা, রান্না করা।

» দূরের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা।

» টিভি/অনলাইনে শারীরিক ও মানসিক সাস্থ্যসেবা দিচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করা বা প্রয়োজনীয় নাম্বার সংগ্রহ করে রাখা।

» যদি কারো পূর্বেই আত্মহত্যার চেষ্টা করার রেকর্ড  থাকে তবে তাদের প্রতি বাড়তি সতর্ক থাকা এবং বাসার ছুরি, দা, ব্লেড, দড়ি ওষুধ সরিয়ে রাখা।

» সবশেষ মহামারি সবসময় একটি মানসিক চাপ। তাই এই চাপে ভেঙে না পড়ে মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করা।

আর এই কোভিড-১৯ এর জন্য যেহেতু এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই তাই শারীরিক শক্তি বাড়ানো পাশাপাশি মানসিক শক্তিও বাড়াতে হবে যাতে সব ধরনের আতঙ্ক, হতাশা ও আত্মহত্যার মতো বিষয় প্রতিহতো করা সম্ভব হয়।

 

করোনা আতঙ্ক ও আত্মহত্যা-প্রবণতা

সিরাজুম মনিরা

২৪ মার্চ, ২০২০ , ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আপনার গৃহবন্দী শিশুর জন্য করণীয়

বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার বেশ কিছু দিন আগেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। অফিস আদালতও ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে।

আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মঘণ্টা সীমিত করে দিয়েছে এবং বাসায় থেকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জনসমাগমস্থল যেমন – শপিং কমপ্লেক্স, মার্কেট, সিনেমাহল ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

এমতাবস্থায় আমরা অনেকটাই গৃহবন্দী হয়ে পড়েছি। এই অবস্থার সাথে মানিয়ে চলা যেখানে আমাদের মত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে সেখানে শিশু কিশোরদের পক্ষে মেনে নেয়াটা আরও বেশি কষ্টকর।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুরা নানা ধরনের আবেগিয় প্রতিক্রিয়া (যেমন – খিটমিটে মেজাজ, অল্পতেই উত্তেজিত ও রাগান্বিত হওয়া) দেখাতে পারে। এছাড়া শিশুদের দৈনন্দিন রুটিন অনেক বেশি এলমেলো হয়ে যেতে পারে, যেমন – গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ও সকালে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠা। এসকল ক্ষেত্রে সন্তানের সাথে পিতামাতা হিসেবে আপনার দ্বন্দ্ব কিছুটা বেড়েও যেতে পারে।

তবে কিছু ছোটখাটো কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় আপনাকে সাহায্য করতে পারে –

১. পিতামাতা হিসেবে আপনার প্রথম কাজ হল সন্তানকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খুলে বলা ও সতর্কতামূলক কাজগুলোর ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারনা দেয়া। তবে মনে রাখবেন আপনি যে বিষয়ে কথা বলছেন তার ভাষা ও মাধ্যম যেন আপনার সন্তানের বয়স উপযোগী হয়। এক্ষেত্রে আপনার সন্তানের বয়স যদি কম হয়ে থাকে তবে আপনি নানা সৃজনশীল উপায় (যেমন – খেলা, ছবি আঁকা) ব্যবহার করে শিশুকে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারেন।

২. স্কুল না থাকলেও আপনার সন্তানের যেন একটি দৈনন্দিন রুটিন থাকে এবং তাকে ঐ রুটিন অনুযায়ী চলতে উদ্বুদ্ধ করুন। তবে রুটিনটি যেন আপনার সন্তানের জন্য খুব বেশি কঠিন না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরী। রুটিন তৈরিতে তাকেও সংযুক্ত করুন।

৩. শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করাতে পারেন এবং পাশাপাশি তার নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে উৎসাহ দিন। এমনকি আপনার সন্তানের বয়স যদি কম হয়ে থাকে তারপরও তাকে তার বয়স অনুযায়ী কাজ দিন যেমন – খেলনা গুছানো।

৪. গৃহ পরিমণ্ডলে খেলা যায় এমন খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।

৫. সারাবছর পড়াশুনার চাপে হয়ত আপনার সন্তান তার শখের কাজগুলো করার সময় পায় না তাই এই সময়টাকে কাজে লাগাতে পারেন। সন্তানকে নানা সৃজনশীল কাজে (যেমন – গল্পের বই পড়া, ছবি আঁকা, গল্প লিখা, কোন কিছু তৈরি করা ইত্যাদি) অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিন ও উৎসাহ দিন।

৬. এসময় যেহেতু পরিবারের সকলেই একত্রে বাসায় অবস্থান করছেন তাই সকলে মিলে ভালো কিছু সময় কাটাতে পারেন। এজন্য সকলে মিলে একত্রে কিছু করার চেষ্টা করতে পারেন, যেমন – বাসার কোন কাজ বা সিনেমা দেখা ইত্যাদি।

৭. সন্তানকে তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ করে দিন।

৮. সকল কিছুর মাঝেও তার পড়াশুনার প্রতি নজর দিন। এই কাজে আপনিও তাকে সাহায্য করতে পারেন।

৯. মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিন।

১০. ধর্মীয় কাজকর্ম বা নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় শিশুকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করুন।

সকল প্রতিকুলতার মাঝেও এই সময়টি আপনার সন্তানের সাথে ভালো সময় কাটানোর একটি বড় সুযোগ। সন্তানের কর্ম চঞ্চলতাকে কাজে লাগিয়ে তাকে নানা ধরনের ফলপ্রসূ কাজে ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি সন্তানের কথা শোনার ও সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করুন।

সিরাজুম মনিরা
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর।
চেম্বার: রিদম ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার (ধাপ আট তলা মসজিদের পশ্চিমে)
সিরিয়াল: ০১৭৭৭৩৩৭০৮৯

 

করোনা পরিস্থিতি: আপনার গৃহবন্দী শিশুর জন্য করণীয়

সিরাজুম মনিরা

২১ মার্চ, ২০২০ , ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

করোনা আতংক: মানসিক চাপ কমাবেন যেভাবে

বর্তমান পৃথিবীর জন্য একটি বড় ধরণের সংকট হলো পৃথিবীব্যাপি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। এই সংকট শুধুমাত্র যে একটি রোগ তা নয় বরং এর প্রভাব রয়েছে সমাজ ও অর্থনীতিতে।

এমনকি যে বিষয়টি এখনও কেউ তেমন আলোচনা করছেন না তা হলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও বড় ধরণের চাপ তৈরি করছে এই ভাইরাস। এ ধরণের যে কোন সংকটে মানসিক চাপ ও কষ্ট অনুভব করা, ভীত হওয়া, আতংকিত হওয়া, বিভ্রান্ত হওয়া, রাগান্বিত হওয়া ইত্যাদি আবেগীয় ঘটনা একজন মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

তবে এসব আবেগীয় প্রতিক্রিয়া কোন ব্যক্তি অতিমাত্রায় অনুভব করলে এর নেতিবাচক প্রভাব তার দৈনন্দিন কাজকর্ম ও আচরণের উপর পড়তে থাকে। এর ফলে ব্যক্তি সংকট/সমস্যা মোকাবেলার প্রতি মনোযোগী না হয়ে আরও অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা করতে থাকে যা তার মানসিক চাপের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে জীবনমান কমিয়ে দেয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু ছোট খাটো পদক্ষেপ এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি মানসিক চাপ কমাতেহও সাহায্য করবে। মানসিক চাপ কমাতে যা করতে হবে:

১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করা যেমন: যথাসম্ভব বাসায় অবস্থান করা, সঠিক সময়ে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম, কাছের মানুষজনের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্য, ইমেইল এর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। পাশাপাশি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা।

২. সতর্কতা মূলক কাজকর্মের (যেমন পরিষ্কার পরিছন্নতা) প্রতি উদাসীনতা না দেখিয়ে বরং মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব দেখালে তা শুধু নিজের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনবে তা নয় আমাদের পরিবার ও সমাজকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিবে। তাই আপনি সঠিকভাবে মেনে না চললে আপনার পরিবারের লোকজন আপনাকে সতর্কতা মূলক কাজগুলো করার জন্য চাপ দিলে আবেগিয় প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কেন বলছে সে বিষয়ে ভাবা এবং মেনে নেয়া।

৩. আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ধুমপান বা কোন মাদকদ্রব্য গ্রহণ না করা।

৪. অতিমাত্রায় মানসিক চাপ, দুঃশ্চিন্তা অনুভব করলে লুকিয়ে না রেখে এ ব্যাপারে কথা বলা। আলোচনা করা এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।

৫. ভুল তথ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সত্য ও বিজ্ঞান নির্ভর তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে খুঁজুন)থেকে নিতে হবে এবং সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে।

৬. মানসিক অস্থিরতা কমানোর জন্য করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত সংবাদসমূহ অতিমাত্রায় পড়া, দেখা বা শোনার মাত্রা কমিয়ে দেয়া।

৭. অতীতেও আপনি হয়তো আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা সংকট দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেছেন। সেই অতীত অভিজ্ঞতাগুলো থেকে আপনার দক্ষতাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। এই দক্ষতাগুলোই বর্তমান সংকটে আপনার আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য করণীয়:

এখন আমরা আলোচনা করবো উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় নিয়ে।কারণ শিশুরা এ সকল সংকট ও চাপে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেমন: উদ্বিগ্নতা, রাগান্বিত হওয়া, উত্তেজিত হওয়া, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, ঘ্যানঘ্যান করা বা কাছের মানুষের সাথে আঠার মতো লেগে থাকা ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো-

১. শিশুদের আবেগীয় পরিবর্তনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে শোনার চেষ্টা করা। তাদের প্রতি মনোযোগ দেয়া এবং আদর করা।

২. শিশুদের সাথে কথা বলা এবং তাদের আশ্বস্ত করা।

৩. শিশুদের সাথে কথা বলা এবং তাদের আশ্বাস্ত করা।

৪. শিশুদেরকে তাদের পিতামাতা ও পরিবারের সাথে রাখা। যদি কোন কারণে আলাদা করতে হয় তবে সে ব্যাপারে খুলে বলা এবং নিয়মিত যোগাযোগ করা।

৫. একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর উপায়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করা।

৬. শিশুর বয়স অনুযায়ী তাকে সঠিক তথ্য প্রদান করা এবং আশ্বস্ত করা।

সর্বোপরি সবার উদ্দেশ্যে একটি বার্তা-অপ্রয়োজনে ভুল তথ্য নিয়ে আতংকিত না হয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন।

নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে সচেতন করুন।

সবাই মিলে শারিরীক ও মানসিকভাবে ভালো থাকুন।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ওয়েবসাইট

 

সিরাজুম মনিরা

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর।

চেম্বার: রিদম ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার (ধাপ আট তলা মসজিদের পশ্চিমে)

সিরিয়াল: ০১৭৭৭৩৩৭০৮৯

করোনা আতংক: মানসিক চাপ কমানে যেভাবে

সাবিনা ইয়াসমিন

১৯ মার্চ, ২০২০ , ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

মনোযৌন সমস্যা

কেস-১:

আতিকের (ছদ্মনাম) বয়স ৩৫ বছর। একজন ব্যাংকার।

এক মাস পর বিয়ে, কিন্তু বিয়েতে তার কোন মত নেই। তার পরিবার এক প্রকার জোর করেই এই বিয়ে দিচ্ছে। এজন্য দুঃশ্চিন্তায় তার ঘুম হচ্ছে না। কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না, অস্থিরতায় ভুগছে এবং অল্পতেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে।

এজন্য তিনি একজন মনোবিদের কাছে এসেছেন সহায়তা নিতে। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল যৌনকর্মে তিনি কোন আগ্রহ পান না। যদিও বা কখনও আগ্রহ হয় কিন্তু পুরুষাঙ্গ খুব বেশি শক্ত হয় না এবং দ্রুত বীর্যপাত ঘটে যায়।

ইদানিং তার পুরুষাঙ্গকে অনেক ছোট এবং চিকন মনে হয়। এজন্য আতিকের দুঃশ্চিন্তা অনেক বেশি। তিনি নিজেকে পুরুষ হিসেবে অক্ষম মনে করেন। সমাজে ছোট হবার ভয়ে কাউকে বলতেও পারেন না। চুপি চুপি তিনি অনেক কবিরাজি, হোমিপ্যাথি এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখিয়েছেন। অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষাও করিয়েছেন কিন্তু কোন সমস্যা ধরা পড়ে নি এবং কোন সুফল আসছে না।

কেস-২:

শাকিব ও অনন্যার (ছদ্মনাম) বিবাহিত জীবন তিন বছর। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরস্পরকে তালাক দিবেন।

অনন্যার অভিযোগ সাকিব তার সব চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সব সময় অনন্যাকে এড়িয়ে চলে।

অনন্যার ইচ্ছাতেই সবসময় যৌনমিলন হয় তবে সেটা খুব জোরপূর্বক এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাকিবের বীর্যপাত হয়। এজন্য প্রায়ই ওদের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে।

সাকিব দিনের বেলা অফিসে থাকেন আর রাতে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে নিজের একটা ব্যক্তিগত পড়ার রুম আছে সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত সময় কাটান। ঐ রুমে অন্য ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছেন সাকিব।

অনন্যা অনেক প্রশ্ন করেছেন এবং খোঁজও নিয়েছেন কোন উত্তর পান নি। এমনকি অন্য মেয়েদের সাথে কোন সম্পর্কও খুঁজে পান নি।

সাকিবের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানা গেল, সাকিবের যৌন চাহিদা অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি মেয়েদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব না করে মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদের প্রতি যৌন অনুভূতি অনুভব করেন। তার নিজস্ব রুমে তিনি মেয়েদের ব্রা, প্যান্টি, শাড়ি, ব্লাউজ, লিপস্টিক, মেকাপ রেখে দিয়েছেন।

একান্ত সময়ে তিনি এক এক করে শরীরে পরতে থাকেন এবং উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন।

প্রথমে ব্রা, তারপর প্যান্টি পড়েন এবং বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখেন আর যৌন উত্তেজনায় লাল হতে থাকেন। এভাবে তিনি শাড়ি পড়েন, ঠোঁটে লিপস্টিক দেন এবং প্রছ- কামনায় তাকিয়ে থাকেন নিজের দিকে। নিজেকে তখন তার অন্য নারী মনে হয়। এইভাবেই সেই ছবির দিকে তাকিয়ে হস্তমৈথুন করে তিনি যৌন তৃপ্তি লাভ করেন।

কেস-৩:

রুমা ও সোমা (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন থেকে একই হোস্টেলে থাকেন। একই বিছানায় ঘুমান। একসাথে খান, বাইরে যান, আবেগীয় অনুভূতি শেয়ার করেন। তারা দুজন দুজনকে প্রচ- রকম ভালোবাসেন। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারেন না।

তারা দুজন দুজনের প্রতি প্রচ-ভাবে শারীরিক ও আবেগীয় আকর্ষণ অনুভব করেন। ছেলেদের প্রতি তাদের কোন কোন আকর্ষণ নেই। তারা মাঝে মাঝে যৌনকর্মও করে থাকে। তারা একে অপরকে বিয়ে করবে বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিপত্তি ঘটল তখনই যখন তারা তাদের পরিবারকে বিষয়টা জানালেন। তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়মের সাথে যায় না। এজন্য রুমার পরিবার তাকে জোর করে একজন মনোবিদের কাছে এনেছেন।

 

উপরে বর্ণিত তিনটি পৃথক কেস থেকে আমরা ৩ ধরণের সমস্যা দেখতে পাচ্ছি যেগুলোকে বলা হয় মনোযৌন সমস্যা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Psychosexual-disorders. মনোযৌন সমস্যা হলো সেই সমস্যা যেগুলো কোন শারীরিক কারণ বা রোগ থেকে হয় না। শুধুমাত্র কতগুলো মানসিক মানসিক ও সামাজিক কারণে ঘটে থাকে। এ সমস্যাগুলো সাধারণত তখনই ঘটে যখন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরণের ভয়, দুঃশ্চিন্তা এবং অপরাধবোধে ভোগে। তাছাড়াও যৌন যৌন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, সঙ্গীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে না ওঠা, পূর্বের দুঃখজনক যৌন অভিজ্ঞতা, অসুখী বিয়ে, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ ইত্যাদি কারণেও যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যক্তির মূল্যবোধ বা বিশ্বাসের সাথে যৌন সম্পর্ক বা কর্মের মানসিক দ্বন্দ্ব। যেমন ব্যক্তি যদি ছোট থেকে জেনে আসে যে, যৌনকর্ম পাপ এবং নোংরা কাজ তাও তার জীবনে যৌন কাজে বাধা প্রদান করতে পারে।

আমরা সাধারণত তিন শ্রেণির বা ক্যাটাগরির মনোযৌন সমস্যা দেখতে পাই।

১. যৌন ক্রিয়ার অস্বাভাবিকতা (Abnormality in sexual act): এক্ষেত্রে ব্যক্তির যৌন আগ্রহ বা উত্তেজন কমে যায়, লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা দেখা যায়, দ্রুত বীর্যপাত ঘটে। আবার অনেকে আছে যৌন কর্ম করে কোন রকম আনন্দ বা তৃপ্তি লাভ করে না। তাছাড়া ব্যথাযুক্ত যৌন মিলন এবং অনেকের মধ্যে যৌন বিদ্বেষও দেখা যায়।

২. লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য সনাক্তকরণে অস্বাভাবিকতা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি শারীরিকভাবে কোন বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে কোন বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে যে নিজেকে অন্য লিঙ্গের মনে করে। এবং তার কার্যকলাপেও তা প্রকাশ পায়। যেমন একজন ছেলে নিজেকে মেয়ে মনে বা একজন মেয়ে নিজেকে ছেলে মনে করে। তারা সেভাবেই ছেলেদের বা মেয়েদের মতো আচার আচরণ করে থাকে। এমনকি অপারেশন করেও তারা নিজেদের লিঙ্গের পরিবর্তন ঘটাতে চায়। হিজরা (অপারেশন করিয়ে যারা হিজরা হয়), পুরুষ/নারী সমকামিতা এর উদাহরণ।

৩. যৌন উত্তেজনার উৎস সম্পর্কিত অস্বাভাবিকতা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন উত্তেজনা লাভ করে থাকে। যেমন নারীদের পোশাক, শিশু, বিভিন্ন প্রাণী বা বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে থাকে। এইসব মনোযৌন সমস্যার কোন শারীরিক ভিত্তি থাকে না। সমস্যার মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। সমস্যা বেশি হলে ঔষধের চিকিৎসার পাশাপাশি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং নিয়ে ব্যক্তি এ ধরণের সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

 

সাবিনা ইয়াসমিন

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর।

চেম্বার: ব্রেইন এন্ড মাইন্ড, ধাপ, রংপুর

মনোযৌন সমস্যা

সিরাজুম মনিরা

৯ মার্চ, ২০২০ , ৭:৫০ অপরাহ্ণ

পজেটিভ প্যারেন্টিংঃ সন্তান লালন-পালনের ইতিবাচক কৌশল

পর্ব-১

বর্তমান সময়ের সকল পিতা মাতার (Parent) একটি সাধারণ জিজ্ঞাসা হলো কীভাবে সন্তান লালন-পালন করবো? কী করলে সন্তানটি একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে? এ ধরণের নানান প্রশ্ন বর্তমান সময়ের সব পিতা-মাতার মনে ঘুরপাক খায়।

সমস্যা হলো আমরা যে সময়ে এবং সমাজ ব্যবস্থায় বড় হয়েছি এবং যেভাবে আমাদের পিতা মাতা আমাদের লালন পালন করেছে সেই সময়ের থেকে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া সন্তান লালন পালনের মত একটি জটিল বিষয় সম্পর্কে আমাদের কোন পড়াশোনা নেই বললেই চলে। আমরা মূলত শিখছি কীভাবে আমাদের লালন পালন করা হয়েছে, অন্যের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের মত করে একটি উপায় বের করছি। এই উপায় কখনও সফল হচ্ছে কখনও আবার ব্যর্থ হচ্ছে।

এখন যদি আমরা জানতে চাই কীভাবে ইতিবাচক উপায়ে আমার সন্তানকে পালন করবো? তবে তার আগে জানতে হবে আমি কোন ধরণের প্যারেন্ট বা পিতামাতা।

সাধারণত ৪ ধরণের প্যারেন্ট বা পিতামাতা রয়েছে।

১। কর্তৃত্ববাদী/ কঠোর পিতামাতা (Authoritration)

২। যত্নশীল পিতামাতা (Authoritative)

৩। অনুমতিমূলক পিতামাতা (Permissive)

৪। উদাসীন পিতামাতা (Neglectful)

এই চার ধরণের পিতা মাতার বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রভাব সম্পর্কে অন্য একটি লেখায় লিখবো।

আজ মূলত কিছু টিপ্স দেব সন্তান লালন পালনের ইতিবাচক কৌশল বিষয়ে।

১. আপনার সন্তানকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করুন। তার চাহিদাগুলো কী কী তা জানার চেষ্টা করুন।

২. তার সাথে খোলামেলা কথা বলা চেষ্টা করুন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

৩. সন্তানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।

৪. একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সন্তানের জন্য কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিন।

৫. সন্তানের সাথে গুণগত সময় কাটান। তার সাথে খেলাধুলা করুন, ঘুরতে যান, গল্প করুন।

৬. মনে রাখতে হবে সন্তানকে ভালো আচরণ শেখাতে চাইলে আগে নিজেকে ভালো আচরণ প্রদর্শন করতে হবে।তাকে ভালো আচরণে উদ্বুদ্ধ করুন, মনোযোগ দিন, প্রশংসা করুন এবং পুরস্কার দিন।

৭. কোন কারণে সন্তান খারাপ আচরণ করলে সেদিকে বেশি মনোযোগ না দিয়ে শান্তভাবে বোঝান। কখনোই যেন সে খারাপ আচরণে পুরস্কার না পায়।

৮. বর্তমান সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সন্তানের জন্য মোবাইল ফোন চালানো, টেলিভিশন দেখা, ল্যাপটপ চালানোর সময় নির্ধারণ করুন।

মোট কথা, আপনার সন্তানকে ভালোবাসুন, উৎসাহ দিন, প্রশংসা করুন এবং সন্তানের সামনে তার রোল মডেল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলুন।

 

সিরাজুম মনিরা,

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর।

চেম্বার: রিদম ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার (ধাপ আট তলা মসজিদের পশ্চিমে)

সিরিয়াল: ০১৭৭৭৩৩৭০৮৯

monosamajik pramorsho

সিরাজুম মনিরা

৫ মার্চ, ২০২০ , ১২:২৭ অপরাহ্ণ

মানসিক স্বাস্থ্য-সচেতনতার শুরুর কথা

স্বাস্থ্য বলতে এক কথায় আমাদের মনে প্রথমেই শারীরিক সুস্থতা বা অসুস্থতার কথাই ভেসে ওঠে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় কেবল রোগ বা দূর্বলতার বিষয়কে গুরুত্ব দেয় নি বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার একটি সুষ্ঠু অবস্থার কথা নির্দেশ করা হয়েছে।

কিন্তু আমাদের কাছে মানসিক অবস্থা বা মানসিক স্বাস্থ্য একটি উপেক্ষিত বিষয়। এমনকি আমরা এ সম্পর্কে মোটেও সচেতন নই। এই অবহেলা বা অসচেতনতা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ধারণা।

কেউ মানসিক সমস্যার কথা ভুল করে বলে ফেললে আমরা তাকে ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করি বা কখনও এমনও বলে থাকি যে, সেই ব্যক্তি নাটক/অভিনয় করছে। তাকে নানাভাবে হেয় করে থাকি। আমরা ভুলেই যাই যে, মানসিক মানসিক স্বাস্থ্যও স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।তবে আশার কথা হলো, দিন দিন মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা বাড়ছে এবং আমরা এই বিষয়ে বলতে চাই।

এখন যদি আমরা বুঝতে চাই আসলে মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কী বুঝায়? মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা এমন একটি অবস্থাকে বুঝি যেখানে একজন ব্যক্তি নিজস্ব দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে দৈনন্দিন জীবনের চাপসমূহ যথাযথভাবে মোকাবেলা করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

শারীরিক সমস্যাসমূহ সহজেই আমাদের চোখে পরে কিন্তু মানসিক সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় আমরা এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি না। এর ফলে সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা কমে যেতে থাকে। এমনকি পাশাপাশি নানা ধরণের শারীরিক লক্ষণও দেখা যায়। আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে মানসিক সমস্যার প্রকোপ সম্পর্কে অতটা আন্দাজ করতে পারি না। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ১৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং শতকরা ১৮ জন শিশু কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

এছাড়া আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন তাদের মানসিক সমস্যার কথা প্রকাশ করতে চায় না এবং চিকিৎসা করাতে চায় না।

এ অবস্থায় আমরা যদি সুখি সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠণ করতে চাই তবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে কখনোই তা করতে পারব না। এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও সম্ভব নয়।

তাই আসুন, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হই, এ বিষয়ে কথা বলি।

সিরাজুম মনিরা  ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর

 

monosamajik pramorsho