স্মরণ

স্মরণ

মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্

২০ ডিসেম্বর, ২০২২ , ১:১০ অপরাহ্ণ

১১৫ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি: একজন কাব্যবিনোদ

বর্তমান প্রজন্মের কয়জন জানেন এই উত্তরাঞ্চলে জন্ম নেয়া একজন কাব্যবিনোদ, একজন ছান্দসিক কবির কথা? আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা দায়বদ্ধ তাই আজকে তার জন্মদিনে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলাম।

কবি নূরুল ইসলাম আমাদের রংপুরের বাবুখাঁয় জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর আজকের এই দিনে। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ১১৪ বছর।দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন তিনি। ১০৫ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি জানান দিয়েছেন তার কাব্য প্রতিভা। “আমার আশা” শিরোনামে একটি ছড়ার মাধ্যমে তার খ্যাতি সেসময়ে ছড়িয়ে পড়ে।ছড়াটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত শরৎ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক গল্পলহরীর রবীন্দ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পাঠকের সুবিধার জন্য ছড়াটি সংযুক্ত করলাম।

আমার আশা 

আমি রবির মতো কবি হবো

যদি বড়ো হই,

আমি জগৎ মাঝে জানিয়ে দেবো

তুচ্ছ মোটেও নই।  

আমি নোবেল নেব ডবল করে

লিখে কাব্যখানি,

আমি নতুন রবি ভেবে জগৎ

করবে কানাকানি। 

আমি নতুন করে গড়বো আবার

বিদ্যানিকেতন,

আমি দেশবাসীরে জ্ঞান বিলিয়ে

করবো উঁচুমন।  

আমার সকল কথাই সিদ্ধ হবে

যদি রবি হই,

আমি জগৎ মাঝে জানিয়ে দেবো

তুচ্ছ মোটেও নই। 

এবার আসি তার কাব্যবিনোদ নামটির ইতিহাসে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা গৌড়বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ কবি নূরুল ইসলাম কে ছড়া সাহিত্যে তার বিশেষ অবদানের জন্য কাব্যবিনোদ উপাধি তে ভূষিত করে।সেই থেকে তিনি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ নামে সমাদৃত। 

মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী ছিলো ব্যাপক জনপ্রিয় একটি পত্রিকা।১৯০৩ সালে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো।পরবর্তীতে এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে “ফসল” কবিতাটি প্রকাশিত হয় নূরুল ইসলাম নামে। মাসিক মোহাম্মদী তে নিয়মিত লিখতেন মোহাম্মদ আকরম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজীবুর রহমান খাঁ, মঈনউদ্দিন হুসায়ন, সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, তালিম হোসেন, আবদুল হাই, আবু জাফর শামসুদ্দীন, হবীবুল্লাহ্ বাহার চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, আবদুল গনি হাজারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু রুশদ, জসীমউদ্দীন, আশরাফ সিদ্দিকী, ফেরদৌস খান প্রমুখ।

২০০১ সালে কবি ও প্রচ্ছদশিল্পী বাশার ইবনে জহুরের করা প্রচ্ছদে কবির দৌহিত্র ডা. আশেকুল আরেফিনের প্রকাশনায় রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা “হামার অমপুর” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বইটি দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ পায় প্রকাশক শাকিল মাসুদ এর আইডিয়া প্রকাশনী থেকে। এছাড়া একই প্রকাশনী থেকে কবি বাশার ইবনে জহুর ও প্রকাশকের সম্পাদনায় “মধুবসন্ত” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।সদ্যপ্রয়াত কথাশিল্পী এ্যাড এম এ বাশার এর সম্পাদনায় ২০০১ সালে রুবাইয়াত ছন্দে লেখা কাব্যগ্রন্থ “রুবাইয়াত-ই-নূর” প্রকাশিত হয়।

কবির মৃত্যুর ঠিক চার বছর আগে অর্থাৎ ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। অসুস্থ থাকায় কবির পক্ষে তার স্নেহভাজন বাংলা একাডেমির সহকারী সম্পাদক লেখক ও সম্পাদক আবিদ করিম মুন্না সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট গ্রহণ করেন।

কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ছিলেন একজন সজ্জন ব্যক্তি।খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতেন। গোলাপ, গাঁদা, রক্তজবা ফুল সবসময়ই তিনি পকেটে নিয়ে হাঁটতেন। কারো জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতেন।এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে ছড়া/কবিতা লিখে শুভকামনা জানাতেন। এখনও সেইসব ছড়া কবিতাগুলো স্বযত্নে রেখে দিয়েছেন কাব্যবিনোদ এর পরম ভালোবাসায় পাওয়া সেই সৌভাগ্যবান মানুষেরা।

১৯৭৮ সালে প্রয়াত সাহিত্যিক ও সংগঠক একেএম শহীদুর রহমান বিশু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অভিযাত্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ছিলেন কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ। সাপ্তাহিক আসরগুলো তে সবসময়ই তার সরব উপস্থিতি ছিলো। যদি কোনোদিন দেখতেন আসরে উপস্থিত হতে পারবেন না সেদিন তিনি সকালে এসে একটি চিরকুট রেখে যেতেন। সাথে একটি কবিতা ও ফুলের পাপড়ি। চিরকুটে এরকম কিছু লেখা থাকতো,’শরীরটা ভালো না। আমার কবিতাটি আসরে পাঠ করলে কৃতজ্ঞ থাকব ‘।

১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজস্ব  সংগঠন ছান্দসিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। 

কবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ছড়া সংসদ,রংপুর গত দুইবছর থেকে তার নামে সম্মাননা দিয়ে আসছে “ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ছড়া সম্মাননা “। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বিভাগীয় লেখক পরিষদ তাঁকে দিয়েছিল তাদের প্রথম গুণী সাহিত্যিক সম্মাননা।

প্রয়াত এই কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ছোটবেলায় বাবার মুখে নামটি প্রথম জেনেছিলাম।তারপর সাহিত্য অঙ্গনে প্রিয় অগ্রজদের মুখে তার গল্প,তার লেখালেখি পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি।বাংলা ভাষার রুবাইয়াতের প্রবর্তক ছান্দসিক কবি নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ বেঁচে থাকুন সব সাহিত্যিকের শ্রদ্ধার আসীনে। সেইসাথে তার মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মানের দাবি রাখছি।

সূত্র: 

১. বাশার ইবনে জহুর, কবি ও গীতিকার 

২. মাহবুবুল ইসলাম, কবি ও সাংবাদিক 

৩. কৃষিবিদ আবিদ করিম মুন্না, লেখক ও সম্পাদক

৪. সাঈদ সাহেদুল ইসলাম, কবি ও ছড়াকার 

৫. জাহিদ হোসেন, কবি ও সম্পাদক

স্মরণ - ১১৫ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি - একজন কাব্যবিনোদ - মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ্

রবীন জাকারিয়া

২৪ নভেম্বর, ২০২২ , ১২:২৪ অপরাহ্ণ

আফতাব ভাই লেখাগুলো পড়বেনতো?

আফতাব ভাই সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে আমার নিজের সম্পর্কে একটু না বললে পাঠ করতে ছন্দ পতন ঘটবে৷ কেননা উল্লেখ করবার মতো আমার তেমন কোন খ্যাতি নেই৷

আমি ছোটবেলা থেকে টুকটাক লেখালেখি করতাম৷ সেগুলো কখনো পাড়ার লিটল ম্যাগাজিনে কিংবা রংপুরের আঞ্চলিক পত্রিকায়৷ ব্যাস! এতটুকুই৷ সেটাও নব্বইয়ের দশকে৷

যেহেতু আমার বাড়ি মুনসিপাড়ায় এবং সর্বদা কাচারি বাজারে আড্ডা মারতাম৷ তাই রংপুর শহরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া ব্যক্তি থেকে শুরু হালের উদীয়মান মস্তানদের সাথে খুব গভীর না হলেও হাই-হ্যালো সম্পর্ক ছিল৷ যার কারনে সাংবাদিক আফতাব ভাইকে চিনতাম৷

এরপর পেশাগত কারনে প্রায় পঁচিশ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকার কারনে নতুন জেনারেশন এমনকি পাড়ার ছেলেরাও আমাকে মনে করতো ভাড়াটে৷ হয়ে গেলাম ছিন্নমূল৷

এই দীর্ঘসময়ে বাহিরে থাকলেও অবসরে লেখালেখিটা চালিয়ে গিয়েছি৷ হয়তো প্রকাশিত হয়নি৷ তবে ল্যাপটপে সংরক্ষণ করতাম৷

বাসার পাশেই নর্থ ব্রিজ নামে একটা আধুনিক স্কুল প্রতিষ্ঠার সংবাদ শুনে আমাদের ছেলে-মেয়েকে সেখানে ভর্তি করাই৷ ওখানেই পরিচয় ঘটে জাকির ভাই ও আদিল ভাইয়ের সাথে৷ তাঁরা দু’জনে শহরের পরিচিত লেখক৷ ওঁদের অনুরোধে আমি আমার লেখাগুলো পাতাপ্রকাশে পাঠালে নিয়মিত জমিয়ে রাখা কবিতা, ছড়া, গল্প লেখাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে৷ উপলদ্ধি হয় প্রযুক্তির সীমানাহীন অগ্রযাত্রা৷ এরপর মুগ্ধতা ডট কম, বায়ান্নর আলো, ফিরেদেখাসহ দেশে এবং ভারতের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা আর যৌথ কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়৷ বলা যায় পাতা প্রকাশের কল্যাণে আমার নতুন করে লেখক স্বত্ত্বা জেগে উঠে৷

এই সময়ে হঠাৎ করোনা’র প্রাদুর্ভাবে বাসা থেকে ভার্চুয়াল অফিস করবার অনুমতি আমাকে আরো বেশি সাহিত্য লেভেলে সংযুক্ত করবার পথ সুগম করে৷ এই সময়ে আমার সুযোগ হয় রংপুরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের কাছাকাছি আসবার৷ ফলে লেখক, সাংবাদিক আফতাব ভাইয়ের সাথে একটু সখ্যতা তৈরি হয়৷ দেখা হয়৷ কথা হয়৷ উপদেশ দেন৷ শুনি৷ ভালো লাগে৷ নিজেকে ভাঙ্গি৷ গড়তে থাকি নতুন করে৷

মনে পরে কবি ও প্রকাশক সাকিল মাসুদ ভাইয়ের ‘ফিরেদেখা’র আয়োজনে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সাহিত্য আসর অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে কেউ একজন আমাকে পরিচিত করে দিচ্ছিলেন৷ আফতাব ভাই ওনাকে থামিয়ে বললেন, “আমি ওকে চিনি৷ ওর লেখায় মৌলিকত্ব আছে৷” পরে আমাকে কাছে টেনে বললেন “তুমি লিখে যাও৷ ভালো-মন্দ সেটা পরে বিবেচনা করবে না৷ লিখতে লিখতেই একদিন আরো ভালো কিছু হবে৷ সেদিনের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো৷” আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল ওনার কথাগুলো৷ একটা ভালো লেখার জন্য এখন আমি প্রতিনিয়ত লিখি৷ স্বপ্ন হলো একটা ভালো লেখা যেন আফতাব ভাইকে দেখাতে পারি৷

আমি আপনার কথা রেখেছি৷ কিন্ত আপনি রাখলেন না৷ আফতাব ভাই লেখাগুলো পড়বেনতো? কার সাথে কিংবা কোন অভিমানে এমন করে হঠাৎ চলে গেলেন?

এখন কে বলবে, “তুমি লিখে যাও৷ ভালো-মন্দ সেটা পরে বিবেচনা করবে৷”

ওপাড়ে ভালো থাকুন আফতাব ভাই৷

(১৭ নভেম্বর আফতাব ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে)

(লেখক কর্তৃক আপলোডকৃত। অসম্পাদিত)

আফতাব ভাই লেখাগুলো পড়বেনতো? রবীন জাকারিয়া