ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ , ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রভাতফেরির গান

আজ সারাদিন সাম্যের উত্তেজনায় কেটেছে। আগামিকাল একুশে ফেব্রুয়ারি, সে জীবনে প্রথম ফুল দিতে যাবে শহিদ মিনারে। সাম্যর বয়স দশ। সে পড়ে বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। যদিও সে বদরগঞ্জে থাকে তবে এখন সে আছে রংপুর, তার নানাবাড়িতে। তখনও শহর ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি। সময়টা ১৯৮৩। সাম্যর নানাবাড়িটা একতলা হাফ বিল্ডিং। উপরে খাড়া টিনের ছাদ। মামা খালারা সবাই সৌখিন আর সাহিত্য সমজদার। সেজো মামার বইয়ের ঘর ছিল হাতের ডানে। কালো কাঠের বুকসেলফে শুধু বই আর বই। দরজা দিয়ে ঢুকতেই দরজার ওপরে সাজানো ছিলো কাটা হরিণের মাথা। তখনও বাড়িতে সাজিয়ে রাখা হতো হরিণের মাথা যতদিন না নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ছুটিতে নানাবাড়িতে এলে সারাদিন কাটে সাম্যর সেজো মামার বইঘরে। কত বই যে আছে! দস্যু বনহুর, কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা, পড়ে শেষ করার জো নাই। ছুটি হলেই সাম্য বায়না ধরে নানাবাড়ি যাবার জন্য। এবার বইপড়ার চেয়েও মজার ঘটনা ঘটতে চলছে। মামাবাড়ি থেকে সবাই শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাবে। সাম্যর মামা মুক্তিযোদ্ধা রাকিব মামা এবার নিজ উদ্যোগে পারিবারিকভাবে ফুল দিতে যাবেন শহিদ মিনারে। কয়েকদিন ধরেই চলছে তার প্রস্তুতি। ছোট খালা, বন্যা পিসি, বাবু মামা সারাদিন হারমনিয়ামে গান প্রাকটিস করছে। প্রভাতফেরি কী? মামাকে জিজ্ঞেস করায় মামা বললো সূর্য ওঠার আগেই ফুল দিতে যাওয়াকে বলে প্রভাতফেরি। মামা বললেন, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছিল সালাম, রফিক, বরকত ছাড়াও নাম না জানা আরও অনেকে। পৃথিবীতে আর কোনও জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। সেই ভাষা শহিদদের স্মরনে রচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে কত গান, কবিতা। সেসবকে ছাপিয়ে সবচেয়ে পরিচিত গান, যে গানের সুর সবাই জানে। 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি?

গানটি লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। মামা বলে জানিস, গাফফার চৌধুরী যখন গানটি লিখেন তখন তিনি নিজেও ছাত্র। সুর করেছেন আলতাফ মাহমুদ। গানের সুরটা শুনলেই কেমন কান্না পেত সাম্যর। আজ আরও বেশি করে কান্না পেল যখন সে শুনল, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী সেই সুরকার আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করেছে। সন্ধ্যা হতেই নানির কাছে বায়না আমাকে ভাত দাও, আমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। সকালে প্রভাতফেরিতে যাব। সবাই সাম্যর কান্ড দেখে হাসে। মামার ঘরে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকে সাম্য। ঘুম কি আর আসতে চায়। ছোট মামা বলেছে, ফুল চুরি হতে পারে। মামা বাগান করেছে বাড়ির সামনে। কত ধরনের ফুল সেখানে। গাঁদা, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী। বিকালে নানা বড় একটা ঝাঁঝরি দিয়ে পানি দেয় গাছগুলোর গোড়ায়। ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়ায় মৌমাছি। কসমসগুলো বড় দূর্বল, একটুতেই হেলে পরে বাতাসে। সেজো মামা খুঁটি দিয়ে গাছগুলোকে খাড়া করে দিয়েছে। বিকেলে বাগানে ঢুকলেই মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগে। হাত দিয়ে কসমসের রঙিন পাপড়িগুলো নাড়তে কী যে ভালো লাগে! সেই ফুলগুলো যদি আজ চুরি হয়ে যায়। আজ দুষ্টু ছেলেরা ফুল চুরি করতে বের হবে। সেই ফুল নিয়ে যাবে শহিদ মিনারে। ঘুম আসতে চায় না, ফুলদের কথা ভেবে। এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সাম্য! ঘুম ভাঙে নানীর ডাকে,এই সাম্য,এই সাম্য। কীরে যাবি না? ওঠ বাবা।সবাই তৈরী হয়ে বসে আছে। হুড়োহুড়ি করে তৈরী হয়ে বের হবার সময় মামা বললো, কীরে স্যান্ডেল পরে যাবি নাকি?

হ্যাঁ,স্যান্ডেল পরেই তো যাব। স্যান্ডেল ছাড়া আমাকে হাঁটতে দেখেছেন কখনও?

হা,হা, মা শোনও তোমার নাতি প্রভাতফেরিতে নাকি স্যান্ডেল পরে যাবে বলে মামা অট্টহাসিতে ফেটে পরে।

প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে যেতে হয় রে বোকা।শহিদদের সম্মানে পায়ে জুতা পরা হয় না। চল,দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে মামা বের হয়ে আসে।

ফুল বাগান পার হয়ে গেট। আড় চোখে বাগান দেখলো সাম্য। নাহ্,কোনও ফুল চুরি হয়নি। গেটের বাইরে জটলা করা পাড়ার সবাই। শ্যামল কাকার গলায় হারমোনিয়াম, ছোট খালা রেডি গান গাওয়া শুরু করার জন্য। সুমিত স্টোর পার হয়ে, রঞ্জন এক্সরেকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে প্রভাতফেরি। পথে আরও অনেক মিছিল। ছোট খালা,শ্যামল কাকার হারমনিয়ামের সাথে গান শুরু করে।ছোট্ট সাম্য আর সবার সাথে গলা মেলায়-

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী

আমি কি ভুলিতে পারি।।

ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু

গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।

আমার সোনার দেশের

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।’

প্রভাতফেরির গান

রবীন জাকারিয়া

২১ জানুয়ারি, ২০২৩ , ২:৫৪ অপরাহ্ণ

হাবিব মানেই বন্ধু নয়

প্রথম অধ্যায়

আমাদের স্কুলটা ছিল বেশ বড়ো৷ বিরাট খেলার মাঠ৷ বড়ো বড়ো ক্লাশরুম৷ চারিদিকে ফলের গাছ আর একদিকে একটা বিশাল পাইকর গাছ৷ এত বড়ো যে প্রায় পুরো মাঠটাকেই যেন ছায়ায় আচ্ছাদিত করেছে৷ কোনো সীমানা প্রাচীর নেই৷ সরকারি বাদে এতদাঞ্চলে যেহেতু বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় আর নেই তাই বহু দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে৷ আমার বাসাটা স্কুল সংলগ্ন এবং সত্যি বলতে কি আমার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাও অনেক সমৃদ্ধ৷ তাই কোনো সমস্যা হয়নি৷ কিন্ত ঐসব ছাত্রদের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রদের কষ্টটা বেশ চোখে পড়ে৷ সেই সকালে কিছু খেয়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা৷ বিকেল অবধি না খেয়ে আবার বাড়ি ফেরা চাট্টিখানি কথা নয়৷ শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছাড়া এটা অসম্ভব৷

তখনও শিক্ষার্থী তথা শিশুদের মধ্যে সামাজিক-আর্থিক বিভাজন রচিত হয়নি বলেই হয়তো আমাদের মতো সমাজের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা একই স্কুলে এবং একই সাথে পাঠগ্রহণ করেছি৷

তবে যতই সাম্যর কথা বলি না কেন! পরিবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, জীবনাচার এমনিতেই বিভাজন টেনে দেয় কিংবা বলা যায় শিক্ষকরাই ইনিয়ে বিনিয়ে তা অন্যদের বুঝিয়ে দেয়, “এরা তোদের প্রভু আর তোরা এদের ভৃত্য”৷

আমি খুব ডানপিটে আর মিশুক ছিলাম৷ তাই আমার বন্ধুও ছিল বেশি৷ অবশ্য ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলাম৷ তবে একজন ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু৷ ওর নাম হাবিব৷ যদিও হাবিব অর্থ বন্ধু৷

হাবিবের সাথে আমার বন্ধুত্বটা কিন্ত শত্রুতা দিয়ে শুরু৷ সেদিন স্কুলের পাশের বাড়ির গাছ থেকে আম চুরির প্ল্যান করছিলাম৷ চুরির সময় কে কী দায়িত্ব পালন করবে সেটা বোঝাচ্ছিলাম৷ সকলে রাজী৷ কিন্ত হাবিব বাধা দিলো৷ অন্যদেরকেও নিষেধ করল যেন এ সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে৷ ওর কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলাম৷ আজ পর্যন্ত কেউ আমার কথার অবাধ্য হয়নি৷ যা বলেছি তাই শুনতে বাধ্য হয়েছে৷ আমি হলাম দলনেতা৷ অথচ এই মলিন পোষাকে আচ্ছাদিত এক গেঁয়ো ছেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে? নিজের সামন্তবাদী কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়ল৷ রাগে-অপমানে অন্ধ হয়ে ওকে ভীষণভাবে মারলাম৷ ওর নাক ফেটে রক্ত ঝরছে৷ এটা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম৷ তাড়াতাড়ি ‘ফার্স্ট এইড’ বক্স নিয়ে এসে সকলে মিলে সেবা-শুশ্রূষা করলাম৷ সেদিন টিফিন পিরিয়ডটা এভাবেই কেটে গেল৷ আমার একদিকে প্রচণ্ড ভয় আর অন্যদিকে অপরাধবোধ জাগ্রত হলো৷

দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ক্লাশেই শ্রেণি শিক্ষক হাবিবকে প্রশ্ন কলেন কী করে হলো? সে বললো টিউবয়েলের হ্যান্ডেল লেগে ব্যাথা পেয়েছে৷ ওর উত্তরে আমি নীরবেই কেঁদে ফেললাম৷ ছুটির পর ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম ‘সরি’৷

এরপর থেকে ওর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা কাজ করত৷ ক্রমে ক্রমে তা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নেয়৷

টিফিন পিরিয়ডে আমি বাড়িতে ভাত খেয়ে আসি৷ ওকে বহুবার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারিনি৷ কেননা ওর আত্মমর্যাদা ছিল প্রখর৷ নিজের সীমাবদ্ধতাকে সে মিথ্যার চাদরে না ঢেকে বরং বীরের মতো গ্রহণ করেছে৷

এর কিছুদিন পর অষ্টম শ্রেণির রেজাল্ট প্রকাশ হলো৷ সবাইকে ডিঙিয়ে হাবিব প্রথম হলো আর আমি দ্বিতীয়৷ এই প্রথমবার আমি ক্লাশ পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলাম না৷ নবম শ্রেণিতে যথারীতি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম৷ হাবিবও তাই৷ বাহিরে যতই গভীর বন্ধুত্ব থাকনা কেন ভেতরে ভেতরে চলতে থাকল ওর সাথে আমার তীব্র প্রতিযোগিতা৷ কে কাকে ছেড়ে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে৷ আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিগুলো ছিল খুবই সমৃদ্ধ এবং বিশাল৷ তাই সেখানে গবেষণা করতে সমস্যা হতো না৷ মনে পরে বায়োলজির স্যার ব্যাঙের এনাটমি করার পর যখন আবার ব্যাঙের পেট সেলাই করে ছেড়ে দিত৷ তখন নিজেকে ডাক্তার ডাক্তার মনে হতো৷ অবসরে নিজে একাই ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙের বক্ষচ্ছেদ করতাম৷ এত প্রাচুর্য, বিলাসিতা, সুবিধা পাওয়ার পরও সত্য বলতে কি আমি কখনোই হাবিবকে টপকাতে পারিনি৷ দ্বিতীয় হয়েই থাকতে হয়েছে৷

মেট্রিক পরীক্ষায় হাবিব পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ বোর্ডে ষষ্ঠ স্টান্ড করেছিল আর আমি চারটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ অষ্টম৷

এরপর দু’জনে ভিন্ন ভিন্ন কলেজে ভর্তি হই৷ সম্ভবত এখানেই সূচনা হয় বিত্ত দিয়ে মানুষে মানুষে বিভাজন৷ এরপর ধীরে ধীরে হাবিবের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়৷ তখনতো মুঠোফোন ছিল না!

দ্বিতীয় অধ্যায়

বায়োগ্রাফি:-

বায়োগ্রাফি আমার পরিবার: আমার পিতা কলেজ ছাত্রাবস্থায় আওয়ামী ছাত্রলীগ করতেন৷ তাই ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ ৭০’র নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে, স্বাধীকারের পক্ষে কাজ করেন৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট পাবার পর তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তৈরি হন৷ এমতাবস্থায় আমার দাদা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন৷ যুদ্ধ শেষ হলে তাঁরা পুনরায় দেশে ফিরে আসেন৷

স্বাধীন দেশে নতুন কাঠামো, নতুন স্বপ্ন আর জীবন-জীবিকাকে নব উদ্যমে ঢেলে সাজাবার অবিরাম যাত্রা—বন্ধুর পথ—যেতে হবে বহুদূর৷ পাশাপাশি দেশের বীর সন্তানদের—যাঁদের আত্মত্যাগে আজ এই স্বাধীনতা৷ তাঁদেরকে দেওয়া হলো বীরত্বের সনদ৷ বাবার যেহেতু প্রশিক্ষণের সনদ ছিল তাই তিনি পেয়ে গেলেন “বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ”৷

এই একটি সনদ একটি পরিবারকে কীভাবে সম্মানিত করে, কীভাবে বদলিয়ে দিতে জীবন-জীবিকা৷ তা শুধু আমরাই জানি৷ এই সনদের জন্য বাবা সরকারি চাকুরি পেলেন৷ আমরা কোটা পেলাম৷ সেই কোটায় ভালো স্কুল/কলেজ পেলাম৷ সরকারি চাকুরি পেলাম৷ মাসিক মাসোহারাসহ বিশেষ উৎসব ভাতা পেলাম৷ আমাদের সন্তানেরা দাদার সনদের দাপটে ভালো স্কুল/কলেজ পেলো৷ সরকারি চাকুরিতে কোটা পেল৷ আমার মা আমৃত্যু মাসোহারা পাচ্ছেন৷ আরো কত কী!

বায়োগ্রাফি হাবিবের পরিবার: হাবিবের বাবা বামপন্থী রাজনীতিক ছিলেন৷ ডাকসাইটে না হলেও নিবেদিত কর্মী ছিলেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে পুঁজিবাদের এই নোংরা খেলা একদিন শেষ হবে৷ ভোগবাদী আর বিলাসী জীবনের মোহ ত্যাগ করে মানুষ একদিন ঠিকই উপলদ্ধি করবে শাশ্বত সত্য৷ বিশেষ করে প্রলেতারিয়েত বা মজদুর শ্রেণি৷ একদিন যখন দেখবে তাদের হাড্ডিচর্মসার দেহটা বাদে আর অবশিষ্ট নেই কিছুই৷ সেদিন বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী৷ মানুষ নিশ্চয়ই রচিত করবে এক সাম্যবাদী সমাজ৷

তিনি জানেন পাকিস্তানের দুই অংশের এ লড়াই হলো পুঁজিবাদের নোংরা কৌশল৷ মানুষের মর্যাদা, সমাজ, সম্পদ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার না থাকা৷ তথা  চাপিয়ে দেওয়া এক অসম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লব৷

তাই তিনি বসে থাকেননি৷ শুধু নিজে একাই নয় বরং সমমনা ব্যক্তিদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷ জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন৷ তিনি কোন সেক্টর কমান্ডার কী বলেছেন এটা না জেনে বরং “হয় স্বাধীনতা আনবো কিংবা জীবন দেবো” এই মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে যুদ্ধ করেছেন৷ দেশ স্বাধীন হলে তিনি নিজের সংসার, আয়-রোজগার এসব বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ কোনো সনদ পাবেন এমন চিন্তাই তাঁর ছিল না৷ বরং তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ জনকল্যাণমূলক কাজে দান করেন৷

তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন জাসদের আব্দুল জলিল৷ ১৯৮১ সালে যখন উনি সমাজতন্ত্রিক দর্শন ছেড়ে ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী হন৷ তিনিও ইসলামী মূল্যবোধে আকৃষ্ট হন এবং আরো বেশি বেশি জনহিতকর কাজ করতে থাকেন৷ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইয়াতীমখানা ইত্যাদি৷ এমনিভাবে একদিন তাঁর নিজের সম্পদ প্রায় শেষ হয়ে গেল৷ উপায়ান্তর না পেয়ে ঐ মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু চাকরি করেন৷ সেই সামান্য রোজগারে সন্তানদের মানুষ করেন৷ আর হাবিবদের হার না মানার জীবন সংগ্রাম শিখিয়ে দেন৷

তৃতীয় অধ্যায়

আমি এখন সচিবালয়ে কর্মরত আছি৷ ঢাকাতেই সেটলড৷ বাবা মারা গেছেন৷ মা আমার সাথে থাকেন না৷ তবে ঢাকাতেই থাকেন৷ আলাদা ফ্ল্যাটে৷ মুক্তিযোদ্ধার কোটায় মা একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন৷ বাবার মাসোহারাটা মা তোলেন৷ বেশ ভালোই আছেন৷ তাছাড়া এখনকার বৌমারা শাশুড়ির যে যত্ন নেয় তারচেয়ে সামর্থ থাকলে আলাদা থাকাই ভালো৷ অবশ্য মাসে মাসে আমি টাকা পাঠাই৷ ঢাকায় বর্তমানে আমার ১৪টি বাসা আছে৷ বিভিন্ন শপিং মলে গোটা দশেক দোকান আছে৷ এছাড়া আমাদের এক ছেলে৷ সে সস্ত্রীক থাকে আমেরিকায়৷ আর মেয়ে স্বামীসহ থাকে কানাডায়৷ মাশাআল্লাহ্ ওখানেও দুটি করে চারটি বাড়ি করেছি৷ রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকি৷ ভাবছি অবসরের পর প্রবাসেই বাকী জীবন কাটাব৷

হয়তো মন সায় দেবে না৷ তবুও এদেশে কি আর থাকা যায়? মানুষ এত সহিংস আর অসৎ হয়ে গেছে ভাবতেই খারাপ লাগে!

পেপার খুললেই খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, দুর্নীতি ভাল্লাগে? ক’দিন আগে দেখলাম ওয়াসার এমডি’র নাকি বিদেশে ১৪টি বাড়ি৷ ভাবা যায়! এত অসৎ হয় কী করে মানুষ? আরে বাবা চুরিরওতো একটা লিমিট আছে!

আজ ব্যক্তিগত বিশেষ একটা কাজে রংপুরে যাচ্ছি৷ ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে আছি তো আছি! বিমান লেট৷ ডমেস্টিক বিমান৷ ৫০ মিনিটের পথ৷ তোর আবার কীসের লেট? রাবিশ! দেশটা শেষ করে দিলো কিছু অসভ্যরা৷ এদের না আছে কমিটমেন্ট, না আছে দেশপ্রেম৷

অবশেষে দু’ঘন্টা পর সৈয়দপুরে নামলাম৷ গেট পেরিয়ে সামনে ট্যাক্সি, উবার খোঁজ করেও ব্যর্থ হলাম৷ গাড়ি না আনতে বলাটা ভুলই করেছি৷ একটা মাইক্রো পেলাম৷ এসি নেই৷ গাদাগাদি মানুষ৷ ১২জন না হলে ছাড়বে না৷ জনপ্রতি ৫০০/- টাকা৷ আরে ব্যাটা এই খোঁয়াড়ে ১২ জন বসবে কোথায়? নাহ্ দেশটা শেষ হয়ে গেল৷ সবাই ধান্ধাবাজ!

ঠিক করলাম এভাবে যেতে পারব না৷ তারচেয়ে একটা অটোরিক্সা রিজার্ভ করলে তো হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যায়! এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বেড়িয়ে একটা টিস্টলে এককাপ চা আর সিগারেট খেতে খেতে অটোরিক্সা রিজার্ভ করে রওয়ানা দিলাম৷ লাগেজ তেমন কিছু নেই একটা একটা ট্রলি ব্যাগ আর এটাচি৷ মাঝবয়সি অটোচালক যাত্রা শুরু করলো৷ চারিদিক থেকে হাওয়া যেন ক্লান্ত শরীর মনকে শীতল করে দিলো৷ ঘুম ঘুম ভাব আসছে৷ দূর করার জন্য চালকের সাথে গল্প করতে চেষ্টা করলাম৷ কিন্ত চালক বেশ স্মার্ট উত্তরে আমাকে আশাহত করল৷ সে বলল আমরা হাইওয়ে পথ চলছি তাই কথা বলে আমার এটেইনশন নষ্ট করবেন না দয়া করে৷ অগত্যা চুপ করে গেলাম৷

এক-দেড় ঘন্টা পর আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে অটো বিদায় দিলাম৷ প্রচন্ড ক্লান্তির কারণে রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম৷

ঘুম ভাঙল বিকেলে৷ সতেজ শরীরে এক কাপ ব্ল্যাক কফি আর একটা লেক্সাস বিস্কুটে বিকেলের নাস্তা সারলাম৷ ঠোঁটে একটা সিগারেট লাগিয়ে ডেস্কে বসে পড়লাম৷ যে জন্য আসা এখন সেই কাজটা শেষ করতে হবে৷ বেডের পাশে গেলাম এটাচীটা আনতে৷ কিন্ত একী! এটাচী কোথায়? মাথা ঘুরতে লাগল! ভয়ানক বিপদ৷ সর্বনাশ হয়ে যাবে! নিজের চাকরির৷ ক্যারিয়ারের৷ এ টাকা দিতে হবে মন্ত্রীর শ্যালককে৷ বিশাল এমাউন্টের একটি ঠিকাদারি কাজের ৩%৷ অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকা৷ যা ঐ এটাচিতে আছে৷ এখন কী হবে? ঐ হারামজাদা অটোচালক চুরি করেছে৷ ওকে এখন কোথায় পাব? তাছাড়া এটা পুলিশকে জানানো যাবে না৷ এটা অবৈধ টাকা৷ মাথা আউলায় যাচ্ছে! বমি বমি লাগছে! আচ্ছা আমার কি হার্ট এটাক করছে? আমি কি মরে যাচ্ছি? হায় আল্লাহ্ আমি এত অসৎ কাজ, অপরাধ করে শেষে জাহান্নামী হয়ে মরছি! এত সম্পদ, এত টাকা কিছুইতো কাজে লাগবে না৷ হে আল্লাহ্ তুমি মাফ করো৷ সেই ছেলেবেলায় শেখা দু’চারটি সুরা যেগুলো এখনো মুখস্থ আছে কাঁদতে কাঁদতে সেগুলোই পড়তে থাকলাম৷

দরজায় কলিং বেলের অনবরত কর্কশ শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম৷ দরজা খুললাম৷ দেখলাম এক মলিন অথচ দৃঢ়চেতা অপরিচিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে৷ কর্কশ গলায় বললাম কী চাই? সাহায্য-টাহায্য হবে না যান৷ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল-

আপনি কি আকবর সাহেব? আপনি কি আজ সৈয়দপুর থেকে এসেছেন? আপনি কি কোনো কিছু হারিয়ে ফেলেছেন?

সম্মতি সূচক মাথা নাড়া দেখে বলল,  তাহলে এই নিন বলে এটাচিটা আমার হাতে তুলে দিলো৷ আমি স্তম্ভিত! মুখ দিয়ে কিছু বেরুচ্ছিল না৷ অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, তুমি কি জানো এতে কী আছে?

সে বলল জানার ইচ্ছে না থাকার পরও শুধু ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে দেখেছি “প্রচুর টাকা” আর জীবন বৃত্তান্ত৷

এতো টাকা নিলেনা কেন?

উত্তরে বলল, কিছু মানুষের জন্ম হয়েছে শুধু নেওয়ার জন্য আর কিছু মানুষের দেবার জন্য, আমি দ্বিতীয় দলের।

কিছু মনে কোরো না তুমি কি একটু ভেতরে আসবে? সে ঢুকলে তাকে জোর করে বসালাম৷ তার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়চেতা আর সততার জন্য নিজে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও এই প্রথম একজন অতি সাধারণ মানুষ যে কিনা একটা সামান্য অটোচালক তাকে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললাম, তোমার সততার জন্য আমি পুরষ্কৃত করতে চাই৷ তুমি নিলে খুব খুশি হবো৷ তাছাড়া তোমার পরিবার, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগবে৷ সে প্রচণ্ডভাবে রেগে গেল৷ তারপর যা বলল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷

শুনুন মি. আকবর শিক্ষা আপনাদের আলোকিত না করে বরং নির্লজ্জ বানিয়েছে৷ আপনারা মানুষকে আন্ডারমাইন্ড করেন৷

আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার যোগ্যতা পরিমাপ না করে তাকে ভিক্ষুক মনে করছেন? আমার অটোটা আপনার বাবা কিনে দেয়নি যে তাকে তুমি সম্বোধন করবেন৷

দেশটা আপনার বাবার তালুক নয় আপনারা ইচ্ছেমতো বেচে দেবেন৷ আর পরিবারের এবং সন্তানের কথা বললেন না? আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি আমাদের ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার৷ আমাদের মেয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার৷ আর আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বোটানিতে মাস্টার্স করে আপনাদের মত ঘুষখোর লোকদের চাহিদা মেটাতে পারেনি বলে চাকরি পায়নি৷

আমার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিল৷ অথচ তাকে মরতে হয়েছে কীভাবে জানেন? তাঁকে জঙ্গী বানিয়ে হত্যা করে গুম করা হয়েছে৷ কী আজব তাই না? এখানে কার্ল মার্কসের নামে রাজনীতি করা যায়৷ এখানে মাও সেতুং, আব্রাহাম লিংকন, মুজিব, জিয়া, এরশাদ এমনকি মওদুদীর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যাবে৷ যাবে না শুধু মুহাম্মদের নামে৷ আমার বাবা যখন সমাজতন্ত্র করেছে তা করেছে তৎকালীন তার বিশ্বাস থেকে৷ আবার যখন ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক অধিকার বলে ইসলামী দল করেছে তখন পরিপূর্ণ ইসলামী মূল্যবোধ থেকেই৷ অথচ যে কি না জঙ্গীবাদ কিংবা রাজাকারদের ঘৃণা করত তাকেই মরতে হলো জঙ্গীর তকমা নিয়ে৷ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সনদ৷

আমি বললাম যদি সত্যিই তোমার সন্তানেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকে তাহলে তুমি এখনো অটো চালাও কেন? এতে তোমার সন্তান ডিগনিটি নষ্ট হচ্ছে না?

সে উত্তরে বললো, না আমাদের সন্তানদের আমরা সেভাবেই তৈরি করেছি৷ তারা প্রথমে মানুষ হয়েছে৷ তারপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার৷ ওরা ওদের কলিগসহ মিডিয়াতেও দৃঢ়ভাবে বলতে পারে আমাদের বাবা অটোচালক৷ কারণ এটা আমার আইডেনটিটি৷ আপনারা ইউরোপ-আমেরিকার সমাজের কথা বলেন না! তারা তাদের আইডেনটিটি অস্বীকার করে না৷ যাহোক আপনি ভালো থাকুন৷ ধন্যবাদ৷ বলে লোকটি চলে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ কী মনে করে গেটের কাছে একটু দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যভরা হাসি দিয়ে বলল আকবর তুমি জীবনে কোনোদিনই আমাকে টপকাতে পারলে না৷ আমি হাবিব৷ গুড বাই৷

আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাচ্ছিলাম হাবিব আমার শৈশবের হাবিব৷ আমার প্রিয় বন্ধু৷

ও হাতটা তুলে আমাকে থামিয়ে দিলো৷ বলল যারা শিক্ষিত হয়েও নিজের সততা নষ্ট করে, যারা সেবা প্রদানকারীর দায়িত্ব পেয়ে গণমানুষের অধিকার লুন্ঠন করে, যারা এত রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা বিকিয়ে দেয় ক’আনা পয়সায় তারা কখনোই কারো বন্ধু হতে না৷

আর মনে রাখবেন হাবিব মানেই বন্ধু নয়৷

হাবিব মানেই বন্ধু নয় - রবীন জাকারিয়া

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২২ অপরাহ্ণ

রাধাবল্লভ পাঠশালা

নানাবাড়ি থেকে রাজুর পাঠশালার দূরুত্ব পাঁচ মিনিটের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের বাম বরাবর কিছুদূর গিয়ে ডানে মোচড় নিলেই মোড়, সেই মোড়ে রমজান মামার দোকান। সেখানে বিক্রি হয় বিস্কুট, চকলেটসহ গৃহস্থালি জিনিস। তারপর বামের রাস্তার মোড়ে রাধাবল্লভ পাঠশালা। সকাল হলেই এক ঝক্কিঝামেলা। কিছুতেই স্কুলে যাবে না রাজু। অথচ এমন না যে স্কুলে খুব চাপ, স্যারেরা পড়ো রে বলেই ডুব দেয়। কে কী পড়ল সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নাই। তারপরও স্কুল যেতে হবে শুনলেই জ্বর, মাথাব্যথা।

অন্য দিগন্ত পড়া না পারলেও স্কুলকে না নেই। ঠিক নয়টায় হাজির রাজুর নানাবাড়িতে। দিগন্ত আসার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না রাজুর। নানি এসে বলে, ওঠ সোনা, দিগন্ত সেই কখন থেকে বসে আছে, যা পাঠশালায় যা, তোর নানা তোকে চারআনা পয়সা দিবে। পয়সার লোভেই হোক আর দিগন্তের সঙ্গ পাবার আশায়ই হোক রাজু স্কুলে রওনা দেয়। হাফ বিল্ডিং এর এই পাঠশালা শুরু হয় হেডস্যারের হাতের ঘন্টির শব্দে। পড়াশোনা বলতে একটু নামতা পড়া আর টিফিনে চালতা খাওয়া। হজমি খেয়ে পানি খেতে ভালো লাগত বলেই স্কুলকে একদম না বলা হয়নি রাজুর। স্কুলের সামনে রাজবাড়ি। সবাই বলত যাদু মিয়ার বাড়ি। তো সে কোন যাদু তা তো আর জানত না, জানার চেষ্টাও করেনি কখনও তারপরও বাড়িটা টানত তাকে। দিগন্তকে সাথে নিয়ে সুযোগ পেলেই রাজবাড়ির গেটে। বড় লোহার দরজা, সবসময়ই বন্ধ। সেখানে লোকজন থাকত কিন্তু কারা থাকত তা কখনই চোখে পড়েনি,আসলেই চোখে পড়েনি। এই যে কেউ বা কারা সেখানে বাস করে কিন্তু তাদের ঠিক দেখা যায় না, এটাই এক রহস্য মনে হতো। স্কুলের গেটে বিক্রি হতো কাঁচা খেজুর। সেসসবও যে পয়সা দিয়ে কিনে খাওয়া হতো একসময়, এখনকার ছেলেদের বললে বিশ্বাসই করবে না। এখন বার্গার, হটডগের স্বাদ পাওয়া শিশুদের হজমি, কাঁচা খেজুর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক।
আজ টিকা দিতে স্কুলে আসবে সরকারি লোকজন । আগে থেকে বলেনি স্যারেরা, বললে শতকরা  পঞ্চাশজন অনুপস্থিত থাকবে, এটা নিশ্চিত। প্রথম ক্লাস শেষ হয়ে দিগন্ত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে বাথরুম করার জন্য। প্রতিটি ক্লাস শেষে দিগন্তের বাথরুমের কথা বলে বাইরে যাওয়া রুটিন। ঠিক তখনি হেডস্যার সাথে স্কুলের অন্য শিক্ষকরা দুম করে ক্লাসরুমে উপস্থিত। জানলার গ্রিল ছিল না, দিগন্ত চট করে জানলা টপকে চলে যাবে বলে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল তখনি দপ্তরি নিখিল দা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। পালানোর পথ বন্ধ। বিড়বিড় করে কী যেন বলে লাইনে দাঁড়ায় সে ইশারায় কাছে ডাকে রাজুকেও। চিৎকার করে কান্না করার ইচ্ছেটা ঢোক গিলে দমন করে রাজু। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে লিসা তার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড়বড় করে, যদিও সে ভয় পেয়েছে বোঝা যায় তারপরও একদম ভেঙে পরেনি বোঝাই যায়। দিগন্ত ফিসফিস করে বলে আজ না আসলেই ভালো হতো, কেন যে আসলাম আর তোকেও নিয়ে আসলাম। ভয় পাস না। একটা পিঁপড়া কামড়ের মতো মনে হবে। এসব আমি জানি। চল আগা। তবুও টিকার সূঁচটার দিকে ঘুরেফিরে চোখ চলে যাচ্ছে।
ঠিকাদারের সামনে যখন সে দাঁড়িয়ে তখন রীতিমতো কাঁপছে রাজু।
তার কাঁপন দেখে হরেন স্যার বললো, আরে গাধা কাঁপিস ক্যান? তোকে পিঁপড়া কখনও কামড়ায় নাই? লিসার টিকা দেওয়া শেষ, সে তাকিয়ে আছে। শত  চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকিয়ে রাখা গেল না। ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো রাজু। টিকা শেষেও কান্না চলল যতটা না ব্যাথার কারণে তারচেয়েও বেশি লিসার সামনে কেঁদে ফেলার কারণে। বাড়ি ফেরার সারাটা পথ জুড়ে রাজু একটা কথাও বলল না। দিগন্ত লাল আইসক্রিম সাধল হজমি দিয়ে খাওয়ার জন্য, তাও খেল না সে। লিসার সাথে আগামীকাল কেমন করে এ মুখ দেখাবে সে চিন্তাতেই তার মন আরও খারাপ হতে শুরু করল।
লিসা থাকে রংপুর রেডিও সেন্টার স্টাফ কলোনিতে। বাম গালে টোল পড়া লিসার পাশে বসার জন্য ক্লাসের ছেলেদের প্রতিযোগিতা চলে।
দুপুরে রাজুর জ্বর এল শরীর কাঁপিয়ে।  নানি পাউরুটি আর দুধ নিয়ে সাধাসাধি করল বহুক্ষণ কিন্তু একদম খিদে নাই রাজুর। নানি বলত জ্বর আসলে বাঙালিকে খেতে হয় রুটি আর বিহারিদের  ভাত। দিগন্ত বিকালে এসেছিল, বলল মন খারাপ করিস না। কেঁদে ফেলেছিস তো কী হইছে। চল, জিনিস আনছি বলে চোখ টিপে দিলো। ম্যাজিশিয়ানের মতো পকেট থেকে বের করে দেখালো স্টার সিগারেট।
নাহ্ যাব না আজ বাইরে বলেও  কোনও জোরাজুরিই কাজে লাগল না। দিগন্ত প্রায় টেনে নিয়ে গেল বাইরে। নানাবাড়ির পূর্বদিকে লরেন্স ভাইদের বাসা। এখনও কমপ্লিট হয়নি। সেখানে বিকালে কেউ থাকে না, সেইসময় দিগন্ত সেখানে গিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে আসে। ইটের উপর বসে দুজনে সিগারেটে টান দেয়। একটু পরই দমকা কাশি আসে রাজুর, চোখে পানি চলে আসে কাশতে-কাশতে। দিগন্ত হাসতে থাকে রাজুর অবস্থা দেখে। নিয়মিত হওয়ার কারণে একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে ওর মাঝে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রুনু পিসি হারমোনিয়ামে গলা সাধতে বসেছে। দিগন্তের দিদিমা নিশ্চয়ই এ সময় জ্বালিয়েছে ধূপ। দুজনে বাড়ির দিকে রওনা দেয়, আগামীকাল স্কুলে যেতে হবে। লিসা কী আগামীকাল পাঠশালায় আসবে?

রাধাবল্লভ পাঠশালা

রবীন জাকারিয়া

১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ , ৩:২১ অপরাহ্ণ

বট গাছের ভূত

আমার বাড়ির চারদিকে মোট ছয়টি স্কুল৷ গাদাগাদি৷ ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ২টি উচ্চ বিদ্যালয়৷ উচ্চ বিদ্যালয় দুটির একটি বয়েজ অন্যটি গার্লস৷ আমার বোধগম্য হয় না যে সরকারের নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার নিয়ম থাকার পরেও এমন গাদাগাদি ছয়টি স্কুল কীভাবে অনুমোদন পেয়েছিল৷ এদেশে সবই সম্ভব৷ 

আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত মুনসীপাড়া কেরামতিয়া প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ উপমহাদেশের নামকরা ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিক ও পীর সাহেব মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ভারত থেকে এদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে৷ তিনি মুনসীপাড়ায় বিয়ে করেন এবং শশুর বাড়িতেই আমৃত্যু অবস্থান করেন৷ মুনসীপাড়া কেরামতিয়া জামে মসজিদ -যেখানে পীর সাহেবের সস্ত্রীক মাজার আছে-সেই কর্তৃপক্ষের অবদানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে এটি শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষা কেন্দ্র দিয়ে৷ পরবর্তীতে এটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়৷ তাই তাঁর নামানুসারে স্কুলটির নামকরন করা হয় কেরামতিয়া ৷ আর মসজিদ থেকে স্কুল পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ হয় মাদরাসা রোড৷ শুধু তাই নয় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে আবাসন ছিল৷ পরবর্তীতে সেখানেই নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হয় মুনসীপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ স্কুল দু’টি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন৷ কেরামতিয়া স্কুল সেসময় রংপুরের অন্যতম ভালো স্কুলের একটি ছিল৷ উপড়ে টিনের দোচালা পাকা লম্বা কাঠামো৷ প্রতি ক্ল্যাশের জন্য আলাদা আলাদা বড় বড় কক্ষ৷ একাডেমিক ভবন, ল্যাবরেটরি আর প্রধান শিক্ষকের বিল্ডিংটা ছিল ছাদ পেটানো৷ সামনে বিশাল মাঠ৷ চারিদিকে প্রাচীন ফলের গাছ৷ আম৷ জাম৷ লিচু৷ কাঁঠাল৷ কত কি৷ মাঠের দুদিকে দুটি অতি পুরাতন গাছ ছিল৷ একটি পাইকর গাছ কিন্ত সকলে বট গাছ বলত৷ অন্যটি ছিল লম্বা কদম গাছ৷ কদম গাছ এত বড় আর ডালপালা ছড়ায় তা কখনো দেখিনি৷ এ গাছ দুটিকে সকলে ভূতুরে বলত৷ এখানে নাকি ভূত আছে৷ গাছের কোঠরে বিষধর সাপের আবাসস্থল৷ 

কদম গাছটির ঠিক নিচে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক মৌলভী খেরাজ আলী অত্র এলাকার মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরি”৷ সে সময় এই লাইব্রেরি সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে৷ বিখ্যাত সব লোকেদের আনাগোনা আর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ এখানে বই পড়তে আসতেন রংপুর মুনসীপাড়ার পুত্রবধু, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নেতা শহিদ জননী জাহানারা ইমাম৷

স্কুলের কোনো প্রাচীর নেই৷ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তা৷ পুরো স্কুরের চারিদিকে প্রশস্ত ড্রেন যেন প্রাচীরের গুরুত্ব কমিয়েছে৷

কেরামতিয়া স্কুলের মাঠ রংপুরের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক ও খেলাধুলার কেন্দ্রবিন্দু সর্বদা৷ সব সময় মাঠে মানুষের আনাগোনা৷ কেউ খেলছে৷ কেউ নিজের গামছা পেতে রেডিওতে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিংবা কোন পথিক গাছের নিচে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷ নব উদ্যম তৈরির আশায়৷ প্রচণ্ড গরমকালে রাতের বেলাতেও নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা মাঠে হাঁটাহাঁটি করে৷

আমরা সব বন্ধু রাতের খাওয়া শেষে মাঠের এককোণে আড্ডা দেই৷ ধুমপান করি৷ কলেজে কোন মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ চলছে৷ কিংবা কাকে ভালো লাগে এইসব৷ চলে রাত ১২-১টা পর্যন্ত৷ স্কুলের নাইট গার্ডের নাম আবুল৷ সে সকলের কাছে পরিচিত আবুল ভাই নামে৷ ভীতু প্রকৃতির মানুষ৷ সহজ-সরল৷ আমরা আড্ডা মারলে সে খুশি হয়৷ গল্প করে৷ তার বেশির ভাগ গল্পই চাপা৷ ভূত-প্রেতের৷ সে বলতে থাকে এই বট গাছে প্রেতাত্মা থাকে৷ তাকে বহুদিন দেখা দিয়েছে৷ কথা বলেছে৷ সে যেন কখনো তার কথার অবাধ্য না হয়৷  কথামতো চললে তাকে সোনার ড্যাগ (হাঁড়ি) দেবে৷ গাছের গোড়ায় শাবল দিয়ে দুই চাপ মাটি তুললেই সে সোনা পাবে৷ আর বেয়াদবি করলে ঘাড় মটকাবে৷ আমি বললাম সোনাগুলো নিচ্ছ না কেন? সে বলল না! লোভ করা যাবে না৷ ও একদিন নিজে থেকেই দেবে৷ সেই আশাতে আছি৷ গাঁজাখুড়ি কাহিনি৷ কিন্ত মুখে বলি না৷ কী দরকার? বরং খুশি রাখলে ওকে দিয়ে সিগারেট আনার কাজটা করানো যায়৷ সেটাই ভাল৷ Win-win conditoin.

পাড়ায় আমাদের Immidiat senior ব্যাচটা খুব ভয়ংকর৷ গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি, নেশা করা, মাস্তানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যে করে না৷ এদের জন্য প্রায় সময় পাড়ায়-পাড়ায় মারামারি লেগে থাকত৷ বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ রেইড করত৷ অগত্যা আমাদেরকেও শহর ছেড়ে পালাতে হতো৷ বিশ্রী৷ কিন্ত কিছু বলা যাবে না৷ ওদের ব্যাচের একটা ভাই ছিল৷ নাম শরিফুল৷ কোরআনে হাফেজ৷ পাড়ার ছোট একটা মসজিদে ইমামতি করায়৷ সময় পেলে শরিফুল ভাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যাংটাকালের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে এটাই নিয়ম৷ কিন্ত ওর বন্ধুরা এতই খারাপ যে কোল্ড ড্রিংকসের নাম করে সুকৌশলে তাকে মদ খাওয়ায় দিত৷ তারপর ওকে একা ছেড়ে দিত৷ মদ খেলে মানুষ গালিগালাজ করে৷ বেশি কথা বলে৷ কিংবা বাড়িতে চলে যায়৷ কিন্ত শরিফুল ভাই মদ খেলে স্কুলে ছাদে কিংবা গাছের ডালে অথবা সারারাত ধরে ড্রেনে পানি ছেঁকত৷ 
প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম মাঠে৷ আবুল ভাই বানানো গল্প বলে যাচ্ছে৷ শুনছি৷ একটা সময় সবাই বাড়ি চলে গেল৷ শুধু আমি, আমার বন্ধু রবু আর আবুল ভাই রয়ে গেলাম৷ বিদ্যুৎ চলে গেছে৷ প্রচণ্ড গরমে ঘুম আসবে না বলে থেকে গেলাম৷ বিদ্যুৎ নেই৷ দোকান পাট বন্ধ৷ অমাবশ্যা কিংবা পূর্ণিমার হিসেব করা হয়নি কখনো৷ কিন্ত আজ খুব অন্ধকার৷ কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কোথাও কেউ নেই নেই৷ কখনো ভূত-প্রেত বিশ্বাস করিনি৷ তাই আবুল ভাইয়ের গল্পকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি৷ কিন্ত এখন ভয় করছে৷ কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়৷ আসলে হবে যেখানে অন্ধকার হয় সেখানে ভূতের ভয়৷ আমি নিশ্চিত মুখে যতই বলি না কেন৷ কোনো বাঁশবাগানে, অশ্বত্থ গাছ, পুরোনো বট গাছের নিচে নিকষ অন্ধকারে ভূতের ভয় পাবে না এমন লোক নেই৷ 
আবুল ভাইকে গল্প থামাতে বললাম রাগী গলায়৷ দূরে বটগাছটার নিচে যে ড্রেন আছে, সেখানে হালকা আলো প্রতিফলন হচ্ছে৷ সবকিছু আবছা আবছা৷ আমরা তিনজন চুপ! তাকিয়ে আছি বট গাছের দিকে৷ দেখলাম ড্রেনের পানি থেকে কী যেন একটা উঠে এল৷ বটগাছটার নিচে দাঁড়াল৷ প্রায় অদৃশ্য মূর্তিটার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু উপরের দিকে সাদাটে আভা৷ সেখান থেকে মাঝে মাঝে তারার মতো আলো চমকাচ্ছে৷ মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে৷ হার্ট বিট বেড়ে গেছে৷ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ অশরীরিটা হঠাৎ জড়ানো কন্ঠে হাঁক দিলো, “আবুল তোরা এদিকে আয়”৷ ভয়ে নিজেদের মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম৷ আর রক্ষে নেই৷ আবার আদেশ করা হলো, “কি রে এখনো আসলি না যে?”
আবুল ভাই ধপাস করে পড়ে গেল৷ কাঁপতে লাগল৷ মুখে ফ্যানা৷ ওরতো মৃগীরোগ আছে বলে জানতাম না৷ ও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ লুঙ্গি স্থানচ্যুত৷ ছিঃ নোংরা৷ শরীরটাও ভালো ভাবে পরিষ্কার করে না৷ মায়া লাগছে৷ ভয় লাগছে৷ হঠাৎ মনে হলো এ অবস্থায় মৃগীরোগিকে চামড়া পোড়া বা চামড়ার স্যান্ডেল নাকে শুঁকাতে হয়৷ সবার পায়ে স্পঞ্জ৷ চামড়া নেই৷ স্পঞ্জের স্যান্ডেলই নাকে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ পর ও ঠিক হলো৷ বললো তোরা যা৷ দেখা কর৷ বেয়াদবি করিস না৷ ঘাড় মটকাবে৷ আর শোন সাথে লোহা কিংবা দেশলাই রাখ৷ ক্ষতি করতে পারবে না৷ বললাম আমাদের ও দুটোর কোনোটাই নেই৷ তাহলে কী হবে? সে তার গোছা থেকে দুটি চাবি খুলে দুজনের হাতে দিয়ে বললো আল্লাহ্ ভরসা৷

শক্তহাতে চাবি হাতে আধমরা ভয়ে দুজন হাঁটতে থাকলাম অশরীরির দিকে৷ চাবি নিয়ে কেন জানি একটু সাহস পেলাম৷ কিন্ত রবু ভয়ে কাঁপতে থাকায় চাবিটা হারিয়ে ফেলল৷ কাছাকাছি প্রায় এসেছি৷ এমন সময় বন্ধু রবু চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল৷ কাটা কলাগাছের মতো৷ যেন ধুপ করে পড়ে চুপ৷ লুঙ্গিতে পেচ্ছাব করে দিয়েছে৷ আকারে ছোট্ট বন্ধুটি দিগম্বর হয়ে যেভাবে পড়ে আছে, যেন ছোট খোকা এইমাত্র বিছানায় হিসু করে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওর বুকটা নাড়লাম৷ কোনো শব্দ নেই৷ ভয়েই শেষে মরে গেল কি না? আচ্ছা রবুর ঘাড়টা মটকালো না-তো? বুক ঢিপ ঢিপ করছে৷ আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকলাম৷ বুকে ফুঁ দিলাম৷  যতটা দূরত্ব রেখে অশরীরির কাছাকাছি যাওয়া যায়৷ অশরীরি বলল, “এত রাতে তোরা এখানে কেন?” কী উত্তর দেব ভাবতেই মাথায় বিদ্যূত খেলে গেল৷ আরেকটু কাছে গেলাম৷ আবছা আলোয় দেখতে পেলাম সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি খুলে মাথায় বেঁধে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন৷ তার মাথায় বাঁধা পাঞ্জাবির বোতামে হালকা আলোর রিফ্লেকশন তারার মতো জ্বলছে৷ সাহস করে আরো একটু কাছে গিয়ে দেখলাম অশরীরি আর কেউ নয় আমাদের মাতাল শরিফুল ভাই৷

বট গাছের ভূত

রবীন জাকারিয়া

৭ জানুয়ারি, ২০২৩ , ১:৪৬ অপরাহ্ণ

মৌলভির চিঠি

আমার দাদু মৌলভি আলীম সরদার নামজাদা বামপন্থী পলিটিশিয়ান এবং সংস্কৃতি কর্মী৷ এলাকায় তাঁর প্রভার আর ক্ষমতা অকল্পনীয়৷ তাঁর কথাই শেষ কথা৷ বিচার, শালিস সবই তাঁর মর্জিতে৷ বরখেলাফ করলে কী ভয়াবহ ঘটনা কপালে জুটবে সেটা সকলের জানা৷ তাই কেউ টুশব্দটিও করে না৷ দাদু সমাজতান্ত্রিক দল করতেন৷ বলা যায় প্রভাবশালী নেতা৷ অন্যদিকে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর বিচরণ তাঁকে নিয়ে গেছে এলাকার শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে৷ স্থানীয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইয়াতিমখানা, মসজিদসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি৷ অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের জন্য নারী পুনর্বাসন সেন্টার নামে একটি আশ্রম আছে৷ অবশ্য সেই আশ্রমে কেন যেন প্রায়শঃই নির্যাতিত নারীরা আত্মহত্যা করে! দাদুকে এসব সামলাতে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়৷ তাছাড়া জনসেবা৷ এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া৷ তাই বাড়িতে সব সময় দর্শনার্থীদের ভীড়৷ 

আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল যে দাদুর নামের সামনে মৌলভি টাইটেলটা কেন? তিনিতো কোনোদিনও টুপি পাঞ্জাবি পরতেন না৷ এমনকি দাড়িও ছিল না৷ তিনি নিয়মিত নামাজও পড়তেন না৷ বরং ধর্মবিরোধী অবস্থান ছিল তাঁর৷ কিন্ত মৌলভি হলেন কেন? অনেক পরে জেনেছি যে ঐ সময় মুসলিম ব্যক্তিদের নামের সামনে মৌলভী লেখা হতো৷ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামেও মৌলভী টাইটেল ছিল৷

দাদু কঠোর চীনপন্থী সমাজন্ত্রী ছিলেন৷ তাই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও নিজ দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে নিরলস কাজ করেছেন৷

৭০ এর নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে ১৬২ আসনের মাঝে দুইটি আসনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হয়। একটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরেকটি ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জয়লাভ করেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও ময়মনসিংহে পিডিপির নুরুল আমিন।

এই দুজনের বিজয়ে দাদুর অবদান ছিল৷ তিনি তাদের নির্বাচনী প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করেছেন৷ 

এরপর দেশ স্বাধীন হলে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন৷ 

দাদু নিজে উচ্চ শিক্ষিত হলেও তাঁর কোনো সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি৷ বরং প্রত্যেকে হয়েছে একেকটা সুবিধাবাদী আর ক্ষমতালিপ্সু মানুষ৷ 

দাদু পলিটিকস বোধ হয় বেশ ভালই জানতেন৷ যার কারণে তিনি যেমন জীবদ্দশায় সর্বদা PGP (Present Government Party) করতেন৷ ঠিক তেমনি তাঁর সন্তানেরা৷

আমাদের বাড়িতে আলেয়া নামক এক বয়স্ক গৃহকর্মী থাকেন৷ মানসিক প্রতিবন্ধী৷ দাদুর যৌবনকাল থেকেই তিনি আছেন৷ আমি তাকে আলেয়া দাদি বলে ডাকি৷ দিদি বললে আমার নিজের দিদি রাগ করেন৷ তাই দাদি বলি৷ মাঝে মাঝে যখন ওনার মাথা ঠান্ডা বা ঠিক থাকে তখন গল্প বলেন৷ আদর করেন৷ বেশ উপভোগ করি৷ কিন্ত মাথা বিগড়ে গেলে তখন হাতে একটা কাগজ নিয়ে সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে থাকবে “এই দ্যাখ মৌলভি আমাকে চিঠি লিখেছে”৷ মৌলভীর চিঠি মানে তার স্বামীর প্রেমপত্র৷ এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে তার এই প্রেমপত্রের কথা জানে না৷ শুধু তাই নয় রাস্তা-ঘাট কিংবা মোড়ের রিক্সাচালক পর্যন্ত জানে৷ আমাদের সমাজে যা হয় পাগল দেখলে সহানুভূতির চেয়ে ক্ষেপাতে পারলে আনন্দ পাই৷ তার সাথে প্রতিদিন তাই ঘটত৷ দিনশেষে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ নিয়ে আলেয়া দাদি ঘরে বসে কাঁদতেন৷ আমার খারাপ লাগতো ভীষণ৷ কিন্ত কিছু করতে পারতাম না৷ আমিতো ছোট তাই৷

আমি একটা জিনিষ দেখে অবাক হতাম৷ দাদুকে নিয়ে যে যাই বলুক৷ কিন্ত মানুষটা আসলে মহান৷ না হলে একজন গৃহকর্মীর জন্য এত ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকে? যখন যা চাচ্ছে তাই এনে দেয়৷ কেউ বাধা দিলে বলে “পাগল মানুষ একটা আবদার করেছে দিয়ে দাও, আমরা বিনির্মাণ করবো এক সাম্যবাদি সমাজ৷ যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণি বৈষম্য”৷ দাদুর কথা কেউ ফেলতে পারে না৷ 

দিদিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম উনি কীভাবে পাগল হলেন? এমনকি ওনার একটা ছেলে সেও পাগল৷ বিষয়টা কী? দিদি বললেন যদিও তুই ছোট মানুষ সব বুঝবি না৷ তবুও বলি শোন্ আলেয়ার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক মৌলভির সাথে৷ পাশের মসজিদের খাদেম ছিল৷ এরপর ওর ছেলেটা পেটে আসে৷ এমন সময় ওর স্বামী ওকে রেখে পালিয়ে যায়৷ এই দুঃখে ও আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে৷ ও কোনো কিছু না বলে হঠাৎ হঠাৎ করে নিখোঁজ হতো৷ পেটে সন্তান অন্যদিকে এভাবে শরীরের উপর টর্চারের কারণে প্রসব জটিলতা সৃষ্টি হয়৷ উপায়ান্তর না থাকায় ডাক্তার সাত মাসেই তার বাচ্চাকে প্রসব করাতে বাধ্য হয়৷ অপ্রাপ্ত শিশু৷ বাঁচা মরা অবস্থা৷ মা পাগলি৷ ঠিকভাবে দুধ পায় না৷ মায়ের সঠিক যত্নের অভাব৷ সব মিলিয়ে দেখা গেল ছেলেটাও প্রতিবন্ধী৷ পাগল৷ একদিকে স্বামীর শোক৷ অন্যদিকে ছেলের এমন অবস্থা দেখে আলেয়া একেবারেই পাগলি হয়ে গেল৷

একদিন হঠাৎ করেই দীর্ঘ আয়ুর দাদু মারা গেলেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ১০২ বছর৷ বাড়িতে শোকের ছায়া৷ পরিবারের মাথার ছাতাটা ভেঙে গেল৷ সময় সব ক্ষত মুছে দেয়৷ জীবন নতুন করে সাজে৷ পরিবর্তন হয় নেতৃত্বে৷ এখন আমার বড় বাবা হলেন পরিবারের নেতা৷ তাঁর আনুগত্যে কারো অসন্তোষ নেই৷ আবারো সব কিছু ঠিক ঠাক৷ 

ক’দিন আগে বড়বাবা কিছু লেবার লাগিয়েছে দাদুর ঘরটাকে পরিস্কার করবে বলে৷ অপ্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, ফার্নিচার পুড়িয়ে ফেলে ঘরটাকে বসবাস উপযোগী করা হবে৷ লেবার-মিস্ত্রি বাড়িতে কাজ করলে আমার ভালো লাগে৷ আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখি৷ অনেক সময় পুরোনা কোনো খেলনা, মার্বেল কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়া পিচ দিয়ে বানানো নিজের হাতুরি দেখলে খুশি হই৷ ওগুলো আবার সংরক্ষণ করি৷ এমন সময় দেখলাম লাল কাপড়ে মোড়ানো একটা মোটা খাতা৷ আমি ওটাকে নিজের কাছে রাখলাম৷ ওটা আসলে ডায়েরি৷ দাদুর ডায়েরি৷ নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখলাম৷ রাতে পড়তে লাগলাম৷ মজা লাগছিল৷ দাদু কত স্মৃতিকথা লিখে রেখেছেন৷ যেন গল্পের বই৷ একটা নেশা চেপে বসল৷ প্রতিদিন রাতে একটু একটু করে পড়ি৷ কত অজানা আর ভয়ংকর কাহিনি জেনে গেলাম৷ তা বাড়ির কাউকে শেয়ার করলাম না৷

এর বেশ কিছুদিন পর একদিন ঝড়ের রাতে আলেয়া দাদি মারা গেলেন৷ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা দাদিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ বুকের উপরে রাখা একটি হাতে শক্ত করে ধরে আছেন এক টুকরো কাগজ৷ যেটাকে তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন স্বামীর প্রেমপত্র বা মৌলভির চিঠি হিসেবে৷ আর এই মৌলভির চিঠিটা আর কারো নয় বরং বিশ্বাসঘাতক আমার দাদুর৷

মৌলভির চিঠি

শাহেদুজ্জামান লিংকন

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০২ অপরাহ্ণ

সদৃশ

হবিউল্লাহ পর্ব

গলাটা খুসখুস করে শ্বাসে টান পড়ার পূর্বাভাস দেয়। স্পঞ্জে পানি ঢুকলে যেমন করে- বুকে; ফুসফুসের মধ্যে তেমন একটা শব্দের অনুভূতি। হবিউল্লাহ সচল ডান হাতটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে ইনহেলারটা খোঁজে। জায়গা মতো না পেয়ে ক্ষোভ ঝাড়ে তার স্ত্রীর উপর। হারামজাদী মাগি মোক মারি ফেলার জন্যে উঠিপড়ি নাগিছে। তোর কোন ইয়ার ভিতরত থুছিস। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে ঘরে নেই বলে গালটা দিয়ে কোনো মজা পায় না হবিউল্লাহ। তা না হলে আরো কিছুক্ষণ চলতো। মাথাটা কাত করতেই দেখতে পায় বিছানার এককোণে পড়ে আছে ইনহেলারটা। সেটা হবিউল্লাহর হাতের নাগালের বাইরে। তাও ভালো যে ডানপাশেই আছে। নিশ্চল শরীরটাকে বিছানা-সংলগ্ন খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে কাত করতে দু’হাতের উপর ভর দিয়ে পাছাটা ছেঁচরিয়ে কোনোমতে সফল হয় সে। বুকের মধ্যে বাঁশির মতো শব্দ হতে থাকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে ইনহেলারটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অস্থিতিস্থাপক হাতের তালু বিছানায় ঠেকিয়ে আঙ্গুলগুলোকে রাবারের মতো বাড়াতে চেষ্টা করে। এদিকে বুকের টানটা বাড়তে থাকে। ইনহেলারটা একসময় ধরা দেয়। পাফ নিলে কষ্টটা কমে।

হবিউল্লাহর স্ত্রী আছিয়া সালাম সর্দারের বাড়ি থেকে ফেরে হাতে একশো টাকার দশটা নোট নিয়ে। টাকাটা সর্দারের ছেলে রতনের হাতে পাঠিয়েছে তার মেয়ে জীবন্নেছা। ঘরে ফিরে দেখতে পায় হবিউল্লাহ খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে। আবারও উঠচেলো? হবিউল্লাহ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আছিয়ার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে গাল দেওয়া যাচ্ছে না তাই চোখ দু’টিই ভরসা। কিন্তু সে চোখে ক্রোধের পরিবর্তে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। স্বামীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে আছিয়া বলে, রতনের হাতোত একহাজার টাকা পাঠাইছে। চান রাইতোত আসপে। তোমার জন্যে বোলে সোন্দর একটা পাঞ্জাবী কিনছে। শেষোক্ত কথাটা বাড়িয়েই বলে আছিয়া। তবে একদিকে ভাবলে কথাটা মিথ্যে নয়। জীবন্নেছা বাড়ি ফিরলে বাবার জন্য পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য শাড়ি তো আনবেই। আছিয়া সবসময় চেষ্টা করে মেয়েকে হবিউল্লাহর ক্রুর সন্দেহ থেকে রক্ষা করতে । হবিউল্লাহ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে জীবন্নেছা এতো ঘন ঘন টাকা পাঠায়। এতো টাকা সে কোথায় পায়? তাই সে এমন একটা সন্দেহ করে বসে যা বাপ হয়ে মেয়ের প্রতি কেউ করে না। কথাটা মনে মনে সে রাখে না। ঝেড়ে শুনিয়ে দেয় আছিয়াকে।

–           ফির টাকা পাঠাইছে? 

–           হয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে আছিয়া।

–           কোটে পায় উয়া এতো টাকা? বেইশ্যাগিরি করে? হবিউল্লাহর কণ্ঠস্বর উঁচু হতে থাকে।

–           থুক্কু থুক্কু। তোমার আরো যতো কথা। গারমেন্টত চাকরি করে না জীবন্নেছা?

–           থো তোর চাকরি। আর মানুষ বুঝি গারমেন্টত চাকরি করে না। হারেছ না চাকরি করে গারমেন্টত। তা উয়ার বউ-ছাওয়ার টিকা শ্যাও ক্যা?

হবিউল্লাহকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে আসে আছিয়া। হবিউল্লাহ তখন আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে। তার দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারার কারণ যে তার মেয়ে জীবন্নেছা তা সে মেনে নিলেও মনে নিতে পারে না। মেয়ের উপার্জনের টাকায় কেনা চালের ভাত তার পেটপূর্তি করতে পারলেও মনপূর্তি করতে পারে না কোনোদিন। ভাতগুলো ধান হয়ে বুকের ভিতরে খচখচ করতে থাকে। একবার সে ভাবে- খাবে না মেয়ের উপার্জনের টাকা। কিন্তু নিমকহারাম উদর সে কথা মানতে চায় না। মেয়ের গীবত গাইতে গাইতেই সে একসময় বলে ওঠে, আনেক তো চাইরটা ভাত। প্যাটটা চো চো করেছোল।

হবিউল্লাহ প্রায়ই আছিয়াকে পরামর্শ দেয়- জীবন্নেছাক বাড়ি ডাকাও। বিয়া-শাদী দিয়া সোয়ামীর বাড়িত পাটে দে। আছিয়া বলে, বিয়াও দিলে খাইমেন কী? সোয়ামীর বাড়িত থাকলে কী আর হামাক টাকা-পাইসা দিবার পাইবে? মেয়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায় না আছিয়া। হবিউল্লাহ বলে, ভিক্ষা করি খামো। তেপথির মাথাত মোক শুতি থুয়া তুই ভিক্ষা চাবু। মোক দেকলে তো কতজনে ভিক্ষা দিবে। ভিক্ষার কথা শুনে জিহবা কাটে আছিয়া। থুক্কু থুক্কু কী কন এইল্লা। হামার চৌদ্দ গুষ্টিত কাও ভিক্ষা করে নাই। হবিউল্লাহ  তখন বলে, ওর জমিদারের বেটি তোর বেটির কামাই কি সারাজীবন খাবু? বিয়াও দিবু না? আছিয়া তখন হাসে। সেটা তকন দেখা যাইবে। না হয় দুইজনে বিষ খায়া মরমো। মৃত্যুর কথা শুনতেই কতোগুলো দৃশ্যপট ঘুরপাক খায় হবিউল্লাহর চোখের সামনে।

একাত্তরে যুদ্ধের সময় যখন পাকি বাহিনী হামলা করলো তাদের গায়ে তখন হবিউল্লাহরা বাড়ির সকলে আঙ্গিনায় বসে ভাত খাচ্ছিলো। হঠাৎ শুরু হলো গোলাগুলি। ছাৎ করে একটা গুলি হবিউল্লাহর কানের পাশ দিয়ে চলে গিয়ে ফুটো করে দিলো টিনের বেড়া। মাথাটা কাত না করলেই মরছিল সে। তারপর সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো।

আর একবার কী যেন একটা বিষয় চিন্তা করতে করতে সে হাঁটছিল বড় রাস্তা ধরে। সাথে ছিল নজু মিয়া। পিছনেই আসছিল একটা দানব ট্রাক। নজু মিয়া সেদিন টেনে না ধরলে ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে তার হাড়-হাড্ডি কিছুই খুঁজে পাওয়া যেতো না।

এরপর হবিউল্লাহর মনে পড়ে তিন বছর আগের ঘটনাটা। শামছুল মণ্ডলের বাড়িতে তখন কারেন্ট নেয়ার কাজ চলছিল। এ তল্লাটে শামছুল মণ্ডলের বাড়িতেই প্রথম বিদ্যুতের আগমন। শামছুল মণ্ডলের পক্ষে এটা ছিল মামুলি ব্যাপার। তারপরেও তার বাড়িতে কারেন্ট আসলো অনেক দেরিতে। লোকজন বলতো এটাও একটা চাল। শামছুল মণ্ডল বাড়ি পাকা করতে সময় নিয়েছিল এক বছর। একসাথে এতোগুলো টাকার উৎস কোথায় তা সম্বন্ধে যাতে কেউ সন্দেহ না করে তাই এমন উপায় অবলম্বন। শামছুল মণ্ডল চাকরি করতো জেলা প্রশাসকের অফিসে। অনেক ফাইল তার হাত দিয়ে পার হয়। আর ফাইল পার করার জন্য টেবিলের তল দিয়ে কিছু কচকচে নোট উড়ে এসে পড়ে তার পকেটে। কারো কাজ হয়, কারো হয় না। যাদের কাজ হয় না তারা টাকা ফেরত চাইলে ‘পরের বার হবে, আমি থাকতে চিন্তা কি’ বলার অজুহাতে সময় অতিবাহিত করে সে। একসময় ধার করে নেয়া কিংবা জমি-জমা বিক্রি করে দেওয়া টাকাটা পানিতে চলে গেলে সর্বশান্ত লোকগুলো সরকারের লোক শামছুল ম-লের সাথে পেরে ওঠে না। তখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু এলাকার লোকজনের কাছে ‘শোনা কথা’ ছাড়া কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকায় তলে তলে বাড়তে থাকে শামছুল মণ্ডলের প্রতিপত্তি ও প্রভাব।

উপজেলা সদর থেকে আসা মিস্ত্রি বিদ্যুতের লাইন ঠিক করছিল শামছুল মণ্ডলের বাড়িতে। গ্রামের উৎসুক ছেলে-মেয়েরা দল বাঁধিয়েছিল সেখানে। যেখানে একটা মোটরসাইকেল দেখলে সবাই পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করে সেখানে কারেন্ট আরেক বিস্ময়! বাচ্চাদের দলে মিশে গিয়েছিল হবিউল্লাহও। কারেন্টের মিস্ত্রি টেস্টার দিয়ে চেক করছিল বিদ্যুত আসছে কিনা। একসময় মিস্ত্রি নাস্তা করতে গেলে অতি উৎসাহী হবিউল্লাহ একটা তার ছুঁয়ে দেখতেই শক খেলো। তৎক্ষণাৎ ঝটকিয়ে হাত সরিয়ে নিলো সে। ওরে বাপো চিন্নিত করি উঠিলরে। পাশে বসে পেপার পড়ছিল শামছুল মণ্ডল। হবিউল্লাহর চিৎকার শুনে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো- হলো কী? পাশে থাকা অবোধ বালক-বালিকার দল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে নালিশ জানালো- ওমা হাত দিছলো। পাশে পড়ে থাকা একটা বাঁশের খুঁটা হবিউল্লাহর দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল শামছুল ম-ল। মরির আসছিস এটে কনা? মইরবার আর জাগা পাইস না? সেই খুঁটা ঘুরে ঘুরে এসে সরাসরি লাগলো হবিউল্লাহর পিঠে। ডানহাতে চেপে ধরা বাহাত সরিয়ে নিয়ে দু’হাতেই এবার সে চেপে ধরলো কোমর। ককিয়ে উঠলো সে। বসে পড়লো মাটিতে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। মরনু রে মুই মরনু। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত শামছুল মণ্ডল। তারপর হবিউল্লাহকে নিয়ে যাওয়া হলো উপজেলা সদর হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার সবকিছু শুনে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, রোগীকে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া লাগবে। শামছুল মণ্ডলের বেশ কিছু টাকা গচ্ছা গেল সেখানে। কিন্তু হবিউল্লাহর কোনো উন্নতি হলো না। শরীরের নিম্নাংশ অকেজো হয়ে গেল। আর হাঁপানী রোগটা তাকে উপহার দিয়ে গেছে পরলোকগত পিতা।

পিঠের সেই আঘাতের সাথে পায়ের কী সম্পর্ক তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি হবিউল্লাহ। মাঝে মাঝে সে ডাক্তারকেই গাল দিয়ে বসে, চ্যাটের ডাক্তার এইল্লা। খালি গরিব মাইনষার টাকাগুলা মারি খায়। কিন্তু ডাক্তার নয়, তার বেশির ভাগ টাকা গেছে কোর্ট-কাচারিতে। সমুন্ধির কথা শুনে সে কেস করেছিল শামছুল মণ্ডলের বিরুদ্ধে। কোর্টের টাকা যোগাতে ধানী জমিটুকু বেচে দিতে হয়েছিল। তারপর সেই টাকা তুলে দিয়েছিল সমুন্ধি ছাবের আলীর হাতে। ছাবের আলী তাকে আশ্বস্ত করেছিল- দুলাভাই চিন্তা করবেন না। শামছুল মণ্ডলক এবার দেখি ছাড়মো। শেষ পর্যন্ত শামছুল মণ্ডলের কিছুই করা গেল না। টাকা শেষ হয়ে গেলে ছাবের আলীরও আর দেখা মিললো না। সে যে তিন বছর থেকে বিছানায় পড়ে আছে একটাবারও যদি তাকে দেখতে আসে নিমকহারাম ছাবের আলী। হবিউল্লাহ ভাবে একবার যদি সে হেঁটে গিয়ে ধরতে পারতো ছাবের আলীর গলাটা। নিরুপায় হয়ে তাই সে প্রায়ই উড়ন্ত গাল ছুঁড়ে দেয় ছাবের আলীর উদ্দেশ্যে- চুদির ভাই মাইনষার পাছা মারা বুদ্ধি দিয়া বেড়ায়। অথচ ওইসব টাকা যদি সে নিজের চিকিৎসার পিছনে ব্যয় করতো তাহলে এতোদিনে দিব্যি ভালো হয়ে যেতো বলে তার বিশ্বাস।

সমুন্ধির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়তেই হবিউল্লাহর মনের আগুনে ঘি পড়ে । তার বড় তিন তিনটা মেয়ে যাদের সে বিয়ে দিয়েছে হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকায়, তারা বুড়ো বাপের কথা ভুলেই গেছে। এমন নিমকহারাম মেয়ের সে জন্মদাতা ভাবতেই একেকবার নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বসে হবিউল্লাহ। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তারা আর আসতেই চায় না। আসলেও বেশিক্ষণ থাকে না। কাজের অজুহাত দেখায়। হবিউল্লাহ তখন চেঁচিয়ে বলে, যা যা তোর ফির পোরধান মন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিং আছে। বাবার কথার অন্তর্নিহিত গুরুত্বের কথা ভেবে সময় নষ্ট না করে মেয়েরা ফিরে যায় প্রতিদিন পেটানো স্বামীর ঘরে। তখন ছোট মেয়ে জীবন্নেছাকে পূজা করতে ইচ্ছে হয় হবিউল্লাহর। জীবন্নেছাকে নিয়ে বিপরীতমুখী দুই ভাবনার  স্রোতকে এক করতে গিয়েও পারে না সে।

পুরনো এসব কথা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে আসে হবিউল্লাহর। পেটের ভিতরে খিদাটা চাড়া দিয়ে উঠলে সে হাঁক ছাড়ে- কোটে গেলুরে আছিয়া? তুই ওজা আছিস দেখি কি মোক খাবার দিবু না? আছিয়া ঘরে ফেরে আরো কিছুক্ষণ পর। আছিয়া এক জব্বর খবর নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনছেন? হবিউল্লাহ খেই খুঁজে পায় না। কীসের খবর জিজ্ঞাসা করলে আছিয়া জানায়- আইজ বিয়ানবেলা লেপটিন যাবার ধরিয়া শামছুল মণ্ডল বেলে উল্টি পড়ি গেছলো। তারপর থাকি হাত-পা নড়ের পায় না। একনা আগোত মাইক্রোত করি অংপুর নিয়া গেল। খবরটা শুনে হবিউল্লাহর মনটা খারাপ হলো না খুশি হলো তা স্বামীর  মুখ দেখে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না আছিয়া। আর সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আছিয়া স্বামীকে প্রশ্ন করে, তোমার কাছোত কেমন নাগিল খবরটা? হবিউল্লাহ নিজেও ঠিক তা ঠাহর করতে পারে না। তার চোখ দুটো পিটপিট করতে থাকে।   

জীবন্নেছা পর্ব

জীবন্নেছাকে ইদানীং একটা দুঃশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। জিতু ফ্যাব্রিকসের ম্যানেজার রবিন পনের লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা। এখন এসেছে নতুন ম্যানেজার। রবিন না থাকায় অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে আছে সে। অবশ্য গারমেন্টসের ইফতার মাহফিলে নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকার বলেছে, ঈদের আগে সবাই যাতে বেতন-বোনাস পায় সে ব্যবস্থা সে করবে। সে গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে তাই গরিবের দুঃখ বোঝে। যতোই দুঃখ বুঝুক নতুন ম্যানেজার, জীবন্নেছা আর আগের মতো নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না।  রবিন থাকাতে বেতন-বোনাস নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না তার। অন্য সবার কী হয় হোক জীবন্নেছার কোনো সমস্যা ছিল না রবিন থাকাতে।

বেতন-বোনাস ছাড়াও প্রতিমাসে একটা বাড়তি টাকা জুটতো। এর বিনিময়ে জীবন্নেছাকে যা করতে হতো তা তার কাছে এখন কিছুই মনে হয় না। শুধু প্রথমদিন একটু কষ্ট হয়েছিল। যেন শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। তারপর ফ্রি হয়ে গেলে সে রবিনের দুর্বলতাটা খুঁজে পায়। রবিনও কাপুরুষের মতো স্বগতোক্তি করতো, তোমাকে দেখলেই আমার পড়ে যায়। বলেই একটা হাসি দিতো রবিন। কিন্তু সে হাসিতে বিজয় নয় পরাজয়ের গ্লানিই স্পষ্ট হয়ে উঠতো। জীবন্নেছাও হাসির সাথে তাল দিতো। রবিন তখন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ভরসা করার মতো উত্তরের আশায় চোখ রাখতো জীবন্নেছার চোখে- হারবাল খাইলে মনে হয় ঠিক হবে। না? কিন্তু আশাব্যঞ্জক কোনো উত্তর পাওয়া যেতো না জীবন্নেছার কাছে। আমি কী জানি! খায়া দেখেন একবার। উঠতে উঠতে জীবন্নেছার গালটা টিপে দিয়ে রবিন বলতো, তুমি যে সেক্সি সেই জন্যে বুঝি এমন হয়। জীবন্নেছা লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলতো, যাঃ। রবিন তখন বলতো, তোমার মতো সুন্দরী আর সেক্সি মেয়ে এই গার্মেন্টসে ক্যান বাংলাদেশের আর কোনো গার্মেন্টসে যদি আরেকজন থাকে তাইলে আমি আমার কান কেটে কুত্তাকে খাওয়াবো। অতিরঞ্জিত করে কথা বলায় পটু সেই রবিন গারমেন্টসের পনের লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা। এখানে-সেখানে রবিনের ছবি সম্বলিত পোস্টার সেঁটে দিয়েছে গারমেন্টসের মালিক। ‘একে ধরিয়ে দিন। ধরিয়ে দিতে পারলে বিশেষ পুরষ্কার আছে।’ রবিন কেন এমন একটা কাজ করলো তা ভেবে পায় না জীবন্নেছা। বেতনও তো ভালো ছিল। একদিকে রবিন যেমন তার উঠতি সম্ভাবনাকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে গেছে নিজে, তেমনি জীবন্নেছার কল্পিত একটা ভবিষ্যতকেও গলা টিপে হত্যা করেছে। তবু জীবন্নেছার কাছে রবিন দেবতা। এখনো সে স্বপ্নে দেখে রবিনকে। একেকবার  সে ভাবে- রবিন যদি টাকাগুলো ফেরত দিয়ে গার্মেন্টসের মালিকের পা ধরে ক্ষমা চায় তাহলে রবিন ক্ষমা পেয়ে চাকরিটাও পায় আর জীবন্নেছার বুকের উপর থেকে একটা পাথরও সরে যায়।

নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকার সবার কাছে কাছে গিয়ে কাজের খোঁজ খবর নেয়। মেয়েরা প্রশংসা শুরু করে মিজানের। কী সুন্দর চেহারা! এক্কেবারে নায়কের মতোন। জীবন্নেছারও তাই মনে হয়। কোথায় যেন এমন একজন নায়ক দেখেছে সে। পরে টিভিতে ছেলেদের একটা ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখার সময় তার অনুমানটাকে মিলিয়ে নেয়। হাসিনা বলে, শাকিব খানের মতোন চেহারা। অন্যরাও তাতে সায় দেয়। কেউ একজন ‘তোর সাথে জোড়া মিলবে’ বললে জীবন্নেছা বলে, মাগি তোর ভাতার নাই তুই বিয়া বস। ‘তোর সাথে জোড়া মিলবে’ এই কথাটা নিয়ে রাতের বেলা অনেক ভাবে জীবন্নেছা। রবিন ও তার ব্যাপারে কিছু জানতো নাকি মেয়েগুলো? যদি জানে তাহলে তো মুখ বন্ধ করে থাকার মতো অতো মানসিক শক্তি ওদের নেই। কতোদিনে তা রাষ্ট্র হয়ে যেতো। এভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি প্রয়োগ করে সন্দেহের সমূহ সম্ভাবনাকে অসার প্রমাণ করে জীবন্নেছা।

জীবন্নেছা তার ব্লকে কাজ করছিল। তার কাজের পরিমাণ কম। এটাও রবিনের বদৌলতে। কাপড়ের ফিনিশিং দেখে সে। যেগুলোর ফিনিশিং ঠিক হয়নি সেগুলো আলাদা করে রাখে। ম্যানেজারের পিয়ন এসে বলে যায়, মিজান স্যার যাওয়ার সময় দেখা করতে বলছে। জীবন্নেছা রবিনের দেওয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে। এখনো একঘণ্টা বাকি আছে ডিউটির।

ডিউটি শেষে জীবন্নেছা ম্যানেজারের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। রুমের ভিতরে রুম। এসি আছে সে রুমে। কাঁচের দরজাটা একটু ঠেলে জীবন্নেছা প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করে, আসতে পারি স্যার। মিজান খন্দকার ল্যাপটপে টেপাটিপি করছিল। জীবন্নেছার মিহি কণ্ঠস্বর একবারেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। জী জী আসো। কণ্ঠটা শুনতেই খটকা লাগে জীবন্নেছার। একদম রবিনের মতো! রবিনও এভাবে দুইবার ‘জী জী’ বলতো। বসো। নির্দেশ শুনে সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ে জীবন্নেছা। মিজান খন্দকার হাতের আঙ্গুলের ইশারায় তার ডানপাশের চেয়ারটাতে বসার নির্দেশ দিলে জীবন্নেছা কিছুটা সংকোচবোধ করে। মিজান খন্দকারের দোদুল্যমান আঙ্গুলের সাথে নিজেও দোলাচলে দুলে অবশেষে ডান পাশের চেয়ারটাতেই বসতে বাধ্য হয় সে। জীবন্নেছা একবার চোখ তুলে নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকারের দিকে তাকায়। বুকের দুইটা বোতাম খোলা। বিজ্ঞাপনের সেই মডেলের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে সে। কাছ থেকে দেখতে ওরকম লাগছে না। হাসিনার কথাই ঠিক। শাকিব খানের মতো। পরক্ষণে ভাবে না শাকিব খানের বুক তো এতো চওড়া না। ইন্ডিয়ান নায়ক সালমান খানের মতো। মিজানের চোখের সাথে চোখ পড়তেই চোখটা নিচু করে সে। নতুন ম্যানেজার মৃদু হাসে। জীবন্নেছা  তার জীবনে দেখা হাসিগুলোর অভিধান থেকে এ হাসির অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে। সঠিক অর্থ খুঁজে পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না যখন একটা হাতের হাঁটার দৃশ্য সে দেখতে পায়। পিলপিল করে একটা হাত এগিয়ে আসে। হাতের গন্তব্য কোথায় স্থির তা খেয়াল না করে হাতটির দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতেই জীবন্নেছা দেখতে পায় এ হাত রবিনের! ঐ তো মধ্যমায় রবিনের সেই আংটিটা। কোথায় গেল বিজ্ঞাপনের মডেল, আর কোথায় গেল শাকিব খান কি সালমান খান এ যে সাক্ষাৎ রবিন! জীবন্নেছা চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় না। পাছে রবিন আবার চলে যায় জীতু ফ্যাব্রিক্স ছেড়ে। হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে পায় জীবন্নেছা। তাই সে অস্ফূট স্বরে বলে ওঠে, রবিন ভাই আপনি?!

সদৃশ

এটিএম মোর্শেদ

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০১ অপরাহ্ণ

ঝড়

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব ব্যস্ত ভাবে টাইয়ের নট বাঁধছিল রাইসুল। রিমি কোটটা হাতে নিয়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। রিমি ভেবেছিল হয় বুয়ার ছেলে এসেছে না হয় কোনো ভিক্ষুক, তাছাড়া এত সকালে কে আসবে? রিমি একটু জোরেই বলল দেখতো বুয়া কে এসেছে?

দরজার ওপাশ থেকে একজন বললো এক্সকিউজমি বাসায় কেউ আছেন? ভদ্রলোকের গলা শুনে রিমি নিজেই গিয়ে দেখতে পেলো এক যুবক অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যাকে সে আগে কখনও দেখেনি। কয়েক মুহুর্তের জন্য দুজনেই নিরব। যুবকটি প্রথম মুখ খুললো।

এখানে রাইসুল থাকে? আইমিন জার্নালিস্ট রাইসুল ইসলাম?

রিমি মুখে কোন কথা না বলে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দরজা চাপিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে আসে। রাইসুল তাকে বললো, কে এসেছে? রিমির জবাব, চিনি না দেখো গিয়ে কে এসেছে? রাইসুল দরজা খুলে চিৎকার করে বলে, আরে দিদার! তুমি কোত্থেকে এই সকালে, আর বাসার ঠিকানা কোথায় পেলে? একটা ফোন করলেও তো পারতে, এসো ভিতরে এসো। দিদার রাইসুলের পিছনে পিছনে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো তোমার মত ফেমাস সাংবাদিক এই ঢাকা শহরে ক’জন আছে যে বাসা খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে? আর ফোন করে এলে এমন সারপ্রাইজটা কি হতো? এদিক ওদিক তাকিয়ে দিদার বললো একটু আগে অপরূপা সুন্দরী এক মহিলাকে দেখলাম তাকে দেখছিনা যে, সে নিশ্চয় তোমার…… রাইসুল বলে, রিমির কথা বলছো? রিমি আমার ওয়াইফ। রাইসুল উচ্চ স্বরে ডাকলো রিমি এখানে এসো। রিমি ধীর পায়ে এসে রুমে ঢুকলো। রাইসুল দু’জনের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেয়। দিদার একটু দুষ্টুমি করে বলল সুখেই আছো বন্ধু, বাইরে নাম-যশ সাফল্য আর ঘরে অপরূপা সুন্দরী বউ। সারা পৃথিবী ঘুরেও আমার ভাগ্যে ওসব কিছুই জুটলো না। রাইসুল দিদারকে বলল, নিউইয়র্ক থেকে কবে দেশে এলে? উঠেছো কোথায়? দিদার বললো, গতকাল এসেছি। উঠেছি একটা হোটেলে। ঢাকায় আমার কিছু পার্সোনাল কাজ আছে। দু’তিন দিন সময় লাগবে, তারপর গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে মুম্বাই যাব। রাইসুল বললো, তা বেশতো হোটেলে না থেকে দু’তিন দিন সময় এখানেই থাকতে পার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাইসুল বললো আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে, আজ অনেক কাজ আছে, রাত বারটায় ফ্লাইট। দিনের মধ্যে কাজগুলো সারতে না পারলে খুব অসুবিধা হবে। দিদার বললো বারটায় ফ্লাইট মানে, তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ? রাইসুল বললো, পি.এম এর সফরসঙ্গী হয়ে তিন দিনের জন্য চীনে যাচ্ছি। দিদার বললো, তোমার ভাগ্য বটে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে বিদেশে সফর কজন সাংবাদিকের ভাগ্যে জোটে?

রাইসুল যাক ফিরে এসে বিস্তারিত কথা বলা যাবে আমি এখন আসি। দিদার বললো নিয়ম হলো তোমার ওয়াইফকে আপনি বলা এবং ভাবী সম্বোধন করা কিন্তু আমি ওসব পারবো না। রিমিকে রিমি বলেই ডাকবো। রাইসুল হেসে বললো, সে তোমার ইচ্ছে। তবে একটা কথা মাথায় রাখিও এটা নিউইয়র্ক নয়, বাংলাদেশ আর রিমি বাঙালি ললনা। রাইসুল বললো নো প্রবেলেম, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। তুমি এখন আসতে পার। রিমি ইশারায় রাইসুলকে ভিতরের রুমে ডাকে। কাছে যেতেই বললো, তুমি বাইরে যাচ্ছ, চেনা নাই জানা নাই অপরিচিত একজনের সামনে আমি সারাদিন ঘুরতে পারবো না। তুমি বরং ওকে বলে দাও তুমি যখন বাসায় থাকবে তখন আসতে। রাইসুল হেসে বললো এই কথা? দিদার খুব ভালো ছেলে, দেখবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার মনে হবে কতদিনের চেনা। দিদার খুব ভালো জোকস করতে পারে, দেখবে ও সারাক্ষণ তোমাকে হাসিয়ে মারবে। রিমির নাকে একটা টোকা দিয়ে বাই বলে রাইসুল চলে গেল।

রয়া এতক্ষণ বাথরুমে কাপড় কাঁচছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো, আফা লন আমি অহন যাইগা। ঐ বাসার মেম সাহেব যা খাঁইসটা, দেরি হইলে আমারে ছিড়্যা খাইবো। রিমি বললো, ছিঃ বুয়া ওভাবে বলে না। বুঝিয়ে বললে উনি নিশ্চয় রাগ করবেন না। তাছাড়া তোমার আজকে দুপুরে কোথাও যাওয়া হবে না। বাসায় মেহমান আছে, উনি দুপুরে খাবেন। অবশ্য আমি তোমাকে পান খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত একশত টাকা বখশিস দিবো। একশ টাকার কথা শুনে বুয়া আর কথা বাড়ালো না।

ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রিমি বুয়াকে বললো দেখতো মেহমান কী করছে? বুয়া পর্দা সরিয়ে এক নজর দেখে হাফাতে হাফাতে রিমির কাছে এসে বললো, মেহমানের মতে হয় মাথা খারাপ, রিমি বললো, কেন কী করেছে? বুয়া বললো, দ্যাখেন গিয়া জাইঙ্গা পইরা সামনে ইঠ-বস করতাছে। রিমি হেসে বললো মাথা খারাপ টাথা খারাপ ওসব কিছু না, উনি হয়তো ব্যায়াম করছেন। রিমি গিয়ে পর্দার একপাশ থেকে বললো দিদার ভাই, ডাইনিং এ আসেন চা দেওয়া হয়েছে? কিছুক্ষণ পর দিদার পোশাক পরে ডাইনিং এ চলে এসে বললো, এত খাবার? কতদিন এসব খাওয়া হয় না। রিমি তুমিও বসো। খেতে বসে দিদার বললো, জানো রিমি, গত ছয় বছর পূর্বে নিউইর্য়ক পাড়ি জমাই, জীবিকার সন্ধানে। অনেক স্বপ্ন অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছি প্রথম দিকে। অর্থকষ্ট থাকলেও পরবর্তীতে অর্থের কোন অভাব ছিল না। কিন্তু, জীবনে যাকে বলে সুখ, শান্তি ওসব কিছুই পাইনি। একটু সুখের জন্য ওদেশীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করলাম, ভেবেছিলাম ভিনদেশে একজন আপনজন পাবো কিন্তু ওটাই ছিল আমার জীবনের মস্ত বড় ভুল। বিয়ের পর তিন-চার মাস লিন্ডার সঙ্গে আমার আন্ডারস্টান্ডিং মোটামুটি থাকলেও পরবর্তীতে ও আমাকে পাত্তা না দিয়ে বয়ফেন্ড, অতিরিক্ত ড্রিংকিং, কোন কোন রাতে বাসায় না ফেরা এসব ওর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে আপত্তি করাটা ওর কাছে ছিল হাস্যকর ব্যাপার। বিয়ের এক বছর পর আমাদের একটা মেয়ে সন্তান হলো। ভেবেছিলাম এবার ও শান্ত হবে। সন্তানের বয়স ছয় মাস হলো। আমার শত আপত্তি থাকা সত্ত্বেও একি চাইল্ড কেয়ার হোমে রেখে দিল। স্নেহ, মমতা আমার অস্থিমজ্জায় থাকায় বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারলাম না। উপরন্ত ও আবার উশৃঙ্খল জীবন-যাপন শুরু করলো। একদিন গভীর রাতে ওর সঙ্গে প্রচন্ড ঝগড়া কথা কাটাকাটি হলো, আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে ওর দু’গালে দুটা চড় বসিয়ে দেই। পরদিন ও সেপারেশন চেয়ে আদালতে মামলা করলো। খুব সহজেই আমাদের সংসার ভেঙ্গে গেল। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু সন্তানটির সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার কোনো অধিকার থাকলো না। আমেরিকার মত দেশে অনেক বেপরোয়া জীবন যাপন করে জীবনটাকে উপভোগ করে থাকে জন্মগত ভাবেই মনে হয় আমি সে স্বভাবের ছিলাম না, তাই স্ত্রী সন্তানকে হারিয়ে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ি। কাজ-কর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখে যেকোন ভাবে আরও দুটি বছর কাটিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে এলাম। এখন কি করব? স্থির করতে পারছি না। রিমি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল এবার মুখ খুললো। তাহলে আমেরিকায় আর ফিরে যাচ্ছেন না? বেশতো, একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে এদেশেই সেটেল্ড হয়ে যান। চাইলে আমরা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবো। দিদার বললো, আবার বিয়ে! না না, বলে উঠে পড়লো। দিদার রিমিকে ডেকে বললো, আমি একটু বাইরে যাব তুমি দরজাটা লাগিয়ে দাও। দিদার বাইরে গেলে দরজা বন্ধ করে রিমি দিদারের কথাগুলো ভাবছিল। তার সরল স্বীকারোক্তি এবং দুঃখময় জীবনের কথা শুনে দিদারের প্রতি তার কেমন যেন একটা মায়া হলো এবং মায়া থেকে সৃষ্টি হলো বিশ্বস্ততা। কিছুক্ষণ পরে দিদার ফিরে এসে বললো রিমি তৈরী হও। ঘরে বসে না থেকে ঢাকা শহরটা একটু ঘুরে দেখি। বাইরে গেলে গাড়ি গেলে গাড়ি রেডি। রাত দশটা পর্যন্ত কনট্রাক্ট করেছি। আজ সারাদিন ঘুরবো, ফিরবো, বেড়াবো, গল্প করবো, রাতে ডিনার শেষে বাসায় ফিরব অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। রিমি কিছুক্ষণ ভেবে বললো দিদার ভাই, আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন আমি পনের বিশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আসছি।

খুব সাধারণ ভাবে সেজে দশ মিনিটের মধ্যেই রিমি নিচে এলো। দিদার বললো তোমার হয়ে গেছে, আমি তো ভেবেছিলাম কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগবে। রিমি গাড়িতে উঠে বসলে গাড়ি চলতে শুরু করলো। রিমির বুকটা হঠাৎ একটু কেপে উঠলো। দু’দিন আগেও যার সঙ্গে পরিচয় পর্যন্ত ছিল না অথচ কত নিশ্চিন্তে তার পাশে বসে অজানার উদ্দেশ্যে চলেছি। কত অদ্ভুদ সম্মেহনী শক্তি লোকটার। দিদার মনে হয় রিমির মনে ভাবটা বুঝতে পারে। রিমিকে চুপ চাপ দেখে বলে, কী অত ভাবছো ভয় নাই, আমার উপর ভরসা রাখতে পার। রিমি হেসে বলে, ভরসা না থাকলে কি আর আসতাম?

সারাদিন গাড়িতে করে সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরলো তারা। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পার্কে-রেষ্টুরেন্টে ঢুকে সময় কাটিয়েছে। সারাক্ষণ দিদার অনেক কথা বললেও রিমি তেমন কোন কথা বলেনি। দুপুরে লান্সের পর দিদার জিজ্ঞেস করেছিল, শুনেছি তোমাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হলো, কোন সন্তানাদি নাওনি কেন? রিমির সংক্ষিপ্ত জবাব, আমরা তো নিতেই চাই কিন্ত হচ্ছে না। দিদার এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ায়নি। তখন বিকেল চারটা। হাতে এখনও অনেক সময়। রিমি বললো দিদার ভাই, আর ভালো লাগছে না। চলুন বাসায় ফেরা যাক। দিদার ভাবলো এখন বাসায় গেলে রাতের খাবারের জন্য রিমিকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, তার চেয়ে ভালো হবে ডিনারটা বাইরে সেরে যাওয়া। তাই দিদার বললো, চলো ওয়ান্ডার ল্যান্ডটা ঘুরে আসি। দুজনে গাড়িতে উঠলো ওয়ান্ডার ল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।

কিছুটা শীতকাল হলেও হঠাৎ আকাশ খারাপ হয়ে আসছে। বৃষ্টি হতে পারে। রাত নটা নাগাদ তারা বাসায় ফিরলো। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর দুজনেই খুব ক্লান্ত। রিমি বললো, দিদার ভাই আপনি কিছু মনে না করলে আজ আর কোন কথা নয়, আমি খুব টায়ার্ড। এখন আমি ঘুমাবো। দিদার বললো, নিশ্চই, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি টিভিতে বিবিসি ওয়ল্ড নিউজটা একটু দেখবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিমি ঘুমিয়ে পড়ে। রাত এগারোটার দিকে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শরু হয়। বাতাসের ঝাপটা এসে জানালার পর্দাগুলো উড়াচ্ছে তার সাথে হিমশীতল বাতাস। দিদার রিমির ঘরে এসে দেখে সে ঠান্ডায় কুন্ডুলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। দিদার জানালাগুলো বন্ধ করে রিমির গায়ে একটা কম্বল টেনে দিল। কি মনে করে রিমির হাতটা ধরে কাছে নিল। দিদারও যন্ত্রের মত রিমির শরীরের পাশে এসে পড়লো। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুজনের অস্থিরতা বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে শরীরের উত্তাপও। বাহিরের ঝড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঘরেও ঝড় উঠলো। এক সময় ঝড় থেমে গেলে হঠাৎ রিমি আত্মস্থ হয়ে ঝট করে বিছানায় উঠে বসে। এই আকস্মিক ঝড়ের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। লজ্জায়, ঘৃণায় নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলো সে। ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো। বাইরে তখনও বৃষ্টি ও বাতাস চলছে। বাতাসের ঝাপটায় পানি এসে তার গায়ে পড়ছে। রিমি ভাবছে এই পানিতে যদি সব পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে যেত। এখন আমি রাইসুলকে মুখ দেখাবো কী করে? তার এত ভালোবাসা, এতো বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করলাম? না, বিশ্বাসঘাতক হয়ে তার সঙ্গে আমি অভিনয় করতে পারবো না। একটাই উপায় আছে। হ্যাঁ, আমি আত্মহত্যা করবো। পরক্ষণে মনে হলো আত্মহত্যা মহাপাপ, একটা পাক ঢাকতে গিয়ে আর একটা পাপ আমি করতে চাই না। তার চেয়ে এই পাপের শাস্তি যেন আল্লাহ আমাকে দেন এবং সেটা অবশ্যই মৃত্যু। রাতে মিমি আর এক মুহুর্তও ঘুমায়নি। এদিকে দিদারও আকস্মিক এমন ঘটনার জন্য লজ্জিত ও মর্মাহত। রিমির সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস তার নেই। উভয়ের লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিদার একটি চিরকুট লিলে ডাইনিং টেবিলে রেখে ভোর হওয়ার আগেই দরজা অটোলক করে বেরিয়ে যায়।

চিরকুটে লেখা, রিমি নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করবে না যে, আমি একটা অমানুষ আর বিশ্বাসঘাতক নই। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বা দেখানোর মতো মুখ আমার নেই। তাই পালিয়ে গেলাম। দুঃখ পাবে নাকি খুশি হবে জানি না। ডাক্তার বলেছে, এ পৃথিবীতে আমার আয়ু বড়জোড় আর এক বছর।

চিরকুটের শেষের লাইনটা পড়ে রিমি আঁতকে ওঠে। দিদার এইচ.আই.ভিতে আক্রান্ত? তাই যদি হয়, দিদারের পরিণতি তো আমাকেও বহন করতে হবে। রিমির মনের ভিতর থেকে কে যেন একজন বলে উঠে, ঠিক হয়েছে, তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক, পাপিষ্ঠার জন্য এমন পরিণতি হওয়াই উচিৎ।

ঝড়

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০১ অপরাহ্ণ

রেইনলিলি ও ঘাসফুল

মোবাইলটা হাত থেকে ফসকে নিচের দিকে না পড়ে উপরের দিকে উঠল প্রথমে। পরে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল। অমনি কমোডের উপর থেকে ড্রাইভ দিয়ে লাফিয়ে পড়ল নাহিদ। দুর্দান্ত একটা ক্যাচ লুফে নিল যেন। কিন্তু এই ক্যাচে কোন উইকেটের পতন ঘটল না । তবে এ যাত্রায় মোবাইলটা সেভ হলো আরকি। কিন্তু নাহিদের অবস্থা অনেকটা শোচনীয়। ডান হাতে এবং কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে বেশ ভালোই। আর ভেজা ফ্লোরে পড়েও পুরো শরীরও ভিজে গেছে। সবকিছুই এতই ডিজিটাল হয়েছে যে ওয়াশরুমে গিয়েও ডিজিটালাইজ কর্মকান্ড সম্পাদন করতে হয়। নাহিদ কমোডে বসে রেইনলিলি নামের ফেইসবুক আইডির সাথে চ্যাটিং করছিল। কমোডে বসে চ্যাটিং! বিষয়টা হাস্যকর হলেও প্রেম বলে কথা। আইডিটা ফেক না। ছদ্ধনাম ব্যবহার করা একটি মেয়ের আইডি নিশ্চিত হয়ে প্রেমে পড়ে নাহিদ। নাহিদ এর নিজের আইডিটাও অবশ্য ছদ্ধ নামে ব্যবহার করা। ওর আইডির নাম ঘাসফুল। রেইনলিলি ও ঘাসফুল আইডির সম্পর্ক এতই গভীর হয়েছে যে যখন তখন যে কোন মূহুর্তে চ্যাটিং-এ জড়িয়ে পড়ে তারা। রোমান্টিক রোমান্টিক সব বাক্যের ডালি যেন ঘুরে বেড়ায় দুজনের ইনবক্সে। আইডি ছদ্ধ নামে হলেও নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হওয়ার কারণে একে অপরের নামটাও জেনেছে তারা। প্রোফাইল পিকচারের মতো নামেরও মিল আছে তাদের। রেইনলিলির নাম নিনা। নাহিদ ওয়াশরুমে থেকে বেড়িয়ে অন্য একসেট পোশাক নিয়ে আবার ওয়াশরুমে ঢুকে।

রেইনলিলি ও ঘাসফুল এর বন্ধুত্ব হয় প্রায় ছয় মাস আগে। শুরুটা অবশ্য নাহিদই করেন। নাহিদ রেইনলিলি আইডিতে প্রোফাইল পিকচারে পিংক কালারের রেইনলিলি ফুলের ছবি দেখে কিছুটা চমকে উঠেছিল। তাঁর ঘাসফুল নামের আইডিতেও প্রোফাইল পিকচারে সেম কালারের ঘাসফুলের একটা ছবি আপলোড করা আছে। ফুলের জাত কিংবা গাছ আলাদা হলেও ফুল দুটি দেখতে একই রকম। কৌতুহল হয়ে রিকোয়েস্ট পাঠায় সে। কিন্তু রেইনলিলি সে রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করে ঝুলায় রাখে। এক সপ্তাহ পরে ইনবক্সে নক করে নাহিদ। নাহিদ লিখেছিল,

‘আপনার ফ্লওয়ার কত?’

‘অনেক। জুই,চামেলি,গোলাপ,বেলি,টগর,সন্ধ্যা মালতী, রজনীগন্ধ্যা—- আরও লিখব?’

‘সরি, লিখতে একটু ভুল হয়েছে। আসলে আপনার ফলোয়ার কত?’

‘৬১৩৪ জন। কিন্তু কেন? আমার ফলোয়ার কি আপনি কিনে নিবেন নাকি সরায় ফেলবেন?’

‘না, কিছুই করব না। শুধু বলব ঐ ৬১৩৪ জনের মধ্যে আমিও একজন। বন্ধু হতে না পেরে না হয় ঝুলেই থাকলাম। ফলোয়ার হয়ে থাকলাম তো।’

এটা দেখার পর রেইনলিলি একটা হাসির ইমো সেন্ড করে। ক্ষণিক পরে বন্ধুত্ব হওয়ার নোটিফিকেশনও চলে আসে। এরপর এই পথ চলা।

ইনবক্সে চ্যাটিং এর মধ্যেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। এরপর একে অপরকে বুঝে নেয় তারা। দুজনের বিভিন্ন বিষয়ে মিলও অনেক। মতেরও মিল অধিকাংশ সময় হয়। দুজন দুজনকে ভালো বুঝতে পারাটা প্রেমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তবে এই সম্পর্ক তৈরির কিছু শর্তাবলীও ছিল। ভয়েস কল, ভিডিও কল, ছবি শেয়ার করা,আরও ইত্যাদি ইত্যাদি শর্তাবলীর মধ্যে ছিল। সব শর্তাবলী খুব সহজে মেনে নিয়েছিল নাহিদ। যে কারণে কিছু শর্তাবলী মাঝে মাঝে শিতিল হয়ে যাচ্ছিল। যার মধ্যে তারা কোন কোন সপ্তাহে একবার করে ম্যাসেঞ্জারে ভয়েস কলে কথা বলে। কিন্তু ভিডিও কলের সুযোগ হয়নি কখনো। নাহিদ অবশ্য ভুল করে কখনো চেষ্টাও করেনি।

ওয়াশরুমে পড়ে যাওয়ার পর হাত আর কোমড় প্রচন্ড ব্যথা করছিল। যে কারণে পোশাক পরিবর্তন করে এসে পেইন কিলার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি ও। এক ঘুমে বিকাল। ঘুম ভাঙ্গলো তাও মায়ের ডাকে। সকালের ওয়াশরুমের দুর্ঘটনার কথা শুধু মা জেনেছে। যে কারণে ছেলের রুমে খবর নিতে আসা। মা অবশ্য আরও দুইবার এসে নাকি ফিরে গিয়েছে ছেলেকে ঘুমানো দেখে। এবার এসে আর না ডেকে পারল না। বিছানা থেকে উঠে অবশ্য অনেকটা ভালো লাগছে এখন। খুব সাবধানে আবার ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে মোবাইল হাতে নেয়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে রেইনলিলি হোয়াটসঅ্যাপে ৫বার এবং ম্যাসেঞ্জারে ৫ বার ভয়েস কল দিয়েছিল। দেখে যেন মাথায় হাত দেয় ও। এর পর দেখতে পায় রেইনলিলি’র লেখা। ও পরে লিখেছে,

‘এতবার কল দেওয়া দেখে পুনরায় ভয়েস কল দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। খুব খুশি হয়ে কল দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম না লিখে সরাসরিই বলি। যা হোক কোন কারণে হয়তো ধরতে পারোনি। অনলাইনে অর্ডার করা তোমার দেওয়া গিফট আমার হাতে এসে পৌঁছে্ছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

ইনবক্সে লেখাটা দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় নাহিদের।

গত ছয় মাসে কোনভাবেই কোন গিফট দিতে পারেনি রেইনলিলিকে মানে নিনাকে। কিভাবে পাঠাবে? ঠিকানা নেই। ঠিকানা চাওয়ার সাহসও দেখায় নি নাহিদ। সেদিন অনলাইনে একটা পিংক কালারের শাড়ি খুব পছন্দ হয় নাহিদের। শাড়ির ক্যাটালগ ডাউনলোড করে ইনবক্সে দিয়ে খুব রিকোয়েস্ট করে নাহিদ। নিনা রাজি হয়। পরে একটা মোবাইল নাম্বার এবং বসুন্ধরা গেট,ঢাকা লিখে ঠিকানা দেয়। তার সাথে লিখে দেয় এই ফোন নাম্বারে শুধু হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করা হয় এবং ঐ ফোনটি সবসময় ঘরে থাকে। কাজেই অফলাইনে এই নাম্বারে যোগাযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টা করিও না। এরপর এই ঠিকানা দিয়ে অনলাইনে বিল পেইড করে অর্ডার করে গত পরশু। আর আজকেই হাতে চলে গিয়েছে তার। নাহিদ আন্দাজ করতে পেরেছে বসুন্ধরার-ই কোন বøকে থাকে নিনা। নাহিদের ফ্লাটও তো বসুন্ধরা এ বøকেই। অতকিছু ভাবতে চাইল না ও। একদিন না একদিন দেখা তো হবেই। ফোন রেখে মাকে ডাকতে ডাকতে রুম থেকে বের হলো নাহিদ। মার কাছ থেকে চায়ের আবদার করল ও। মা চা এনে দিল ওকে। মা বলল, আজকে আর বাইরে বের হওয়ার কোন দরকার নেই। মায়ের কথা রাখতেই হলো। সচরাচর নাহিদ ছাদে যায় না কিন্তু চা খেয়ে ছাদে চলে এলো ও।

ছাদের উপরটা কারা যেন সবুজ করে ফেলেছে। বিভিন্ন ফলের গাছ। সবজির গাছ। অবাক হলো দুইটা কলা গাছও আছে। সে গাছে আবার কলাও ধরেছে। ছাদে উঠে অনেক ভালো লাগল ওর। হঠাৎ ছাদে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করল নাহিদ। ঘার ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে দেখে ছয় তলার ফ্লাটের মেয়েটি। যার সাথে নাহিদের প্রায়ই গেটে দেখা হয়। কিন্তু কখনো কথা বলা হয় নি। দেখেই চোখ সরিয়ে নেয় ও। চোখ সরিয়ে নেয়ার পরও মনে হলো কি যেন অবাক করার মত কিছু দেখেছে। বাধ্য হয়ে চোরের মত পূনরায় তাকানোর চেষ্টা করে। তাকিয়েই যেন অবাক হয়ে যায়। মেয়েটি শাড়ি পড়ে এসেছে। পিংক কালারের শাড়ি। শুধু পিংক কালারের না। এই শাড়িটাই সেই শাড়ি যে শাড়িটা ঘাসফুল রেইনলিলিকে অনলাইনে গিফট পাঠিয়েছিল।

রেইনলিলি ও ঘাসফুল

মাসুম মোরশেদ

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০১ অপরাহ্ণ

বাড়াবাড়ি

দু’ভাই। 

এক সংসার।

বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে বাড়ির ছোট বউ বুঝলেন তার বড় জা সংসারে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কারণ, তার তিনটি সন্তান। তাদের খাওয়া-পরা আর লেখাপড়ার পিছনে সংসারের অনেক টাকাই খরচ হয়ে যাচ্ছে।

ছোট বউ মানতে পারেন না সেসব। 

তার গা জ্বলে। 

সহ্য হয় না সেসব।

রাতে তার স্বামী বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় উঠলে বউ পান সাজিয়ে দিতে দিতে স্বামীকে বোঝালেন, “এই সংসারে আমরা ঠগছি।”

“কিভাবে?” জর্দাপান মুখে দিতে দিতে স্বামী জিজ্ঞেস করলেন।

“বোঝ নাই?” ছোট বউও জর্দাপান মুখে দিয়ে কসর কসর করে চিবাতে চিবাতে বললেন।

“না।” ছিলিমচিতে পানের পিক ফেলে দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বললেন। “বুঝাই কও।”

“শোন, বড় ভাই-ভাবির কয়টা বাচ্চা?”

“রহিম, করিম আর সখিনা…” গুনছেন তিনি।

“কয়টা হইল?” ছোট বউ জিজ্ঞেস করলেন।

“তিনটা।”

“আর তারা দুই মানুষ মিলে কতজন হইল?”

“পাঁচ জন।”

“ভাব, খেয়াল কর, একটু হিসেব কষ।” থেমে বললেন, “সেসবের পিছনে কত খরচ?” 

“হুমম, অ-নে-ক যায়…”

“আমাদের তো বাচ্চা নাই। আমরা ঠগছি না-কি?” ছোট বউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।

“হুমম। তাহলে?”

“আমাদেরও বাচ্চা দরকার।”

“আচ্ছা! আচ্ছা! না, আর ঠগাঠগি নাই। বাতি নেভাও। আসো। ”

কিছুদিন পর ছোট বউয়ের জমজ সন্তান হলো।

এখন,

বড় বউ তিন।

ছোট বউ দুই।

হলো, তিন ইস্টু দুই।

কিছুদিন যায়। 

তখনও ছোট বউ মানতে পারেন না। ভাবেন, তিনি ঠগছেন সংসারে।

তার গা জ্বলে। 

সহ্য হয় না সেসব।

বুকে নিমপাতা ঘষে ছোট বউ। সন্তান দু’টি আস্তে আস্তে বুকের দুধ ছাড়ে।

তার পর এক রাতে বিছানায় সুযোগ বুঝে ছোট বউ স্বামীর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলেন, “তাদের তিন। আমাদের দুই।” 

“মানে?”

“তাদের তিনটা বাচ্চা আর আমাদের দুইটা বাচ্চা। সমান হইল কি?”

“না।”

“তাহলে আমরা ঠগছি।”

“হয় হয়।”

“শোন, আমাদের আরও একটা বাচ্চা দরকার। তাহলে সমান সমান হবে। এই সংসারে সবার সমান অধিকার থাকবে, হিসাব বরাবর, না-কি?” 

স্বামীকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ছোট বউ আরও বললেন, “তিনি তার বড় জায়ের সমান হবেন।”

স্বামী তার স্ত্রীর কথা বুঝলেন। 

বললেন, আচ্ছা!

পরের বছর ছোট বউ আবারও জমজ সন্তান জন্ম দিলেন।

এখন,

বড় বউয়ের তিনটা।

ছোট বউয়ের চারটা।

হলো, তিন ইস্টু চার।

তার পর সংসারে চুলোচুলি বাড়ল।

রান্নার চুলা বাড়ল। তার পর বাড়ির মাঝ বরাবর প্রাচীর উঠল।

বাড়াবাড়ি

সোহানুর রহমান শাহীন

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০১ অপরাহ্ণ

স্বপ্নচারিনী

মেয়েটির চোখের পাতা যেন কিছুতেই নামছে না, কেমন মেয়ে গো বাবা! এমন ভাবে কেউ অপরিচিত কারো দিকে তাকিয়ে থাকে নাকি? কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নাহ, ঠিক তেমনভাবে মনেও পড়ছে না যে, কোথায় দেখা হয়েছিল তার সাথে! আজকালকার মেয়েদের স্বভাবেই মনে হয় এমন! আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিকের দিকে ধাবিত হচ্ছে আর ইচ্ছেগুলিকে লালন করছে একা একা। আচ্ছা, সে কি আমাকে চেনে? নাকি এমন ভাবে দেখে দেখে চিনবার চেষ্টা করছে যে, গত জন্মে পাখি হয়ে এসেছিলাম আর সেই পাখির লালনকর্তা ছিল এই মেয়েটি। মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উদাস হচ্ছে, যেন কতো কালের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সে।
অপরিচিত মানুষের এমন তাকিয়ে থাকা দেখে মাথাটা আরো ভনভন্ করতে থাকে রুদ্রের। রুদ্র, অবসরপ্রাপ্ত পিতার মধ্যবিত্ত পরিবারে মাস্টার্স করা বেকার ছেলে। চাকরি নামে হরিণের কস্তুরি খুঁজতে প্রতিনিয়ত ঢাকা যেতে হয় চিড়িয়াখানার টিকিট হাতে নিয়ে। নিরাশ হয়ে ফিরে আসে, আবার যায়, আবার…।

নিরাপত্তার জন্য বাসের চেয়ে ট্রেনে যাতায়ত করে বেশি, তাছাড়া ভাড়াও কম, এই আর কি। তবে বৃটিশ নিয়মের ভিতর আজো সময়কে বন্দি করে রেখেছে ট্রেন, অর্থাৎ দুই ঘণ্টা থেকে ট্রেনের অপেক্ষা। স্টেশনে ঝুলানো সময়সূচী মতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ছেড়ে যাবে ট্রেন কিন্তু রাত ন’টার কাঁটা ছুঁইছুঁই করছে ট্রেনের খবর নেই রংপুর স্টেশনে। প্লাটফার্মের পিলারের নিচে সানবাঁধানো গোল বেঞ্চে বসে আছে সেই মেয়েটি। এবার সে আরো গভীরভাবে তাকাতে শুরু করেছে। ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখার জন্য চোখে চোখ রাখতেই চোখ ফিরিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে যায় মেয়েটি। সেই সুযোগে দূর থেকে ভালো করে দেখে নেয় রুদ্র। নাহ্ তার পাশে তেমন কাউকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যারা আছেন, তারা কেউ আপন বলে মনে হলো না। যে যার মতো যাত্রী হয়ে আপন খেয়ালে অপেক্ষা করছে ট্রেন আসার জন্য। বাদাম বিক্রেতা এসে রুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়ি বলে-‘স্যার বাদাম খাইমেন?’ ‘না’, সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে সামনের দিকে এগিয়ে যায় বাদাম বিক্রেতা। হঠাৎ করে বসে থাকা মানুষগুলো আড়মোড় ভেঙে উঠে দাঁড়াতে উদ্যাত, মনে হয় ট্রেন আসার খবর হয়েছে। রুদ্র নিজেও মানুষিকভাবে প্রস্তুতি নিতে নিতে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন বাবাজি স্টেশনের প্লটফার্মে। অপেক্ষার প্রহর থেকে মুক্ত যাত্রীরা। গোল বেঞ্চের দিকে এগিয়ে এসে চোখ আটকে যায় রুদ্রের। আর দেখা যাচ্ছে না মেয়েটিকে, মনে হয় বগির দিকে চলে গেছে। যাক বাঁচা গেল।

ট্রেনে উঠে নিজ সিটে কার যেন হাতব্যাগ লক্ষ্য করে রুদ্র। কোনো নারীর ব্যাগ নিশ্চয়ই। পাশের সিটে বসে মাথা নিচু করে মোবাইল ফোনে কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে এক সুন্দরী মেয়ে। ‘ব্যাগ কার’, বাতাসে কথা ছুড়ে দিয়ে টিকিট হাতে রুদ্র আবার সিট নাম্বার মিলিয়ে নিশ্চিত হয়- এই সিটই হয়। কোনো সাড়া না পেয়ে আবার বলে- ‘ব্যাগ কার, এই সিটটা আমার’। মোবাইলের ভিতর থেকে আস্তে করে মাথা তুলতে তুলতে মেয়েটি বলে- ‘সরি, এটা আমার ব্যাগ’। ব্যাগটি নিজের আয়ত্বে নিয়ে আবার ডুবে যায় মোবাইল মোহনায়। মেয়েটি তার মাথা পুরোটা তুলতেই অবাক হয়ে যায় রুদ্র। আরে, এ তো সেই মেয়ে! যে আমাকে নিরলস ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো প্লাটফর্মে। কি যে আবিস্কার করলো আমাথেকে এখনো তো বুঝতে পারিনি। তার উপর পাশের সিটে সিট পড়েছো ট্রেনের। জানিনা আজ কপালে কি আছে। আরো কতো কি যে আবিস্কার করবে আমায় দেখে দেখে। কবি, নাকি চিত্রশিল্পী। আমাকে দেখে দেখে কবিতা লিখবে- নাকি ছবি আঁকবার পাঁয়তারা! আমায় দেখে যদি তার মনে এমন মন-ভাবনা জাগে তাহলে অনায়াসে সে পাগল, নয়তো এই লাইনে নতুন এসেছে। কারণ, তার আবিস্কারের জন্য মনে হয় আমার মতো বেকার বালক যথেষ্ট নই। সিগন্যালম্যানের সবুজ পতাকার ইশারায় ট্রেন ছেড়ে দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। লোহার চাকাগুলো রেল লাইনের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরতে শুরু করে। একটু একটু করে গতি বাড়ে, গতি বাড়তে বাড়তে দ্রুত চলতে থাকে ট্রেন।

‘হ্যালো বাবা। হ্যাঁ, বাবা তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছো না? বাবা এইমাত্র ট্রেন ছেড়েছে, আমি আসছি বাবা, না তেমন কোনো সমস্যা নেই, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। রাখছি বাবা, ট্রেন থেকে নেমে তোমাকে ফোন দেবো।’ মেয়েটি তার বাবার সাথেই ফোনে কথা বলেছে বলে মনে করে রুদ্র। ছুটে চলা ট্রেনের সাথে সাথে ছুটছে গাছপালা খাল-বিল, ফসলি জমি। যেন ট্রেনের সাথে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সব কিছুকে। ট্রেনের ভিতরে যার যার মতো আসনে বসে যাত্রীরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, কেউ পত্রিকা মেলে নিজেকে আড়াল করে নিজ মনে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে, আবার কেউ ঝিমোচ্ছে অভ্যাসের বসবর্তী হয়ে। কারো কোলের সন্তানকে আঁচলের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দুগ্ধপান করাচ্ছেন মা।
কাকে যেন ভালোবেসে প্রায়শ্চিত্বের অন্ধকার গিলে খাচ্ছে চাঁদ। সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। রুদ্রর পাশে বসে থাকা মেয়েটিও জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় বিচ্ছুরিত প্রকৃতির চলমান সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। তার ছেড়ে দেওয়া রেশমী দীঘল চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় নৃত্য করতে করতে রুদ্রর শরীর স্পর্শ করে। কথনো কখনো বেওয়ারিশ বাতাসে ওড়না উড়ে এসে ছুঁয়ে যায় মুখাবয়ব। রুদ্র এক প্রকার বিরক্ত বোধ করে। মেয়েটি জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে, রুদ্রের দিকে আড় চোখে তাকায় বারবার। অন্যমনস্ক রুদ্র বুঝতে পারে তাকেই দেখছে, কিছু বলে না, ধীরে ধীরে চিনবার চেষ্টা করে আবারো। হঠাৎ মেয়েটির হাত ফসকে মোবাইল ফোন পড়ে যায় সিটের নিচে। মোবাইল ফোন তুলতে নিচে ঝুঁকে পড়ে মেয়েটি। সিটের নিচে অস্পষ্ট আলোয় হাতড়াতে থাকে। মোবাইল ফোন খুঁজে না পেয়ে মাথা তোলে মেয়েটি, ইস্কুজমি, আমার মোবাইল ফোন হাত থেকে নিচে পড়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না, আপনার কাছে কি টর্চ হবে, অথবা এজাতীয় কিছু?’ মেয়েটির কণ্ঠে বেশ অনুযোগ। রুদ্র কোনো কথা না বলে মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মেয়েটির মোবাইল ফোন খুঁজে দেয় সিটের নিচ থেকে। ‘ধন্যবাদ’ বলে মোবাইল হাতে নিয়ে মেয়েটি ঝুঁকে পড়ে মোবাইলের স্ক্রীনে। বেশ কিছুক্ষণ পর মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সরাসরি রুদ্রকে প্রশ্ন করে বসে- ‘আপনি আজব মানুষ তো! সেই রংপুর স্টেশনের প্লাটফার্ম থেকে আপনাকে চিনবার চেষ্টা করছি, বারবার তাকাচ্ছিলাম আপনার চোখের দিকে অথচ কিছুতেই আপনার পরিচয় জানাতে আমাকে সাহায্য করছেন না’। হঠাৎ মেয়েটির এমন কথা শুনে হকচকিয়ে ওঠে রুদ্র।‘জ্বী, মানে, আমাকে বলছেন?’

‘জ্বী, আপনাকে বলছি। আপনি ছাড়া আমার পাশে আর কে আছে? দেখছেন না সামনের সিট দুটি খালি।’ চটপট জবাব দিয়ে আগের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মেয়েটি। রুদ্র পুরাই ‘থ’ হয়ে যায়। মেয়ে তো নয় যেন কাঁচালঙ্কা। তার পরও ভদ্রতার খাতিরে পরিচয়টুকু দেবার কথা ভাবে, ‘আমি রুদ্র, রংপুর শহরে থাকি, ঢাকায় যাচ্ছি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে। আপনি আমাকে চিনবার চেষ্টা করছেন! কেন, বলবেন কি?’

‘কেন আবার, মনে হলো কোথায় যেন দেখেছিলাম, তাই আবিস্কার করার চেষ্টা, এই আর কি। আবার কাকতলীয় ভাবে পাশাপাশি সিটও মিলে গেছে। কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পাচ্ছিনা। মেয়েটির কথা শুনে হতবাক রুদ্র- ‘আপনি বলবেন কি? আপনাকে কোথায় দেখেছিলাম? কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পাচ্ছিনা আর ভাবছিও না, যে কোথায় আমাকে দেখেছেন।’ কারণ আপনার ভাবনা আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ভাবতে থাবেন, আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারছি না। রুদ্র একটানা কথাগুলো বলে চাঁদের আলো দেখতে দৃষ্টি নিয়ে নিয়ে যায় জানালার বাইরে।

‘আপনি তো আজব লোক জনাব!

‘কেন? এবার সরাসারি মেয়েটির দিকে তাকায় রুদ্র।

‘কেন আবার, জানতেও চাইলেন না আমি কে, কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাবো, কি করি। আপনি জানতে না চাইলেও আমাকে বলতে হবে কারণ, আপনি যেহেতু আপনার পরিচয়টা বলেছেন। ‘আমি নিশীথা, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি, বাড়ি ঢাকাতেই, রংপুর এসেছিলাম আপার বাসায় বেড়াতে।’ নিজ থেকে কথাগুলো বলে রুদ্রকে।

মেয়েটির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে রুদ্র বলে- ‘আজ চলে যাচ্ছেন, তাই তো? আর কিছু বলার আছে আপনার?’

‘হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। দেখুন, পাশাপাশি সিটে বসে যেহেতু ঢাকা পর্যন্ত যেতে হবে, সেহেতু মাঝপথে ছোট্ট করে একটা বন্ধুত্ব করাই যায়, কী বলেন? জার্নি বাই ফ্রেন্ডস। তাছাড়া সেই সময়ের মধ্যে যদি আপনাকে চিনে ফেলতে পারি, তাহলে তো আরো ভালো। তাই নয় কী?’

মেয়েটি, অর্থাৎ নিশীথার কথা শুনে রুদ্রের মনে হলো- এতো করে যখন বলছে, তাছাড়া যদি বের করা যায় যে, নিশীথা সত্যিই কারো সাথে আমাকে মিলানো বৃথা চেষ্টা করছে। ‘আচ্ছা নী- মানে…’

‘নিশীথা, আপনি আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। বলুন কি বলতে চাইছেন।’

‘আসলে যদি খোলাখুলি ভাবে বলতেন- কার খোঁজে আমাকে রিমান্ডে নিলেন? কে সেই মহাপুরুষ, কি নাম তার, কোথায় থাকেন, কি করেন, কবে-কোথায় তাকে দেখেছেন, কিভাবে হারিয়ে ফেলেছেন, কথা হয়েছে কি না, কথা হলে- কি ধরনের কথা বলেছেন এবং কেন খুঁজতে চাইছেন তাকে। আচ্ছা, আপনি কি তার প্রেমে পড়েছিলেন?কেন বলুন তো’, প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নিশীথা। ‘না, বলতে চাইছিলাম আপনার সেই মানুষকে চিনছেন না কেন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, সেবার চট্টগ্রাম মামার বাসা থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আপনার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। কথা হয়েছিল, কতোভাবে আমাকে জেনে নিলেন, বগিতে আলো কম থাকার কারণে ঠিক মতো আপনাকে মনে রাখতে পারিনি, তবে কথা বলার ভঙ্গি, বাড়ি ঠিকানা, বেকার, চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন দিগি¦দিক, আপনার শহরে এলে দেখা করতে বলেছিলেন, আবার ঢাকায় আমার সাথে দেখা করার জন্য কথা দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য বসতঃ সেদিন আপনার নামটা আমার জানা হয়নি, তার আগেই তো ট্রেন লইনচ্যুত হয়ে আমাদের বগিসহ চারটি বগি উল্টে গিয়েছিল, সেই যে হারিয়ে গেলেন আর খোঁজ পেলাম না আপনার। সেই থেকে অনেক অনেক খুঁজেছি আপনাকে। দুর্ঘটনায় আপনার কিছু হলো কিনা তা জানার জন্য। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। আর আজ কাকতলীয় ভাবে পেয়ে গেলম আপনাকে। প্রকৃতির কি এক মায়ার খেলায় হারিয়ে যাবার আড়াই বছর পর আপনাকে পেলাম ষ্টেশনের প্লাটফার্মে। আবার একই ট্রেনে পাশাপাশি যাত্রী হয়ে ঢাকা যাচ্ছি। আপনি যাচ্ছেন চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে আর আমি যাচ্ছি বাসায়, কি অদ্ভুত ব্যাপার তাই না?’ রুদ্রের দিকে না তাকিয়ে খুব সহজ ভাবে ফিরিস্তি দিয়ে গেল নিশীথা, যেন হারিয়ে যাওয়া কতো আপন মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। তাকে কিভাবে বোঝাবো যে, তার গল্পের চরিত্রে এই রুদ্র ছিল না। তবুও পরিষ্কার করা দরকার। নিশিথাকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় রুদ্র। দেখুন আপনি কোথাও ভুল করছেন হয়তো। সেই ভুল থেকে ভুলভাল বলে যাচ্ছেন, তাও আবার আমাকে নিয়ে। আপনার নাম না জানা সেই মানুষ আসলে আমি নই। আমি তো আপনার সাথে কেন- কোনো নারীর সাথে একই ট্রেনে করে পাশাপাশি বসে যাত্রা করিনি। কখনো ট্রেন দুর্ঘটনায় পরিনি, আর সব চেয়ে বড় কথা হলো, আমার জীবনে আমি কখনো চট্টগ্রাম যাইনি। এবার বুঝতে পেরেছেন?

দেখুন আমার কোনো ভুল হচ্ছে না, ভুল আপনি করছেন রুদ্র, যে স্মৃতি আড়াই বছর থেকে বয়ে নিয়ে চলছি তা কেমন করে ভুল হয়। তাছাড়া আমি তো আপনার কাছে অধিকার নিয়ে আসিনি যে, আপনার সেই দিনের কথা মতো আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। আপনি বলেছিলেন সম্পর্ক করা যায় কিনা, আমি ভবতে চেয়েছি, ক্যাম্পাসে দেখা করতে চেয়েও দেখা করেননি। ট্রেন দুর্ঘটনার পর আপনাকে না দেখে ভেবেছিলাম…। তারপর অপেক্ষা করেছি, এই বুঝি পিছন থেকে কেউ নিশীথা বলে ডাক দিয়ে বলবে- আমি সেই, ট্রেনে পরিচয় হয়েছিল! কিন্ত না, আজ আপনি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসলেন! যাক, আপনাকে দেখলাম, আপনি বেঁচে আছেন, ভালো আছেন তাতেই আমি তৃপ্ত’। বলেই দু’হতে মুখ লুকিয়ে ফোঁপতে থাকে নিশীথা।

রুদ্র এবার বাকরুদ্ধ। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। হাসবে না কাঁদবে তারও হিসাব ঠিক মিলাতে পারে না। ‘নিশীথা, আপনি শান্ত হোন প্লীজ, আমি কথা দিচ্ছি ঢাকায় আমার চাকরিটা হয়ে গেলে নাম না জানা আপনার সেই লোকটিকে খুঁজে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। আমাকে নিয়ে অযথা ভুল ভাবনায় নিজেকে আর জড়াবেন না। আমি অত্যন্ত নিরীহ এবং অবসরপ্রাপ্ত বাবার বেকার ছেলে।’

কথাগুলো বলে জনালার বাইরে ছুড়ে দেয় আপন দৃষ্টি। চাঁদ ঢলতে শুরু করেছে তার ঝলকিত আলো বিলিয়ে দিয়ে। আগের মতো আলো আর দেখা যাচ্ছে না, বাইরের রূপ সৌন্দর্য ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে আসছে, বনভূমিতে নেমে আসতে চাইছে অন্ধকারের থাবা, ভোর হয়ে আসার পাঁয়তারা চালায় নির্ঘুম রাত। হালকা বাতাস ঢুকছে জানালা ভেদ করে, সেই বাতাস থেকে একটু একটু ঠাণ্ডা বোধ হতে থাকে রুদ্রের, তাই জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিশীথার দিকে তাকায়, এখনো ঠিক আগের মতো দু’হাতে মুখ ঢেকে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমার কথায় মনে হয় বেশি কষ্ট পেয়েছে মেয়েটি। হঠাৎ নিশীথার মোবাইল থেকে রিংটোন বেজে উঠে, তড়িঘড়ি করে সাইটব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রিসিভ করে, জড়ানো কণ্ঠে কথা বলার ধরণ শুনে মনে হলো, তার বাবা ফোন করেছে। হয়তো কোথায় আছে তার কুশলাদি জানার জন্যই ফোন করে থাকতে পারে। তবে পথ যে আর বেশি নেই জানালা খুলে বাইরে দেখে তার বাবাকে জানান দেওয়ার মাধ্যমে বুঝতে কষ্টহলো না। নিশীথা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ছুটে চলা ট্রেনের ভিতর ডালিম ফোটা ভোরের কুশমিত আলো ফেলেছে নতুন সূর্য। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনের গতি একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। আবারও হুইসেল। দীর্ঘ যাত্রা শেষ করে কমলাপুর রেল ষ্টেশনে প্রবেশ করে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি। ততক্ষণে আড়মোড় ভেঙেছে অনেক যাত্রী। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে নিশীথা। তার চোখ দুটি ফুলে উঠেছে, হয়তো রাত জেগে ট্রেনে জার্নি করার কারণে হতে পারে হয়তো, নয়তো ভুলের ভারে কেঁদেছে কিছু সময়।

রুদ্র প্রস্তুতি নিতে নিতে নিশীথা কোনো কথা না বলে কানে ফোন লাগিয়ে হন্ হন্ করে নেমে যায় ট্রেন থেকে। নিশীথার পিছু নিয়ে ষ্টেশনের প্লাটফার্মে নেমে আসে রুদ্র। ততক্ষণে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়েছে নিশীথা। রুদ্রকে দেখে রেগে যায়, বলে- আপনি, আপনি একটা স্বার্থপর মানুষ, মানুষকে মূল্যায়ন করতে জানেন না, এতোদিন পর দেখেও আমাকে সারাসরি অস্বীকার করেছেন। আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেননি উল্টো আমাকে টেনশনে রেখেছেন আড়াই বছর থেকে। বাবা, এই সেই ছেলে, ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে যাকে অনেক খুঁজেছি, এই ছেলেকেই খুঁজে দিতে বলেছিলাম তোমাকে। আজ ট্রেনে দেখা হবার পর সে বলছে, সে নাকি আমাকে চেনেই না’। নিশ্চুপ রুদ্রের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, ভদ্রলোকেই নিশীথার বাবা। মেয়ের কথা শুনে ভদ্রলোক মুখ খোলেন। ‘আপনি কে বাবা? কি হয়েছে নিশীথার সাথে, নিশীথা আমারই মেয়ে।’

‘আমি রুদ্র, রংপুর থেকে চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেছি, তাকে আমি কখনো দেখিনি কিংবা নাম পর্যন্ত জানতাম না, অথচ কার সাথে যেন বর্ণনায় মিলিয়ে আমাকে জড়ালেন, আমি খুবই বিব্রত বোধ করেছি’।

‘দেখেন বাবা, আমি সব বুঝতে পেরেছি, আপনার সাথে এমন করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। মেয়েটা আমার এমন ছিল না, পড়াশুনায় অনেক ভালো ছিল। সেবার ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবার এক সপ্তাহ পরে, অর্থাৎ দেড় বছর আগে প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল, প্রতিদিন নিয়ম মতো ওষুধ খাওয়ার পরও জ্বর কিছুতেই নামছিল না, সপ্তাহ পেরিয়ে দশদিন যায় অথচ জ্বর কমানোর কোনো নাম নেই, বড় ডাক্তার দেখিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর টাইফয়েড ধরা পরে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

বাবার কথাগুলো শুনে নিশীথা চুপসে যেতে থাকে ঘঁষা খাওয়া বেলুনের মতো। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে বলে- ‘তারপর’। ‘তারপর সব শেষ। তারপর, মাথায় আঘাত হানে টাইফয়েড। সেই থেকে মাথা এলোমোলো। যখন মনে যা আসে তাই বলে, তখন তাই করে। তবে সব কিছুই গুছিয়ে বলতে পারে- করতে পারে,। যেখানে যাবে সেখানকার গল্পই সে তৈরি করে বলতে পারে। অপরিচিত কারো বুঝবার উপায় নেই যে, সে এমন রোগ বহন করে চলছে দীর্ঘদিন থেকে। আর এই এলোমেলো মাঝে মাঝে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। অল্প কিছু দিনের জন্য আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, কিন্তু তখন আগের কোনো কিছু মনে করতে পারেনা। অনেক চিকিৎসা করানোর পরও কোনো কাজ হয়নি। পথে আপনাকে এমন বিভ্রান্ত করার জন্য সত্যি আমি লজ্জিত। ওর হয়ে আপনার কাছে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’

চোখ বেয়ে জল নেমে আসতে চাইছে ভদ্রলোক- অর্থাৎ নিশীথার বাবার। ‘না, না ঠিক আছে, ক্ষমা চাওয়ার কি আছে। তাছাড়া সবই যখন জানলাম, তখন দুঃখিত হওয়া ছাড়া আমারই বা আর কি করার আছে।’

বাবা পারলে পাগল মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিবেন।’ বলে নিশীথার হাত ধরে প্লাটফার্মের বাইরে বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায় দু’জনে। তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে চলে যাওয়া দেখে রুদ্র। দেখতে দেখতে এক সময় রাজধানীর হাজরো মানুষের ভীরে মিলিয়ে যায় তারা।।

স্বপ্নচারিনী

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

প্রশ্নবোধক

তন্দ্রা কয়েকদিন থেকে আকাশের কিছু বিষয় লক্ষ্য করছে যা তাকে দ্বিতীয়বার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভাবাচ্ছে।

বান্ধবী নিরা বারবার করে বলেছিল, ছেলেরা হলো ভ্রমরের মতো, যতদিন মধু ততদিন তারা আছে, যখন মধু শেষ তখন তারা হাওয়া।

তন্দ্রা পাত্তা দেয়নি নিরার কথায়। বরং নিরাকেই সংকীর্ণমনা বলেছে। যৌবন, মধু এই শব্দগুলো তন্দ্রা ভীষণ অপছন্দ করে। তবে আকাশের পরিবর্তনও সে মেনে নিতে পারছে না। একে অপরকে ভালোভাবে জানার জন্য একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। এতে দুজনের পরিবারই বাধ সেধেছিল। কিন্তু তারা কারো বাধা শোনেনি। নিজেদের জীবন নিজেরা যাপন করবে ভেবে বেছে নিয়েছিল লিভ ইন এর পথ।

কলিগ হিয়া বলেছিল, ভালোবাসা মানেই তো প্রিয় মানুষটির ভালো থাকাকে প্রাধান্য দেওয়া, তার পছন্দ-অপছন্দের মূল্যায়ন করা, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ। পরস্পরকে যদি ভালোই বাসো তাহলে লিভ ইনে থেকে একে অন্যকে জানার কী আছে? যতটুকু জানো তাতে কি একটা জীবন পার করে দেওয়া যায় না?

স্মিত হেসে হিয়াকেও পাশ কেটে গেছে তারা। বেশ ভালোই যাচ্ছিল তাদের জীবন। দুজনে সারাজীবন একসাথে থাকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই তো গতমাসে দুজনে মিলে প্ল্যান করছিল যে আকাশের চলমান প্রজেক্টটা শেষ হলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিবে। তখন পরিবার বা সমাজ কারোরই কিছু বলার থাকবে না।

সমস্যা শুরু হলো দিন পনেরো আগে আকাশের এক পিসি মারা যায়। সেই খবর পেয়ে সে গ্রামে গিয়েছিল। সেখান থেকে আসার পর থেকে আকাশ কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে, তন্দ্রার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। তন্দ্রা কিছু বললেও মেজাজ দেখায়। তন্দ্রা ভাবে পিসির শোকে এমন করছে সে।

কিন্তু দিন দিন তন্দ্রার প্রতি আকাশের বিরক্তি বেড়েই যাচ্ছে। যে আকাশ তন্দ্রার ন্যাওটা ছিল সেই এখন তন্দ্রা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশে বসলেও বিরক্ত হয়। যতক্ষণ বাসায় থাকে সারাক্ষণ ফোন নিয়েই পড়ে থাকে। তন্দ্রা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, তোমাকে সব বিষয়ে জানতে হবে না। এত প্রশ্ন করো কেন?

আকাশ একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখে তন্দ্রার মা বাসায় এসেছে। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে চা পান করছেন তিনি। আকাশ কোনো সৌজন্যতা না দেখিয়ে বেডরুমে চলে যায়। তন্দ্রাও আকাশের পিছে পিছে যায়। ফিসফিস করে বলে, মাকে দেখে তুমি কিছু না বলেই ভেতরে চলে এলে? কী ভাববে মা?

-আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে, কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মা এসেছে তুমি গিয়ে গল্প করো।

শান্ত শীতল কণ্ঠে কথাগুলো বলল আকাশ। তন্দ্রাও আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের কাছে চলে গেল। মা-মেয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর তন্দ্রার মা চলে গেল। মা চলে যাওয়ার পর তন্দ্রা ঘরে প্রবেশ করে দেখে আকাশ বাইরের কাপড় না ছেড়েই উপুর হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। তন্দ্রা আকাশের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, বাইরের কাপড়টা এখনো ছাড়োনি যে?

মাথা তুলে আকাশ বলে, মাথা ব্যথায় আমি মারা যাচ্ছি আর তুমি আছো বাইরের কাপড় নিয়ে? বাইরের কাপড় পরে বিছানায় শুলে কি তা অচ্ছুৎ হয়ে যাবে?

-তুমি জানো আমি এসব ছুৎ অচ্ছুৎ মানি না। দাও তোমার মাথা টিপে দেই, ব্যথা কমে যাবে।

-এসব আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। তোমার মাকে যেতে দিলে কেন? আজ তিনি থেকে যেতেই পারতেন।

সারারাত দুজনে মিলে গল্প করতে।

আকাশের কণ্ঠ শুনেই তন্দ্রা বুঝতে পারে তার মা আসাতে সে খুশি হয়নি।

-আকাশ তুমি দিন দিন কেমন বন্য হয়ে যাচ্ছ। আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছ ইদানীং। আর আজ মায়ের সাথেও কোন কথা বললে না। কী হয়েছে আমাকে বলবে তুমি?

উঠে বসে আকাশ। বালিশে হেলান দিয়ে বলে- তোমাকে বলার কী আছে? তুমি তো ভালোই আছো? তোমার মা বাসায় আসছে, অফিসে যাওয়ার পথে তোমার বাবার সাথেও দেখা হয়। তোমার সবই ঠিক আছে। শালা, আমারই কিছু ঠিক নেই। বাবা-মা আমার মুখ দেখতে চায় না, ফোন করলে ফোন রিসিভ করে না, ভুলে রিসিভ করলেও কথা বলে না। তোমাকে তো কিছুই হারাতে হয়নি তাই তুমি বুঝবে না। আমাকে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে হারাতে হয়েছে। আমার পরিবারের একজন মানুষ মারা গেছে সেই কথাটাও তারা আমাকে জানায়নি। বুঝতে পারছো আমি তোমার জন্য কি হারিয়েছি? তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোই আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিল।

আকাশের কথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না তন্দ্রা। সে ভাবে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে।

অবাক বিস্ময়ে সে বলে, এসব কী বলছো আকাশ? আমি তোমাকে বাধ্য করেছি এসব করতে? আমি তোমাকে বলেছিলাম, শুরু করার আগেই শেষ করতে। আমাদের ধর্ম ভিন্ন, দুই পরিবারের জীবন দর্শন ভিন্ন। আমরা এক হতে পারবো না কখনো। কী বলেছিলে তখন তুমি? বলেছিলে, ভালোবেসে নিজের জীবনেই যদি এতটুকু পরিবর্তন আনতে না পারি তাহলে কিসের প্রগতিশীলতা, কোন অসাম্প্রদায়িকতার জন্য লড়াই করছি আমরা। ভুল তো সেদিন আমিও করেছিলাম তোমার কথায় মুগ্ধ হয়ে। তুমি বলছো, আমাকে কিছু হারাতে হয়নি। তুমি জানো আমি কি কি হারিয়েছি? আমার বাবাকে প্রতিদিন অফিসে, পাড়ার রাস্তায় কত কথা শুনতে হয়, কতটা হেনস্থা হতে হয়? আমার মা বাসা থেকে বেরনো বন্ধ করে দিয়েছে মানুষের কথায়। মানুষের কথা সহ্য করতে না পেরে বাবা আমাকে ত্যাজ্য করার জন্য আইনী প্রসেস করছে দেখে মা আজ এসেছিল আমাকে ফিরিয়ে নিতে। তোমার কথা ভেবে আমি মাকে ফেরত দিলাম। আর তুমি কি না এসব কথা বলছ?

বিছানা থেকে নামে আকাশ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে তাহলে, আছ কেন এখনো? যাও। আর আমাকেও মুক্তি দাও।

আকাশের শার্টের কলারের নিচটা চেপে ধরে তন্দ্রা বলে, এই যদি তোমার শেষ কথা হয় তাহলে আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলে কেন?

কলার ছাড়িয়ে নিতে নিতে আকাশ বলে, তোমার জীবন নষ্ট হওয়ার কী আছে? চেহারা-ছুরত তো ভালোই তোমার। চাইলেই আমার মতো যে কাউকে পটাতে পারবে। আর হ্যাঁ এবার নিজের ধর্মের কাউকে পটিও তাহলে সুখে থাকতে পারবে।

এই কথা শোনার পর তন্দ্রা পাগল প্রায় হয়ে যায়। আকাশের বুকে এলোপাথারি কিল ছুড়তে ছুড়তে বলে, কী বললে? আমি তোমাকে পটিয়েছি? যে কাউকে পটাতে পারব? আমার ভালোবাসার কোন দাম নেই তোমার কাছে?

তন্দ্রার দুহাত চেপে ধরে আকাশ বলে-আমার জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়ে এখন ড্রামা করছ? যত্তসব!

তন্দ্রাকে ধাক্কা দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে পেছনে ফিরে দেখে ড্রেসিং টেবিলের এককোণায় পড়ে আছে তন্দ্রা। তার হাত লেগে কয়েকটি কসমেটিকস মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবারও ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে কী ভেবে ফিরে আসে তন্দ্রার কাছে। তন্দ্রার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। তন্দ্রা ওঠে না, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আকাশ দেখে তন্দ্রার মাথার পেছন দিক থেকে টকটকে লাল রক্তের স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে।

পরদিন সকল নিউজ চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ প্রচারিত হয়- অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে তরুন-তরুণীর মরদেহ উদ্ধার।

প্রশ্নবোধক

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

সুমাইয়ার একদিন

এই সময়টা সুমাইয়ার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে খেয়াল করে দেখেছে প্রতিদিন ঠিক একই সময় তার এমন লাগে।

প্রতিদিন ঠিক ৩.৪৫ মিনিটে তার এমন লাগে। সকালে একটু দেরী করে ওঠার অভ্যাস সুমাইয়ার ছোটকাল থেকেই। এজন্য কতো সমস্যা হয়েছে। সকালের প্রথম ক্লাসটা খুব কমই করা হয়েছে।

বরাবরই মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়া। প্রথম, দ্বিতীয় না হলেও ভালোভাবেই পাশ করেছে বোর্ডের সব পরীক্ষাগুলোয়। এখন মাষ্টার্স করছে শহরের একটা নামকরা কলেজে।

কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে।

এ শহর, এ কোলাহল ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। এ শহরে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, ঘুরা যায় ইচ্ছে মতো। এ শহরে তার প্রেমিক থাকে।

ঘুম থেকে উঠে সংসারের টুকটাক কাজে মাকে সাহায্য করা, ভাতিজা, ভাতিজির সাথে খেলা করা তারপর গোসল করে খাওয়া। সবাই যে যার ঘরে চলে যায়।

দোতলার উত্তরের ঘরটায় আসার পর আর সময় কাটে না।

শুয়ে মোবাইলে ফেসবুক চালাতে-চালাতে ঠিক ৩.৪৫ মিনিটে দম বন্ধ হয়ে আসে। তখন জানলার পাশে দাঁড়াতে হয়।

অনেকদিন আগে তখন সুমাইয়ার বয়স নয় বছর। দাদাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সুমাইয়া। ঈদের ছুটি। সব চাচাতো ভাইবোনেরা দুপুরে বাড়ির পিছনে পুকুরে গেল গোসল করতে। মা কে না বলে সুমাইয়াও গিয়েছিল। সাঁতার না জানা সুমাইয়া কিছুক্ষণ পর টের পায় তার পায়ের নিচে আর মাটি নাই। একটা আতংক চেপে ধরে, মনে কোন চিন্তা নাই, চিন্তা নাই মায়ের কথা, প্রিয় জামা এসব কিছুই মাথায় আসছিল না। শুধু নিজের অজান্তে হাত- পা ছুঁড়তে থাকে। তার এমন হাত-পা ছোঁড়া দেখে চাচাতো বড়বোন লতা এগিয়ে আসে। ধাক্কা দিয়ে নিয়ে আসে পাড়ের কাছে।

৩.৪৫ মিনিটে সুমাইয়ার ঠিক একই অনুভূতি হয়। পানিতে পড়ার অনুভূতি।

ছোটবেলায় এই দমবন্ধ থেকে বাঁচানোর জন্য বড় বোন ছিলো আজ কেউ নেই। জানলার কাছে এসে দাঁড়ালে সুমাইয়ার ভালো লাগে।

জানলার ওপাশে সজনা গাছ। গাছটাতে একটা-দুটা পাখি সবসময় কিচিরমিচির করে। বড় ভালো লাগে। কিছুক্ষণ পর শ্বাসকষ্ট কমে যায়। তারপর কিছুক্ষণ গল্পের বই পড়া।

অনিকের সাথে গত কয়েকদিন ধরে মনোমালিন্য চলছে। বিষয়টা খুবই সাধারণ ছিল। যেদিন হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেল সেদিন অনিককে সুমাইয়া বলেছিল যেন সে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। অনিক কী একটা কাজের কথা বলে আর যায়নি। বিষয়টাকে হালকা ভাবে দেখলেও চলতো কিন্তু সুমাইয়ার মন খারাপ এজন্য যে অনিকের সাথে আবার কবে দেখা হবে তার নেই ঠিক। অনিক কি পারতো না রেখে আসতে?

বিকাল হয়ে এলো। বাড়ির পাশের মসজিদ থেকে শিশু কন্ঠে আযান শোনা যাচ্ছে। হয়তো মাদ্রাসার ছাত্রের আযান দেবার হাতেখড়ি হচ্ছে। সুমাইয়া মন দিয়ে শোনে। কি কোমল আর মিষ্টি কন্ঠ! নামাজের জন্য ডাকছে কিন্তু কেউ যেতে পারছে না করোনার কারণে। সবাই ঘরে বন্দী।

কে কবে ভেবেছিল এমন হবে?

সুমাইয়ার ভালো লাগে না। রাতে মায়ের সাথে টিভি দেখার সময় ফোনটা এলো। কফিল চাচা অসুস্থ। কফিল চাচা গ্রামে থাকে। দুপুর থেকে বুকে ব্যথা। পল্লী চিকিৎসক গ্যাসের ঔষধ দিয়েছে কিন্তু একটুও কমে নি।

সন্ধ্যায় আর না থাকতে পেরে ফোন দিয়েছে শেফালি। কফিল চাচার একমাত্র সন্তান। সব শুনে সুমাইয়া কফিল চাচাকে হাসপাতালে আনতে বললো।

সন্ধ্যা ছয়টা, বাইরে বের হওয়া নিষেধ। তারপরও সুমাইয়া হাসপাতালে রওনা দিল। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। সুমাইয়া এসে দেখে কফিল চাচা ভ্যানে শুয়ে আছে।

শেফালি কেঁদে কেঁদে বললো, ডাক্তার সাহেব রংপুর মেডিকেল কলেজে রেফার্ড করেছেন। হার্টের সমস্যা। দ্রুত নিয়ে যেতে হবে। সুমাইয়া কী করবে বুঝতে না পেরে মোবাইলের লক খুলে সজলকে ফোন দেয়।

সজল রংপুর মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করছে। সজল সব শুনে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে। এ্যাম্বুলেন্স নষ্ট বাধ্য হয়ে তিনগুণ বেশী ভাড়ায় তারা দুই নারী আর তাদের আধিয়ার মানিক রওনা হলো মাইক্রোবাসে।

মাইক্রোবাসের সিটে কফিল চাচাকে কোনোমতে শুইয়ে তারা গাদাগাদি করে বসে। মাঝপথে কফিল চাচার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। ড্রাইভার সাহেব আর একটু জোরে যান বলে সুমাইয়া চাতক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো, হায় আজ হাসপাতাল এত দূরে কেন?

[করোনার দুঃসময়ে লেখা গল্প]

সুমাইয়ার একদিন

প্রমথ রায়

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

খড়কুটো লাশ

তার সাথে আমার পরিচয় জয়নুল গ্যালারিতে। সেদিন সব্যসাচী হাজরার চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল। তার পরনে ছিল কলাপাতা শাড়ি। কপালে কালো টিপ। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। সাউথইস্টে বিবিএ করছে। শখের চিত্রশিল্পী। আমি বাউন্ডুলে। তবুও আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমি নাকি তার কাছে চিত্রশিল্পী ফিদা মকবুলের মতো। আমার উসকো খুসকো চুলগুলো নাকি তার খুব পছন্দ। আমি কবি না হলেও নিজেকে কবি ভাবতে ভালোবাসি। আর এ জন্যই মনে হয় এ বাউন্ডুলে জীবন। যদিও আমি কোনো কবিতা লিখিনি তবে মুখস্থ করেছি অনেক। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলে দেই, হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে! 

তাকে শোনালাম, তুমি মোর প্রিয়া হবে দুই জন্ম পরে…….। তার নাম ইপ্সা।

ইপ্সা একদিন আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। তার ইচ্ছে বড় করে আমার পেইন্টিং এঁকে তার ঘরে টাঙিয়ে রাখবে। আমার হাসি পায়। এভাবে দিন এগিয়ে চলে। প্রতি বিকেলে আড্ডা চলে টিএসসি চত্বর, ধানমন্ডি লেক কিংবা সংসদ ভবনে। কখনো কখনো সাভারের সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে বসি কিংবা বুড়িগঙ্গার দুষিত জলে নৌকা বাই। নৌকোয় পা দুলোতে দুলোতে গল্প করি। সুখের গল্প, দুখের গল্প। দেশের গল্প বিদেশের গল্প। হাতে হাত ধরি। কখনো কখনো বাদামের খোসা খুলতে খুলতে দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। অথচ আমরা কেউ কারো নই। অন্যের হয়ে যাবো। কৃপান্তির কথা মনে পড়ে।কৃপান্তির কথা ইপ্সার কাছেই শুনেছি। আমাদের গল্পের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে কৃপান্তি। আমি তাকে দেখিনি, অথচ কখনো তা মনে হয় না। আমার আপন হয়ে উঠেছে। কৃপান্তি কবিতা ভালোবাসে। জীবনানন্দের। ইপ্সার হাত দিয়েই ‘জীবনানন্দ কবিতাসমগ্র’ পাঠিয়েছি। একদিন দুটো কাঠগোলাপের চারা পাঠালাম। তার নাকি খুব ইচ্ছে বাড়ির মেইন গেটের দুপাশে দুটি কাঠগোলাপ গাছ লাগাবে।

কৃপান্তির সাথে খুব দেখা করতে ইচ্ছে করে।কিন্তু ইপ্সা করায় না। অনেক বলার পর একদিন সে রাজি হলো, মোবাইলে কথা বলাবে। রাত নয়টায় মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য।

রাত নয়টা।সমস্ত ঢাকা শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত। লোডশেডিং চলছে। অথচ আমার হৃদয়ে জ্বলে আছে অজস্র ইলেট্রিক বাতি। ডায়াল করলাম। একটি মিষ্টি স্বর বলে উঠলো, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করলাম। অবশেষে সংযোগ পেলাম। সে দেখি ইপ্সার সাথে আমার বলা সব কথা জানে। বলল, আপনার খুব কষ্ট না? আমি বললাম, কিসের কষ্ট? সেতো জীবনের পরশপাথর। আপনাকে পেয়েছি! 

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আবার ডায়াল করলাম। আবার সেই মিষ্টি স্বর বলে উঠলো, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

পরদিন ইপ্সাকে সবকিছু বললাম। সে শুধু হেসে আমাকে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক দেখাতে নিয়ে গেল। শেকসপিয়ারের হ্যামলেট। কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। সে আমার মনের বিমর্ষতা বুঝতে পেরে বলল, শুক্রবার ভাদুনে এসো। কৃপান্তির সাথে দেখা হবে। এবার ইলেট্রিক বাতি নয়; মনের আকাশে জ্বলে উঠলো অজস্র তারকারাজি। নাটকে মন দিলাম। ওফেলিয়া জলে ডুবে মারা যাচ্ছে।  নদীর বুকে নেমে আসা একটি শাখায় ভর দিয়ে সে একটি উইলো গাছের মাথায় বনমুকুট পরাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ শাখাটি তার ভারে ভেঙে যেতেই সে জলে পড়ে গেল। তার পোশাক তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। তখন তাকে দেখাচ্ছিল মৎসকন্যার মতো।

শুক্রবার ভাদুনে গেলাম। পুব দিকে লাল মেঠো পথ। মিনিট দশেক হাঁটলে  একটা ছোট্ট ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে প্রাইমারী স্কুল। সেখানে কৃপান্তির সাথে দেখা হবে। পরনে থাকবে কলাপাতা শাড়ি। অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সে আসে না। ইপ্সার নাম্বারও বন্ধ। অবশেষে সন্ধ্যার একটু আগে ঢাকা থেকে একটা লাশ আসলো। ধর্ষিত নারীর লাশ। পরনে ছিল কলাপাতা শাড়ি। কপালে কালো টিপ। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা নেই। পাখির নীড়ের মতো চক্ষু মুদে আছে অনন্তকালের যাত্রায়। আমি মরামাছের চোখ দিয়ে দেখলাম। ইপ্সার লাশ। খড়কুটো লাশ। পুড়ে ছাই হবে। হায় কৃপান্তি তুমি কোথায়? তুমি কি ইপ্সা? যে আমায় সবসময় বলতো, আমরা কেউ কারো নই। আমরা চলে যাবো দু’জনার পথে। তুমিতো তোমার পথে চলে গেলে। আর আমি উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াই টিএসসি চত্বর, ধানমন্ডি লেক, সংসদ ভবন। কখনো কখনো সাভারে সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি কিংবা বুড়িগঙ্গার দুষিত জলে তোমাকে খুঁজি। কৃপান্তিকে খুঁজি।  আর বার বার শুনি, আমি হবো তোমার প্রিয়া দুই জন্ম পরে……..।

খড়কুটো লাশ

মজনুর রহমান

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

আজান

চারদিকে এশার নামাজের আজান হচ্ছে। বসন্তের উদাস বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। একজন যুবক ঘরের ভেতরে একা। গত এক সপ্তাহ থেকে অনেকটা একাই থাকতে হচ্ছে তাকে। আজানের ধ্বনিতে যখন লম্বা টান পড়ছে, হঠাৎ করে তার ভেতরে একটা হাহাকার তিরতির করে বইতে লাগল। পুরো শরীর কাঁপিয়ে কান্নার গমক আসতে লাগল। যুবক মানুষটা একলা ঘরের ভেতরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। মনে হচ্ছে, মুয়াজ্জিন মাইকে আজান দিচ্ছে না, দীর্ঘ সময়জুড়ে গভীর আর্তনাদ করে চলেছে। আজানকে কেন আহাজারি মনে হচ্ছে, আর কান্নাই বা কীসের জন্যে পাচ্ছে পরিস্কার করে বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো বেশ কিছুদিনের বন্দিত্বের বেদনা, মসজিদের জামাতে শরিক হতে না পারা- এসবই তার ভেতরে কোন ভাঙন এনে দিচ্ছে। যুবক নিজেও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে না কান্নার কারণ। 

এক সময়ে আযান শেষ হয়। মুয়াজ্জিন এর কিছুক্ষণ পরে অদ্ভুত একটা ঘোষণা দেয়। এমন ঘোষণা যুবক এই জীবনে কোনোদিন শোনেনি, কোনোদিন কল্পনা করেনি। মুয়াজ্জিন যেন তার ভারী গলায়, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, সম্মানিত মুসল্লিবৃন্দ, আজ থেকে আপনারা পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত মসজিদে আসবেন না। সবাই নিজ নিজ জায়গায় নামাজ আদায় করে নিন। আগামী শুক্রবারও শুধু দশজন মুসল্লিকে নিয়ে জুমার নামাজ আদায় করা হবে। সবাই ঘরে থাকুন, সাবধানে থাকুন।

শহরের অন্য প্রান্ত থেকে এই ঘোষণা শুনতে পান একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঘোষণাটি শুনতে পান একজন ডাক্তার, গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তিনি চোখের কোণের পানি মোছেন। ঘোষণা শুনতে পান একজন পুলিশ সদস্য, তিনি অদূরে ঘুমিয়ে থাকা শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকেন।

[করোনার দুঃসময়ে লেখা গল্প]

আজান

এস এম সাথী বেগম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

ভাগ 

ছেলেটাকে শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেললো? রক্তে পুরো দেহ চোখের পাশ দিয়ে পিঁপড়া ওঠানামা করছে। মেইন রোডের ধারে সামান্য জঙ্গলের নিচে ফেলে রেখেছে। রকির নামটা কে রেখেছিলো কেউ জানে না। রকির মা আধা পাগল রমা। রকির বড় মামা জলিল মিয়া দোকানের পুরোনো কর্মচারি মনুমিয়াকে ধরে এনে বিয়ে দিলেন আধাপাগল বোনটাকে। বিয়ে সাত মাস না যেতেই রকির জন্ম। রকির জন্ম নিয়ে নানা কথা উঠেছিলো আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে। মনু মিয়ার ছেলে নয় অন্য  কারো সন্তান রকি। 

রমার মানে রকির মায়ের তিনভাই। রংপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রেই রকির নানাবাড়ি। রকির মেঝো মামা বিয়ে করেনি। মেঝো মামা মারা যাওয়ার আগে তার ভাগের পাঁচ শতাংশ জমি রকির নামে লিখে দিয়ে গেছেন। মায়ের আছে আড়াই শতক। এই মোট সারে সাত শতক জমির মালিক রকি। কিন্তু বাকি দুই মামা এটা মানতে রাজি নয় তারা কোনোভাবেই রকিকে মেঝো মামার দেওয়া পাঁচ শতক জমিতে দিতে দিবে না বা দখল করতেও দেয়নি। রকির জন্মের পর মনু মিয়াকে দোকানের মালামাল চুরির অপবাদে বের করে পুলিশে দেবার পর আর মনু মিয়ার কোনো খোঁজ কেউ করেনি।  এ শহরে সারে সাত শতক জমির দাম তিন কোটি টাকার উপরে। এ জমি অন্য দুই মামার দখলে।

পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়ার বোন ফাতেমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর মামিদের আরও অত্যাচার বেড়ে গেল। ফাতেমা গার্মেন্ট কর্মী এ নিয়ে অশ্লিল ভাষায় গালাগাল। গরীবের মেয়ে ফাতেমার দোষ। নীরবে সেও সব কাজ করে যায়। রকির স্ত্রী পরিচয় নয় যেন বাসার গৃহকর্মী।গ বড় মামার ছেলে যেদিন ফাতেমার ঘরে যায় সেদিন ফাতেমা বাসা থেকে রকিকে নিয়ে বের হয়ে যায়।

অল্প সময়ে ফাতেমা বুঝেছে যার কিছু নেই সেই ভালো থাকে যার অনেক আছে তারা ভালো থাকার ভান করে। জমজ ছেলেমেয়ে নিয়ে ফাতেমার দিন কোনরকমে যাচ্ছিলো। রকি বড় একটি হোটেলে দিন হাজিরার কাজ করে। ফাতেমা ফেইসবুক চালায়। ছুটির দিন চিড়িয়াখানা, ওয়াটার পার্কে যায় ফেইসবুকে ছবি আপলোড করে।

প্রতিশোধ নিবে, পরিকল্পনা করে। সে স্বামীর ন্যায্য পাওয়া উদ্ধার করবেই।সোজা পথে না হলে বাঁকা পথে এগুবে।মাঝে মধ্যে বড় মামার ছেলের সাথে ফোনে কথা বলে। ম্যাসেঞ্জারে কথা আদান প্রদান হয়।

রকির ক্লান্ত দেহটার বুকে মাথা রেখে বলে তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার সব নিয়ে দেবার বুদ্ধি করছি। রকি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ভীড়ের মধ্যে গিয়ে রকির লাশ দেখে ষ্টাচুর মত দাঁড়িয়ে যায় ফাতেমা। চোখে কোন পানি নেই।একবার শুধু বড় মামার ছেলের দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। সে চাহনীতে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করছিলো—

পাশ থেকে শুনতে পেলো এই বউটাই মেরেছে সম্পত্তির লোভে—-।

ভাগ

লিপিকা লিপি

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

সমান্তরাল

পাশাপাশি চেয়ারে বসে অনেক পথ অতিক্রম করার পর অনিক জিজ্ঞেস করে কোথায় নামবেন?

মোবাইল থেকে চোখ সরিয়েই মুনা জবাব দিয়ে সৌজন্যতা রক্ষার্থে বলে, চকলেট খাবেন?

: না।

: আমার কাছে অনেক খাবার রয়েছে। আপনি চাইলেই খেতে পারেন দূরের পথ। জানাবেন।

ধন্যবাদের সুরে অনিক উৎসুক মন নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। মৃদু আলোয় সাদা ড্রেসে মুনাকে পরির মতো লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো হলেও মন্দ লাগছে না।বকবক করা মুনা তার সম্পর্কে বলেই যাচ্ছে। কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই অনিক বিস্তারিত জানতে পারে মুনা সম্পর্কে।

কিছুদূর যেতেই মুনার প্রশ্নের জবাবে অনিক জানিয়ে দেয় এখনও বিয়ে করেনি। অবিবাহিত মুনা কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে পথ পাড়ি দেয় যেন স্পর্শ তো বাকি থাক!

চুলে হাত বুলিয়ে বুকের মাঝে মাথা রেখে পথ চলুক.. এমন ভাবনা যে মুনা ভাবেনি তা কিন্তু নয়। সুযোগ এসেও মুনা তা গ্রহণ করেনি। কখনও চোখ মেলে দেখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। বাদাম চাই, চকলেট চাই কিংবা চা – কফি যে শব্দই কানে আসুক আজ বিরক্ত লাগছে না। ঝিকঝিক শব্দে চলতে শুরু করছে ট্রেন।রাতের আঁধারে স্পষ্ট নয় বাইরের সব কিছু। তবুও উঁকি দিয়ে খানিক দেখার বাহানা। রাস্তার ধারে মাঝে মধ্যে লাইটের আলো ট্রেনে প্রবেশ করতে না পারলেও চাঁদের আলো যেন কাঁচের জানালা ভেদ  করে আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও পাতায় আলোর নাচন আমাকে জাগিয়ে রাখছে। চাঁদ- রাত আর পাতার মিলন আমার ভীষণ পছন্দ। এ নিয়ে আমি নিজের মনেই লিখে যাই কোনো কাব্য।

বাকি পথ চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তেই..

উঠে পড়ুন মুনা! কিছুক্ষণ পরেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত স্টেশনে নামবো। প্রস্তুত হয়ে নিন।

চোখ খুলে মুনা দেখতে পায়  অন্ধকার তখনও কাটেনি। লোকজন প্রস্তুত হচ্ছে নামবার। স্টেশনে সকালের অপেক্ষা করার মনোভাব নিয়েই নেমে যায় আর ভাবে, নিজের এলাকায় অনিককে একটি 

সুন্দর সকাল উপহার দিতে পারব। আশেপাশের হৈচৈ শব্দে  মুনার জীবনে যেন  নতুন সূর্যের উদয় হবে আজ।অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে মুনার মনে। এর আগে মুনা কত সকাল উপভোগ করেছে। কই! এমন তো লাগেনি। আজ কেন তবে মুনা সূর্যের রশ্মিকে এত কাছ থেকে অনুভবের অপেক্ষা করছে?

হাতের আঙ্গুলে গোনা কয়েক সেকেন্ড পরেই “ভালো থাকবেন, আসি।”

মানুষের মন বাহির থেকে দেখা যায় না ঠিকই। কিন্তু অনুভব ও অনুভূতি কতটা প্রখর হলে চকচকে আকাশ কিংবা ভোরের নির্জনতা বুঝতে পেরেছিল..মুনার মনে কি নাড়া দিয়ে গেল। সাত – আট ঘন্টা পাশাপাশি বসে, আন্তরিকতা মেশানো আলাপন শেষে কীভাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনিক অন্ধকারে মিশে গেল তা ভাবতেই সে হারিয়ে যায় স্টেশনের অন্ধকারে। ট্রেনের জ্বলজ্বলে আলোয় এত যত্ন করা অনিক কীভাবে স্টেশনের অন্ধকারে তাকে  রেখে চলে গেল তা ভাবতেই প্রকৃতির সকাল, সূর্য, পাখি কিছুই আটকায় না মুনার চোখে। কয়েকবার মুছে দিতে চেয়েও  মুছতে পারেনি অনিকের মোবাইল নম্বর। দিন- মাস অতিক্রম করা মুনা বুঝতে পারে না কীভাবে তার জীবনে কয়েক ঘন্টার জন্য প্রেম এসে উড়ে চলে যায়।

নিজেকে ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রেখে প্রেম ভুলতে যাওয়া মুনা হঠাৎ বার্তায় দেখতে পায় “কেমন আছ।”

নিজেকে সামলিয়ে রাখা যেন কঠিন। অনিকের ডাকে সাড়া দিতেই  নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। একটু একটু করে দুজনার মাঝে প্রেম গাঢ় হতে লাগল।কখনও লুকিয়ে লুকিয়ে হাত ধরে ফুচকার দোকানে পরস্পর কাছে এসেছে বহুবার। ছোট নদী, ঢেউ, উড়ে যাওয়া মেঘের কাছে মুনা ঋণী থাকার কথা ভুলতে পারে না। সবুজ দুর্বা ঘাসে পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকা দুজন গোধূলি  পাখিদের কিচিকিচি শব্দে জেগে ওঠে।

নিজেকে গুছিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে কদিন পরপরেই অনিকের আসার প্রহর গোনে।

“মুনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি”.. কথাটি বলেই প্রতিবারেই বুকে জড়িয়ে মুনার কপালে চুমু দেয় আর  বলে..আমাকে যেতে হবে দূর দেশে। কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতায় ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধব।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মুনা কাঁদে আর ভাবে..মুনাকে সাথে নেওয়ার  প্রতিজ্ঞায়  অনিক কতই না দিন পার করল।একদিন ফিরে আসবে অনিক। নতুন ভোর দেখবে মুনা।

নিয়ম মতো প্রকৃতিতে ভোর হয়। দিন শেষে আসে রাত্রি। কিন্তু মুনার জীবনে আসে না আর কোনো বার্তা।

প্রেমের টানে স্টেশনে স্টেশনে ঘুরে বেড়ায় সে। কত ট্রেন আসে আর যায়।হুইসেল শুনতে পেলেই ছুটে যায় ট্রেনের কাছে। মলিন মুখে ফিরে আসে।

এদিক সেদিক খুঁজে ফিরে রেল লাইনের ধারেই প্রহর গুনতে গুনতে আজ বড্ড ক্লান্ত শরীর। প্রাণহীন। পুলিশ সনাক্তকরণ শেষে মুনার মৃতদেহ স্বজনদের হাতে ফিরে আসে। হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় একটি কাগজের টুকরো। লেখা ছি ‘প্রেম সমান্তরাল। ‘

সমান্তরাল

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ৩:০০ অপরাহ্ণ

খসড়া শৈশব

মাইক বাজিয়ে এসেছেন আইসক্রিমওয়ালা, তার বেসুরা গলা। সুপারির বিনিময়ে, কাঁচা ধানের বিনিময়ে রাখছি নারকেলি আইসক্রিম। ফেরিওয়ালা ডাক দিলো – “চুরি-আলতা”, তাকে ঘিরে পাড়ার মেয়েদের ভিড়।

একটা কলার ভেলায় আমরা তিনজন পানিতে ভাসছি, ঢেউ তুলে হাসছি। সাতরে সাতরে পুকুরে ঝুঁকে থাকা কদমের ডাল ধরে বানর ঝোলা ঝুলে গাছে ওঠার চেষ্টা করছি আমি কাইয়ুম আর আজহার। নষ্ট টায়ার ছোট লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সারাদিন ওটার পিছু ছুটছি, যেন আমার মোটরসাইকেল। স্কুলে যায়নি বলে মা ঝাড়– হাতে পিটাতে এলে পালিয়ে বাঁচা। বয়স তখন কাঁচা।

আমার ফেলে আসা শৈশব, বন্ধুরা কই সব? স্কুলে যাবার পথে মেহেগুনির বিচি আকাশের দিকে ছুড়ে মারি। ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে, যেন চরকি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব সারি। অলি আর আলমাস ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে- “নুনু দেখে ফেলেছি”। ওরা আমার সহপাঠী, শয়তানের ঘাঁটি। তাড়াহুড়ো করে প্যান্ট সামলাতে নুনুতে চেইন এটে গেল। যন্ত্রণায় দিলাম তীব্র চিৎকার। আকাশ বাতাস পার।

কাকিমা কুলা হাতে ধান ঝাড়ছে, পাশে কবুতর। নতুন ধানের উৎসব। আমিন কাকা আর সালিম কাকা ধান মাড়াই কলে। বাতাসে উড়ছে খড়, নতুন খড়ের কাঁচা গন্ধ। কে বলবে মন্দ!

চড়ুইভাতি খেলবো। ক্ষেত সেচে ছোট মাছ ধরেছি। খিচুড়ি রান্না শেষ, ডিম ভাজা হচ্ছে। চোখ বেঁধে ঝুমি আপা আমাদের ধরতে চাইছেন। আমরা তার শরীর ছুঁয়ে পালিয়ে যাই কাছাকাছি, কানামাছি।

নানার বাড়িতে গেলে সারা শরীরে কাদা মেখে ফুটবল খেলি। শরীর ও মুখের কাদায় চিনতে না পারা দশা; যেন আমরা কাদা মাটির মূর্তি। কি যে ফূর্তি। সেলুকলে পানি উঠেছে আর আমরা ড্রেনে গোসলে নেমেছি। পানির ঝাপটা আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। তাসলিমা, আকলিমা, হিমেল আর আমি। দিনগুলো সত্যিই ছিল খুব দামী।

স্কুলে যাই ছোট সাইকেলে। আমার সাইকেলে একত্রে চারজন চড়লো। স্যারেরা উঁচু থেকে সুতো বেঁধে বিস্কুট ঝুলিয়েছেন। আমাদের হাত পেছনে বাঁধা। লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে হবে, বিস্কুটলাফ খেলা। আনন্দ মেলা।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চারপাশে দেয়াল তোলা স্কুলের পেছনের ছোট গেট টপকে  পালিয়ে যাচ্ছি আমি, নুরু, সুমন, আব্দুল। স্কুলব্যাগ এটে গেছে গ্রিলে। মসিবত আছে কপালে, স্যার তেড়ে আসছেন।

কত স্মৃতি, কত স্মৃতি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে স্কুলে এসেম্বলি করি, জাতীয়সংগীত গাই, পতাকাকে সালাম জানাই, ভাল মানুষ হয়ে দেশ গড়ার শপথ করি। আমরা কি হতে পেরেছি শপথের মত যথার্থ ভালো মানুষ?

মনে পরে, জলছবির মতো কতো স্মৃতি মনেপড়ে। অর্ধেক মাথা কামাতেই চুল কাটবে না বলে কান্না জুড়েছে আমার ছোট ভাই। তাকে লাগছে তাই তোফাজ্জল দাদার মতন টাকপড়া। ছোট বোনকে সাইকেলে তুলে ঠেলে ঠেলে চালাচ্ছি। আমার হাফ-পেন্ট গেল খুলে। না পারছি সাইকেল সামলাতে, না পারছি খোলা প্যান্ট ঠিক করতে। পারিবারিক অ্যালবামে একটা ছবি আছে আমার চুল কামানো, গায়ে জামা নেই, পা থেকে মাথাঅব্দি একেবারে এক কালার। এইসব দিন কোনদিন ফিরবে না আর।

খসড়া শৈশব

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ২:৫৯ অপরাহ্ণ

ক্যান্সেল বাটন চাপার আগে

 সরি, রং নাম্বার বলেই ক্যান্সেল বাটনের দিকে আঙ্গুল এগিয়ে দিল পিউ। কী কারণে যেন আটকে গেল। ও পাশ থেকে যেন কিছু বলছিল মেয়েটা। ঠিক শোনা গেল না। তাই প্রশ্ন করল

-কী বললেন?

-না, মানে আপনি খুব সুন্দর। মেয়েটা যে কথা এড়িয়ে গেল তা ভেবে পিউয়ের মাথা আরও বিগড়ে গেল। যতদুর শোনা গিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে মেয়ে বাজে কমেন্ট করেছিল। এখন ঘুরিয়ে নিল। সে আরও একটু রেগে বললো, হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?

-না কিছু হয় নি, তবে হতে কতক্ষন। মেয়ের কন্ঠ আরও নরম হয়ে এলো। আচ্ছা আপনাকে একটা মেয়ে মানুষ কল করেছে, সে যেই হোক তার সাথে কি একটু মিষ্টি করে কথা বলা যায় না, নাকি আপনার মিষ্টি অপছন্দ। মেয়ের কন্ঠে দুষ্টু হাসি।

-তা দিয়ে আপনার কী লাভ? পিউয়ের ঝাড়া জবাব।

-লাভও নেই, আবার ক্ষতিরও সম্ভাবনা নেই। মেয়ে কথা চালিয়ে যেতে লাগল। অন্য সময় হলে রং নাম্বার পর্যন্তই আটকে যেত। কী এক অলিক মায়ায় সে লাইনটা কাটতে পারেনি। উঠতি বয়সে যা হয় আরকি, খেয়ালের বসে অথবা দেখি না কী করে টাইপের চিন্তা করে চালিয়ে যায়। সেও তাই করল।

তিস্তার পানি কি আর বসে থাকে, ছলাৎ ছল চলতে চলতে আষাঢ় শ্রাবণ গড়িয়ে মধ্য আশ্বিন। পাড়ার মোড়ের ফ্লেক্সি লোডের দোকানির আঙ্গুল ফুলে আটিয়া কলা গাছ। 

-শোন পিউ, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। অনেকটা দাবির সুরেই বলল সুজানা।

-তা তো হবে না সোনা যাদু

-কেন হবে না, তুমি চাইলেই হবে। চলনা দেখা করি প্লিজ, মেয়ের কন্ঠে আকুতি ঝড়ে পরে। শুধু ফোনে কথা বলে যাব, আমাদের কি তবে এই জনমে দেখা হবে না!

পিউয়ের মনেও ইচ্ছেটা কাজ করছিল, কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু মুখেই না বলছিল। এই না না করতে করতেই দুজনের দোখা হয়ে গেল। শুরু হলো দ্বিতীয় ইনিংস। 

দিনে পার্কের বেঞ্চে দীর্ঘ আাড্ডা, রাতে ননস্টপ ফোন আলাপ। এবার পার্কের মালিক না মোড়ের ফ্লেক্সি ব্যাবসায়ী কে বেশি প্রফিট হাতাচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

আবার মেয়ের আবেগ জড়ানো আকুতি, —তোমার বাসায় কে কে থাকে?

-কেন?

-না, মানে এভাবে আর কতদিন। পর্কে বসতে আর ভলো লাগে না। দেখ না মানুষগুলো কেমন ক্ষুধার্ত কাকের মতো তাকিয়ে থাকে। যেন একটু সুযোগ পেলেই ছিঁড়ে খাবে। চলনা বসায় যাই।

-না বাবা বাসায় যাওয়া যাবে না। পিউয়ের চোখ মুখে ভয় রেখা ফুটে ওঠে।

-তাহলে অন্য কোথাও।

আচ্ছা দেখি। একটু চিন্তা করে পিউ বলে, আগামী পুর্ণিমা আমরা একসাথে উপভোগ করব। মেয়ের শত ডানার আনন্দ আর দেখে কে।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থ্যা করতে পারেনি। ওদিকে মেয়ে সাজুগুজু হয়ে বসে আছে। সে আসবেই। অনেক কষ্টে বহু ঘুরাঘুরির পর এক বন্ধুকে ম্যনেজ করলো পিউ। পূর্ণিমার চাঁদ যেন নিজেই নেমে এলো ধরণীর বুকে। সারা রাত খুনসুটি লুটোপুটি। জোসনার রোদে গা শুকিয়ে সকাল নাগাত যে যার ঘরে।

পিউয়ের যে কী হলো। সেই রাতের পর থেকে এক মুহূর্ত সুজানাকে ছাড়া ভাবতে পারছে না। তার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে সুজানার কোনো খবর নাই। অনেক কষ্টে জেনেছে সেই রাতের কোন সদুত্তোর দিতে না পারায় সুজানা এখন গৃহবন্দি। তার মোবাইলও নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পিউয়ের আকুল হৃদয় পগল পারা হয়ে পথে পথে ঘুরলো বহুদিন কিন্তু সুজানাকে আর পাওয়া গেল না। এবার তিস্তার জল গড়িয়ে সমুদ্র ছুলো। দিনে দিনে তিস্তার বুকে পলি জমে বালুচর দীর্ঘ হলো। উদাসী বাউল পিউও বহু কষ্টে মনের যন্ত্রনা থেকে নিজেকে মুক্ত করলো। ধীরে ধীরে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল।

এক বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে,  মোবাইল বেজে উঠল। আপরিচিত নাম্বার। কল রিসিভ করতেই নারী কন্ঠ ভেসে এলো, -হ্যাল, আপনি কি কমল বলছেন?

-জি, না, রং নাম্বার। এবার ক্যান্সেল বাটনে চাপ দিতে একটুও সময় নিল না। ক্যান্সেল! 

ক্যান্সেল বাটন চাপার আগে

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ২:৫৯ অপরাহ্ণ

দর্পণ

আগের বউটাকে ছেড়ে ছিল বাচ্চা হবার পর।

আশিকের বাবা মরার অপেক্ষা করছিল আশিকের মা। আশিকের বাবা তো ছেলেকে বউ ছাড়তে দিবে না। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই ছেলেকে বউয়ের সাথে সহ্য করতে পারেন না।

সে কথা মুখ ফুটে বললে তো সবার কাছে খারাপ হয়ে যাবেন। তাই আশিকের বাবা মরার পরই শুরু করে দেন নাটকীয়তার। 

কথায় কথায় বউটার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে নিজে চুপ থেকে ছেলের কাছে ইনিয়েবিনিয়ে বিচার দেয়।

তুই তোর বউ বাচ্চা নিয়ে থাক, আমাকে বিদায় কর।আমি ভাইয়ের বাড়ি চলে যাই।

কদিন পর পর ভাইয়ের বাড়ি চলে যায়।

প্রেসার বেড়ে যাবার কথা বলে মিছে অসুস্থতার ভান করেন।

এক পর্যায়ে বলে বসলেন তোর বউয়ের সাথে আমি থাকবোনা। ও থাকুক। তুই আমাকে বাদ দে।

আশিক মাহমুদাকে অনেক অত্যাচার করেও যখন বাড়ি থেকে বের করতে পারেনি, তখন ফুপুকে দিয়ে বুঝিয়ে মাহমুদাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

তারপর মাহমুদার আর কখনো স্বামীর ঘরে ফেরা হয়নি।

তালাকনামা পৌঁছে যায় তার কাছে।

আশিকের মা খুশিতে পা নাচান আর হিন্দি সিরিয়াল দেখেন।

২.

চার বছর পর…. 

আশিক আজ আবার মেরেছে সুচনাকে। কয়েক মাস আগে মায়ের পরামর্শে সুচনাকে আলাদা বাসায় রেখেছে।

তারপর থেকে শারীরিক মানসিক অত্যাচার চলছেই।

কদিন থেকেই সুচনাকে বলছিল ঔষধ খেতে। যাতে বাচ্চাটা না থাকে।

আগের বউটার বাচ্চার খরচ দিতে হয়, এখন এর বাচ্চা হলে সেটারও খরচ দিতে হবে।

তাছাড়া মা বলেছে বাচ্চা কাচ্চা যেন না হয়।

কিন্তু সুচনা কোনোভাবেই বাচ্চা নষ্ট করবে না। আশিক মারতে মারতে এক পর্যায়ে সুচনার পেটে লাথি মারে। মাথায় খুন চেপে গেছে আশিকের। একেতো বিয়ের সময় কোনো টাকা পয়সা দেয়নি সুচনার পরিবার। পরবর্তীতে টাকার কথা  বললে সুচনার পরিবার প্রতি মাসে পাঁচ অথবা দশ হাজার করে টাকা দেয়। এটা নিয়ে মায়ের মন খারাপ।

মা তো ঠিকই বলে। জামাইকে তো মানুষ হেল্প করেই। তাছাড়া উপহার হিসেবেও তো কয়েক লাখ টাকা দিতে পারে ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু সুচনার পরিবার তা দিচ্ছে না।

এমন বউ কি দরকার?!

আবার যদি এই বাচ্চা হয় ! উহ!!

সুচনা পেট চেপে ধরে। আশিক বলে- নাটক না করে ঔষধ খেয়ে নে। আমি কোনো বাচ্চা চাই না।

তোর জন্য এসব টেনশনে আমার আম্মার প্রেসার বেড়ে গেছে। আম্মা অসুস্থ হলে তোকে মেরেই ফেলবো।

বাচ্চা নষ্ট না করবি না তো তোকে ছেড়ে দেবো। বলে আবারো একটা লাথি মেরে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে। আগে থেকে রেডি করে রাখা তার উকিল বন্ধুর কাছে গিয়ে ডিভোর্স পেপারে সই করে।

তারপর আশিক তার মাকে কল দিয়ে বলে- 

আম্মা, কাজ হয়ে গেছে। চিন্তা করিয়েন না। আমি সই করে দিয়েছি।

আর পেটের টাকেও লাথি মেরে এসেছি। ওটাও টিকবে না।

আপনি কোনো টেনশন করবেন না। নইলে আপনার প্রেসার বেড়ে যাবে। আমি আসতেছি।

ছেলের কথা শুনে আশিকের মা খুশিতে পা নাচান আর হিন্দি সিরিয়াল দেখেন।

দর্পণ- সফুরা খাতুন

কামরুন নাহার রেনু

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ২:৫৯ অপরাহ্ণ

যোগ বিয়োগ

ভার্সিটি পাস করেই একটা চাকরি ঠিক জুটিয়ে নেবো, আর তোমাকে একা থাকতে দিবো না। সোজা কাজী অফিস। জানি আমাকে তো তোমার বাবা মা জামাই বানাবে না, চেহারার যা হাল তার উপর বাবার গাড়ি বাড়ি প্রপার্টি কিচ্ছু নাই, কেউ দেয় নাকি এমন ছেলের হাতে তাদের ডানাকাটা পরিকে? আর শোনো, বছর ঘুরতেই আমরা বাবা মা হবো, বাচ্চা নিশ্চই খুব কাঁদুনে হবে। তুমি তো আবার ঘুম কাতুরে, আল্লায় জানে আমার গুল্টি বুড়ির কী যে হাল করো। সমস্যা নাই তুমি ঘুমিয়ে গেলেও আমি দেখে রাখবো গুল্টি বুড়িকে। আমাদের কিন্তু প্রথমে মেয়েই হবে। ওর তুল তুলে হাত দুটো দিয়ে সারাক্ষণ আমাকে আদর করবে। আহ্ কী শান্তি। তুমি তো আবার আমার আদর দেখে হিংসায় জ্বলে যাবা । আরে শোনো প্রেমিক আমি যেমনই হই না কেন পড়া লেখাটা ঠিক রেখেছি তোমার জন্যই, তুমি আমার ট্রামের শেষ কার্ড, বাজি মাত আমি করবোই। আরেকটা কথা,-সংসার জীবনে রাগটা একটু কমাতে হবে তোমাকে । রাগলে তোমাকে ফুলন দেবী মনে হয় আমার। এত রাগলে আমি তো হাইপারে চলে যাবো, তখন তোমারই কষ্ট বাড়বে। না না আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। আর ছয় মাস গেলেই ভার্সিটি জীবনের ইতি। দিন ফুরোচ্ছে না আমার। একটা প্রাইভেট ফার্মের সাথে কথা হয়েছে শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা। জানো স্রষ্টা জানে, তোমাকে ছাড়া একদম পঙ্গু হয়ে যাবো আমি তাই তোমাকে ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছেন আমার সাথে। কথা গুলো এক নাগারে বলে যাচ্ছে আরিব অথচ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না তনিমা, বিষয়টা লক্ষ্য করে আরিব,বলে- ও বউ চুপ করে আছো যে? কিছু তো বলো। এমন চুপ করে থাকলে বুকের ভেতর দমের মেশিন অকেজো হয়ে যেতে চায়। শরীর খারাপ? কি হইছে কও না কেন? তনিমার সংক্ষিপ্ত উত্তর , -প্রচন্ড মাথা ধরেছে। তুমি বলো আমি শুনছি। আরিব হাত ধরে টেনে তুলে বলে-চলো গরম কফি খাওয়াবো তোমাকে সব ঠিক হয়ে যাবে। টিউশনি করে লেখাপড়া করি বলে ভেবো না তোমাকে কফি খাওয়াতে পারবো না। এই বলে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট সাথে কিছু খুচরা টাকা বের করে দেখায় তনিমাকে। হাঁটতে থাকে ক্যান্টিনের দিকে। মাথাটা বাঁকিয়ে তনিমার মুখ বরাবর নিয়ে আবার প্রশ্ন করে খুব কষ্ট হচ্ছে? তনিমা মৃদু হেসে না সুচক মাথা নাড়ে। আরিব হাত দুটো উপরে তুলে বলে, -আল্লাহ্ ওর সব ব্যাথা আমারে দাও তবুও ও ভালো থাকো। তনিমা আরিবের মুখের দিকে তাকায়, কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায়। কফি সপে দু’জনে মুখোমুখি বসে কফিতে  চুমুক দেয়। আরিব প্রশ্ন করে, -আচ্ছা আমার শাশুড়ির এখন কী অবস্থা জানাই হলো না। তনিমা গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয় -ভালো না। জানোই তো ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। চোখ ছল ছল হয়ে যায়। কথা ঘুরিয়ে আরিব বলতে থাকে,-সব ঠিক হয়ে যাবে, আচ্ছা তোমার মাথা ব্যথা কমেছে? তনিমা উত্তর দেয় -হু।আরিব গাল ভরা হাসি দিয়ে স্রষ্টাকে শুকরিয়া জানিয়ে বলতে থাকে ইউ আর গ্রেট। তনিমা আরিব কে উদ্দেশ্য করে বলে- জানো, কখনো কখনো প্রার্থনার ঘরে ঈশ্বর ঘুমিয়ে থাকেন! তনিমার কথায় কিছু মেলাতে পারে না আরিব, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। উঠে দাঁড়ায় তনিমা বলে -আজ ক্লাস করবো না, মা’কে খুব অসুস্থ মনে হয়েছে বাসায় যেতে চাই। আরিব মাথা নেড়ে সন্মতি জানায়, হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ায়, হাত ইশারায় রিকসা ডেকে তনিমাকে উঠিয়ে দেয়, রিকসা চলতে শুরু করে তনিমা বার বার পিছু ফিরে তাকায়। সাবধানে যেও আর মায়ের কি অবস্থা জানিও আমাকে কথা গুলো তনিমার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে আরিব । এক সময় রিকসাটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তনিমার বলা কথার অর্থ মেলাতে পারে না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরিব অনেকট্ সময়। বাড়ি ফেরার পথে ছোট বোনের ফোন তনিমাকে – আপু বাড়ি চলে আসো মেহমান আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে, অসহ্য মনে হয় কথা গুলো তনিমার কাছে। রোড এ্যাকসিডেন্টে গুরুতরও অবস্থায় মা, ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে।। এদিকে বাবারও কিডনী দুটো প্রায়ই বিকল হবার পথে। দুটো মাত্র বোন, তনিমা বড় তাই এ অবস্থায় বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়েকে দ্রত বিয়ে দিবেন, পাত্র পক্ষ আসবে, পছন্দ করলে আজই রেজিষ্ট্রি, সব ঠিক ঠাক অথচ সকালে তনিমাকে জানানো হয়েছে বিষয়টা। কিছু মেলাতে পারে না তাই ভার্সিটিতে আরিবের কাছে ছুঁটে গেলেও আরিবের অবস্থা বিবেচনা করে কিছুই বলতে পারে না। হাজার কথার অব্যক্ত ঝড় বুকে নিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। শেষ বিকেল, একটা গাড়ি এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়, চারজন মানুষ গাড়িতে, এরাই সেই অতিথী। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এমেরিকা প্রবাসী, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে তাকেও নিয়ে যাবে এমেরিকা। কথা গুলো যখন বাবা তনিমাকে বলছিল তখন বাবাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাবা বলে -তোমার মায়ের অবস্থা এবং আমার অবস্থা মাথায় রেখে বড় সন্তান হিসেবে কোনো জটিলতা বাড়াবে না এটাই আশা করি। তনিমার ছবি ওরা আগেই দেখেছে, বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, বিয়ের ঘরোয়া প্রস্তুতি চুড়ান্ত। খুব ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে চিৎকার করে আরিবকে ডাকতে, কিন্তু পারছে কই। আরিবের নাম্বারে বার বার কল দিয়েই যাচ্ছে তনিমা কিন্তু বন্ধ পাচ্ছে। ঘন আঁধারে চারপাশ ছেঁয়ে আসছে তার । ফেসবুকেও নেই আরিব, কিছু মেলাতে পারে না, ইনবক্সে লিখে দেয়, – আরিব, জীবনের অংক বড়ই জটিল, ভাগ্য আমার সাথে নির্মম ভাবে উপহাস করেছে। সে ব্যাখ্যা তোমাকে দেবার সাহস আমার নেই তাই স্বার্থপরের মতো কিছু না বলেই আজ তোমার কাছ থেকে চলে এসেছি। অনেক কথা বলবো বলে জমিয়ে রেখেছিলাম, তা আর বলা হলো কই। আর কোনো দিন হবেও না, জীবনের জটিল অংকে যতই যোগ বিয়োগ করো হিসেব মিলে না কখনোই। ভালো থেকো — গতকাল তনিমা চলে যাবার পর ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তনিমাকে ফোন দিতে যেয়ে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। মনিটর সাদা হয়ে যায় কিছুতেই কাজ করছিল না তাই মোবাইলটা সার্ভিসিংয়ে দিয়ে রুমে আসে আরিব, পরদিন সকালে ভার্সিটি যাবার পথে আগে মোমাইলটা নেয়, মোবাইল অন করেই ডাটা চালু করতেই তনিমার ম্যাসেজ ঢুকে, ম্যাসেজ পড়ে কিছুই বুঝতে পারে না আরিব, তনিমা কী বোঝাতে চেয়েছে। সারা শরীর ঘামতে থাকে। লেখাগুলো বার বার মুখস্ত পাঠের মতো পড়তে থাকে। মেলাতে পারে না কিছুই। তনিমার নাম্বারে কল দেয়,উত্তর, -দুঃখিত এই নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

যোগ বিয়োগ

হেলেন আরা সিডনী

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ২:৫৯ অপরাহ্ণ

ভালোবাসার আত্মা

ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরে তমালের সে কী আনন্দ। রেজাল্ট ভালো থাকায় একটা সিঙ্গেল রুমও পেয়ে যায়। নিজ বাসার মতোই পড়ালিখা আর ঘুমের স্বাধীনতা আছে কিন্তু রাত এলেই শরীরটা কেমন ছমছম করে.. মনে হয় রাতে কে যেন ঘরে এসে হাঁটা-চলা করে। তমালের কেন তবে শরীরটা শিউরে ওঠে, এত ভীরু মনের ছেলে তমাল তো নয়।

আজ ঘুম আসছিল না হঠাৎ দরোজাটা খুলে যায়…. কেউ একজন এসে চেয়ারে বসে বই পড়ছে। তমাল দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে বলে

-কে ভাই তুমি? কী চাও এখানে, আর…আর কেমন করেই বা এলে।

অন্যজন বলে, ভয় পেও না, আমি সাগর, আগে এই রুমে থাকতাম। রুমটা বন্ধই থাকে, কেউ এখন ভয়ে থাকে না এই রুমে।

-কিন্তু কেন??  ভয়ে ভয়ে তমাল জিজ্ঞেস করে।

-কেন, সুমী আর সাগর….।সুমী-সাগর এই প্রাঙ্গনে সকলের হিংসের জুটি ছিল। কেউ কেউ ভালোবাসার কথাও বলতো। এখানকার কিছু মাস্তান ছেলেরা সুমীকে অন্যভাবে চাইতো। আমি তাদের সাবধান করাতে শত্রু হয়ে যাই। ওরা আমার ভালোবাসাকে ধর্ষণ করে সুযোগ বুঝে মেরে ফেলে তারপর সেই রাতে ওরা আমার এই ঘরে এসে ঘুমের মধ্যে আমাকে গলা চেপে মেরে ফেলে।

তমাল ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে থাকে, ‘‘তু…তু…তুমি ভুত।’’

অন্যজন বলে- ভুত কি না জানি না, আমাদের দুই আত্মা আজও একসঙ্গে ঘোরে। অন্যায় দেখলে শাস্তি দেই কারণ এইসব ছেলেরা ছলেবলে পার পেয়ে যায়। তোমার ভয় নেই, তুমি ভালো মনের মানুষ। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

তমাল চুপ হয়ে শুনছিল এদিকে হার্টবিটের কোনো থামার লক্ষণ নেই। ধক্..ধক্…ধক্ করছে তো করছে। এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তমাল। অতঃপর দেখে ছায়াটি একসময় ধীর পায়ে চলে যায়……

ভালোবাসার আত্মা

মুগ্ধতা.কম

৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ , ২:৫৯ অপরাহ্ণ

সত্যিই স্বপ্ন ছিল কি

সামিয়ার এখনো আঠারো হতে সাত মাস বাকি। মায়ের গভীর স্নেহ ও বাবার দৃঢ় অনুশাসনে বেরড় উঠতে উঠতে সবে সে ভিতরে একটা স্বায়ত্তশাসন বোধ অনুভব করছে। আজ তার একাদশ শ্রেণির প্রমোশন পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। সে অন্য সকল বিষয়ে বেশ ভালো নম্বর পেলেও জীববিজ্ঞানে অকৃতকার্য। ফল পাওয়া মাত্রই সামিয়া একটা ভীষণ দুঃখ বোধ, ভয় এবং অনিশ্চয়তার দ্বিধায় পড়ে যায়।

বাড়ি ফিরতেই তার সেই  অনিশ্চয়তা সুনিশ্চিত রূপ নিয়ে প্রকাশ পেতে থাকে। তার বাবা উপজেলা কৃষি অফিসার, তিনি সামিয়ার কাছ থেকে এটা মোটেও আশা করেননি। সে প্রথম গ্রেডের নম্বর পাবে তার বাবা এটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু এটাতো তেমনতো নয়ই বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। সামিয়ার বাবা চরম রেগে যান। তার কঠোর রাগের ভাষাগুলো খানিকটা এরকম ছিল, ‘‘এতো টাকা খরচ করছি কীসের জন্য? সমাজে আমার প্রতিপত্তি বলে থাকবে কিছু? তুই বা মুখ দেখাবি কীভাবে? আমার মেয়ে হওয়ার কোনা যোগ্যতাই অর্জন করতে পারিসনি। এর থেকে তো গলা কেটে মরে যাওয়াই ভালো।” এমন আরো কথা বলে খাবার টেবিলে যায় সামিয়ার বাবা। সেদিন সামিয়াকে খেতে ডাকে না পর্যন্ত। খাওয়া শেষে ঘুমতে যায় ওর বাবা,সাথে মাও।

তখন মধ্যরাতের শেষ অংশ। বাহিরে পরিষ্কার মাঝ আকাশে হতে চাঁদটা নুইয়ে পড়েছে খানিক। আর ক্লান্ত শেয়ালের ডাকগুলোও মৃদু হয়ে এসেছে, যেন একদম থমথমে পরিবেশ। আর তখনি সামিয়ার বাবা ঘুম থেকে উঠে কী ভেবে সামিয়ার রুমের দিকে আগান, রুমের দরজা খোলা। ভিতরে গিয়েই দেখেন সামিয়া কিছু একটা লেখা শেষ করে পড়ার টেবিল থেকে উঠছে। উঠেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার দিকে চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। এ চোখ মোটেও ভয়ের নয় বরং ভয় দেখাচ্ছে। সামিয়ার বাবা আস্তে আস্তে এগিয়ে টেবিলের উপরে থাকা কাগজটা হাতে নেয়, তাতে লেখা ” মাফ করো মা,তেমাকে সন্তানের অধিকার থেকে মুক্তি দিলাম, আর বাবা তুমিও। তুমি ও তোমরা সমাজে তোমাদের প্রতিপত্তি দেখলে শুধু, আমায় না।”

পড়া শেষ করা  মাত্রই সামিয়ার দিকে তাকায় বাবা, আর ঠিক তক্ষণি-তক্ষণি  টেবিলের উপরে থাকা ছুরি দিয়ে তার শ্বাসনালী কেটে ফেলে সামিয়া। মুহূর্তেই ঘটে যায় সব। রক্ত যেন ফিনকি দিয়ে পড়তে থাকে। সামিয়ার উষ্ণ রক্তে মুখমন্ডল ভরে যায় সামিয়ার বাবার। লাল রক্তে ভেসে যায় মেঝে। সামিয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় বাবা বাবা বলে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে আগাতে  থাকে। আস্তে আস্তে লুটিয়ে পরে মেঝেতে। সে চোখ বন্ধ করতে থাকে। হয়তো বন্ধ করতে করতে সেও ভাবে, দাইমারা তাকে জরায়ুর প্রাচীর ভেঙে আলোতে নিয়ে এসেছিল এবং আবার হয়তো সবাই ধরে তাকে শুইয়ে দেবে অন্ধকারে, আার এতটুকুর নামইতো  জীবন। তবে এ জীবনেও সে বাঁচার অধিকার হারাল কেন?

এর মাঝেও তার বাবা আগাতে পারেন না, কী একটা ভীষণ বাধায় তার পা মেঝের সাথে আটকে গেছে। তিনি ভাবেন, এগুলোতো তারই কথা, তারই বিষ। তার চোখে পানি আসে না। তিনি বৃষ্টিতে ভেজার মতো করে ঘামতে থাকেন।  এভাবে হঠাৎ মাইকে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সামিয়ার বাবার। ভীষণ ভয় পান তিনি। সব কিছু বুঝে ওঠার পর  দ্রুত পায়ে আগান সামিয়ার রুমের দিকে।তখনো বাহিরে আজানের সুর ছাড়া কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। জানালার পাশে এসে কপাট ঠেলে দেখেন সামিয়া ঘুমোচ্ছে। সামিয়ার বাবার কান্নায় ভেঙে পড়েন, পা ভেঙে আসে,মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ভাবতে থাকেন তবে সত্যিই কি এগুলো স্বপ্ন ছিল? এগুলোর তো সত্যি হওয়ার অভ্যাস আছে রোজ রোজ!

সত্যিই স্বপ্ন ছিল কি

মুগ্ধতা.কম

২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ , ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

শপথ 

মজনুরে…. এ….এ……এ…… মজনু, কোনটে গেলু বাবা। এই আন্দার আইতোত মুই আর কোনটে উটকিবার যাও। সেই সাত বিয়ানায় একনা পন্তা মোকত দিয়া ব্যরে কইল, বাড়ি আসতে দেরি হইবে, য্যান চিন্তা না করো। দিন য্যায়া আইত হইল অ্যালাও দ্যাকা নাই। ছওয়াটাক ধরি আর পওচুন না। ও….. মুকুলের মাও মুকুলকি বাড়িত আলচে। 

 নাই আইসে যে, ছাওয়াগুলা যে এই রাইত বিরাইতে কোটে কোটে ব্যরায় আল্লায় জানে। দ্যাশোত বেলে গন্ডোগোল নাগছে। স্যাক মজিব্যার বেলে দেশটাক স্বাদিন কইরবার কতা কইছে। 

 আরে ওই তকনে তো মোর মাতা বিরবিরাওচে। বুক খ্যান মোচরে ওটোচে। কোটে যে গ্যাল ছওয়াটা।

আসপে আালা মজনুর মাও।গাবুর ব্যাটা তোমার, বিয়াও দেলে কাইলে ছওয়ার বাপ হইবে। উয়াক নিয়া ওতো চিন্তা করার দরকার নাই। সময় হইলে ঠিকে বড়ি আসপে। তোমরা বাড়ি য্যায়া শোত।

 নিন কি ধরে বইনো। ওয় ছারা মোর আর এই দুনিয়াত কায় আছে কওতো। ওয়েতো মোর আন্দার আইতের ন্যামপো। যাও আর একনা উকটি বারি যাও। মজনুরে….এ…..এ…..এ……।

নির্জন আধাঁর রাত। ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। ধোরার পাড় যুব সংঘের ভিতরে থমথমে নিরবতা। দশ বার জন যুবক গোপন বৈঠকে বসেছে। নিরবতা ভেঙেছে কথা শুরু করলো মজনু

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনেই আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি কি করতে হবে। ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙ্গালীর উপর নির্মম হত্যাযোগ্য চালিয়েছে হায়নারা। বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হত্যাযগ্য চালিয়ে যাচ্ছে পাক বাহিনী। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে  গতকাল ২৬ মার্চ চুড়ান্ত ঘোষণা এসেছে স্বাধীনতার। আমাদের মহান নেতাকে পাক বাহিনী গ্রেফতার করেছে। এ অবস্থায় আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। দেশ মাতাকে যে কোন মূল্যেই আমাদের স্বাধীন করতে হবে। আসুন সবাই হাতে হাত রেখে শপথ করি, যত দিন না আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করতে পারছি ততদিন বাড়ি ফিরবো না।  জীবন দিয়ে হলেও দেশকে স্বাধীন করেই ছারবো ইনশা আল্লাহ। দুনিয়ার কোন বাধা আমাদের রুখতে পারবেনা।

বন্ধুগণ, গত কয়েকদিনে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে একত্রিত করেছি। আজ রাতেই আমরা নিসবেতগজ্ঞে ঘাঘট নদীর তীরে সমবেত হব।এবং সমন্বিতভাবে ক্যান্টোনমেন্ট ঘেরাও করে অস্ত্র লুট করব। দেশকে শত্রু মুক্ত করতে আমাদের এই অস্ত্র খুব প্রয়োজনমত।

রাতেই মজনুরা রওয়ানা হয়। সাথে নেয় বল্লম, খুনতি, শুরকি, দা, ছোড়া, কোদালের মত দেশি অস্ত্র। অন্ধকারে তাদের তেজদ্বীপ্ত শরীরে হিংস্রোতা খেলা করে। ভোরের আধো আলোতে তারা ঘাঘট তীরে পৌছায়। সেখানে তাদের মত আরও অনেক মুক্তিকামী মানুষ সমবেত হয়েছে। সবার হাতেই দেশীয় ব্যবহারিক অস্ত্র। কিছু আদিবাসীর হাতে তীর ধনুক। ভোরের আাবছা আলোয় আসলে মানুষের সংখ্যা কমেই মনে হচ্ছিলো। যতই আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে ততই মানুষের ঢলও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। দশ, বিশ, একশত, পাঁচশত, এক হাজার দশ হাজার এভাবে মানুষ বারতেই আছে। সূর্যের আলো ফুটবার আগেই ঘাঘট তীর জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ক্রোধ ঝড়ে পরছে। সবার মুখেই একই বুলি বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। 

 সমবেত জনতা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত অগ্রসর হতে থাকে সেনা ছাউনির দিকে। সবার উদ্দেস্য একটাই ক্যান্টোনমেন্ট ঘেরাও করে অস্ত্র লুট করা। 

অগ্রসরমান জন সমুদ্র দেখে ভয়ে আতকে ওঠে সেনা সদস্যরা। সবাই দিক বিদিক ছুটতে শুরু করে। পাকিস্তানী সেনারা অস্ত্র তাক করে জনতার দিকে। নির্বিচারে মেশিন গান দিয়ে গুলি চালাতে থাকে বাঙ্গলীদের উপরে। প্রাগঐতিহাসিক আমলের অস্ত্র নিয়ে হায়নাদের কাছে পৌছানোর পূর্বেই তারা ঝাকে ঝাকে মাটিতে পরতে থাকে। মেশিন গানের বিকট শব্দে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। পাখির মত মাটিতে ঝরতে থাকে মানুশের লাশ। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে আহত মানুষের প্রাণান্ত চিৎকারে। মানুষের রক্তে ঘাঘটের বুকে রক্তস্রোত নামে।

বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে আহত মানুষের। মূহুর্তেই ঘাঘটের বিস্তির্ণ এলাকা পরিণত হয় হাজারো লাশের স্তুপে।

সূর্যের আলোয় যেন লেলিহান শিখা ঝরে পড়ে। বাহিরে তাকাতে পারেনা মজনুর মা। বুকের ভিতরটা প্রচন্ডভাবে মোচড় দিয়ে ওঠে। অসজ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকেন। নিজেকে খুব একা মনে হয়। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। ছেলের চিন্তায় সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি। যন্ত্রনায় ঢলে পরতে পরতে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে মজনুরে…..এ…….এ…….এ…….এ

গল্প - শপথ

রবীন জাকারিয়া

১২ নভেম্বর, ২০২২ , ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

মেনোপেজকালীন প্রেম

মেয়েটি প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার শেষে দাদা বাড়িতে বেড়াতে আসতো৷ সে আমার ছোট বোনের প্রিয় বান্ধবি৷ দু’বছরের ছোট৷ নাম জবা৷ ওর বাবা একটা স্কুলের শিক্ষক৷ নদী পরিবেষ্টিত পাশের জেলা শহরে থাকলেও যোগাযোগ জটীলতায় সর্বদা যাতায়াত করা যেত না৷ ওরা বেড়াতে আসলে একটানা এক-দেড়মাস থাকতো৷ ছোট বোনের বান্ধবি আবার বাড়ি লাগোয়া৷ যার কারণে ও দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়িতেই কাটায়৷ আমরা ছোট মানুষ৷ তাই সকলে একসঙ্গে খেলি৷ ছেলে-মেয়ের বিভেদ নেই৷ অবশ্য সে সময় এটাই প্রচলিত ছিল৷ ওর সাথে আমার সখ্যতা ছিল বেশ৷ সবসময় কেয়ার করতো৷ খেলতে গিয়ে আমি একটু ব্যাথা পেলে ও কান্নাকাটি করতো৷ সবাই ক্ষ্যাপাতো! কিন্ত আমরা ওসব পরোয়া করতাম না৷ আবার সারাদিন ঝগড়া, মান-অভিমানও চলতো সমান তালে৷ ঝগড়া লাগলে আড়ি দিতাম৷ আবার কিছুক্ষণ পর আড়ি খুলে ফেলতাম৷ আড়ি দেয়া এবং খোলার পদ্ধতিটাও ছিলো বেশ! দুজনের কনিষ্ঠ আঙ্গুল বাঁকা করে লাগালে আড়ি বলবৎ আর বৃদ্ধাঙ্গুল লাগালে আড়ি রদ৷ দিনে পাঁচ-সাতবার তো হতোই৷

এভাবেই সময় চলে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ পরবর্তিতে সে এসএসসি পাশ করে শহরেই কলেজে ভর্তি হলো৷ হোস্টেলে না থেকে দাদা বাড়ি থেকেই কলেজ করতো৷ হোস্টেলে থাকবেই বা কেন নিজের বাড়ি থাকতে?
ও যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো৷ আমি তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে৷ একই কলেজ৷ ইচ্ছে করলে একই সাথে যাতায়াত করা যায়৷ কিন্ত সামাজিক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি৷ ও রিক্সায় যেতো৷ বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে৷ ফনিক্স সাইকেল৷ ডুপ্লিকেট ফনিক্স নয়৷ চায়না ফনিক্স৷ তখন এই সাইকেল ছিল একটা এসেট৷ একটা স্ট্যাটাস৷ আমি রাজকীয়ভাবে সেটাতে করে যাতায়াত করি৷ কলেজে দেখা করি৷ কথা বলি৷ কিন্ত ফরম্যাল৷ অন্যরা বিশেষ করে কলেজে পড়ুয়া পাড়ার অন্য প্রতিবেশিরা কী চোখে দেখে! তাছাড়া এখনতো আর সেই ছোট্টটি নেই৷ কিন্ত বাড়িতে ফিরলে আর ফরম্যালিটির কোন বালাই নাই৷ টোকা-টুকি, কিল-ঘুসি, মান-অভিমান সবই চলে৷ জবা প্রচন্ড অভিমানী আর সাহসি টাইপের মেয়ে৷ যার কারণে এতো বড় হয়েছি তবুও দুষ্টুমি করতো খুব৷ একদিন আমি গোসলখানায় গোসল করতে গেছি৷ আগে গোসলখানাতো এতো বাহারি আর নিরাপদ ছিল না৷ চারিদিকে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দেয়া প্লাস্টার বিহীন ওয়াল৷ উপরে কোন ছাদ নেই৷ দরজাও নেই৷ গোসলখানার ঠিক পাশেই নলকুপ৷ পুরো জায়গাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ ব্যাস! গোসলের কাপড় রাখতে হয় ওয়ালের উপর৷ সেদিনও আমি গোসল শেষে ওয়ালের দিকে হাত দিয়ে দেখি কোন কাপড় নেই! ফাপড়ের মধ্যে পড়লাম৷ বিব্রতকর অবস্থা! এখন বেড়াই কী করে? কাপড়গুলোই বা কোথায় গেল? এমন সময় কলের পাড় থেকে জবা হেসে বলতে থাকলো এখন তুমি নেংটু হয়ে বের হও৷ আমার সাথে মাতব্বরির শাস্তি! অনেক অনুরোধ করলাম৷ শুনলো না৷ বরং বলে উঠলো তুমি সবকিছু ঠিকঠাক ঢেকে রাখো আমি ভেতরে যাচ্ছি৷ কোন মানাই সে শুনলো না৷ গেটহীন গোসলখানায় ঢুকে পড়লো৷ নিজের দুহাত দিয়ে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঢেকে রাখা যায় শুধু সেটাই চেপে ধরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক সুন্দরী তরুনীর সামনে দন্ডায়মান গুহা যুগের এক আদিম পুরুষ (Caveman). নিমিষের ভেতরে আদিম প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো৷ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে জবার হাতটাকে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে আনলাম৷ শক্ত করে চেপে ধরলাম বুকের ভেতর৷ ওর ঠোঁটে এঁকে দিলাম ভালোবাসার উষ্ণ চুম্বন৷ লজ্জায় ও পালিয়ে গেল তখনই৷ প্রথম উপলদ্ধি হলো আমরা একে অপরকে ভালোবাসি৷ এই ঘটনার পর ও দিন দুয়েক আমার সাথে দেখা করেনি৷ না কলেজে আর নাতো বাড়িতে৷

সময় থেকে থাকে না৷ সময়ের সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসার শেকড় প্রোথিত হয় আরো গভীরে৷ দুই পরিবারও ইচ্ছুক যেন আমাদের বিয়েটা দিয়ে সম্পর্কটাকে আরো দৃঢ় করে৷ দিনে দিনে আমরা হয়ে গেলাম আরো সাহসি৷ এখন প্রায় প্রতিদিনই পাড়ার মোড়ে দুজনে নাস্তা খেতে যাই৷ মাঝে মাঝে আমার ছোট বোন থাকে৷ কখনো দুজনেই যাই৷ পাড়ার মোড়ের দোকানে আর কী পাওয়া যায়? পিয়াজু, বেগুনি কিংবা আলু চপ৷ জবার ওগুলোই পছন্দ৷ তাছাড়া তখনো এতো থাই-চাইনিজ রেস্তোরার প্রচলন খুব বেশি হয়নি৷

সবই ঠিক ছিল৷ কিন্ত জবার এক চাচা যিনি খাদ্য অধিদপ্তরে কেরানি পোস্টে চাকুরী করার কারণে অবৈধ টাকার মালিক বনে গেলেন৷ টাকার গরমে আস্তে আস্তে তিনি এবং পরিবারকে প্রতিবেশি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন৷ বাড়ির কাঠামো, লাইফ স্টাইল সবই পরিবর্তিত হলো৷ বন্ধ হয়ে গেল জবার সাথে আমার অবাধ যোগাযোগ৷ কিছুদিন আমরা কলেজেই মেলামেশা করতাম৷ তা-ও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়৷ কথায় বলে যে অর্থ আর ক্ষমতা মানুষকে নেগেটিভ আর উচ্চাভিলাশী করে৷ জবার ক্ষেত্রেও তাই হলো৷

বেশ কিছুদিন কথা বলতে না পারাতে একদিন এক সন্ধ্যায় জবাকে বাড়ির সামনের রাস্তায় জাম গাছটার নীচে আসতে বললাম৷ কথা রাখলো৷ ও যখন আসলো তখন রাস্তাটা ফাঁকা৷ কেউ নেই৷ নেই কোন শব্দ৷ শুধু গাছ থেকে দু’একটা জাম পরার টুপ টুপ আর আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ ছাড়া নীরব চারিদিক৷ ও আসা মাত্রই ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম তুমি কি আমাকে চাওনা? নাকি আর ভালোবাসো না! কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? সে খুব স্বাভাবিক আর শান্ত স্বরে জানালো আমাদের সম্পর্ক আর রাখা সম্ভব নয়৷ কেননা বড় চাচা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন৷ ছেলে সরকারি চাকুরে৷ আমাকে ক্ষমা কোরো৷ বলে চলে গেল৷ আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ একাকী৷ কষ্ট পেয়েছি কিন্ত কাঁদিনি৷ বরং কেন যেন প্রচন্ড শব্দে হেসেছি৷

এরপর সময় বয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ হঠাৎ বাবার মৃত্যু! সংসারের দায়িত্ব, ভাই বোন ও নিজের লেখাপড়া৷ বোনের পাত্রস্থ৷ নিজের একটা চাকুরী৷ সব মিলে একটা ঘোরের মধ্যে সময় চলে গেল৷ সব কিছু গুছিয়ে উঠে যখন বিয়ে করবো দেখি বয়স অনেক হয়ে গেছে৷ কেউ পাশে নেই৷ একা৷ ভীষণ একা৷ শুধু কাঁধে যার প্রেরণার হাত পেয়েছিলাম৷ সে হলো রত্না৷ আমার কাজিন৷ অনেক ছোট৷ কিন্ত ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে৷ রত্না আমার দ্বিতীয় প্রেম৷ জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে ওর হাত দুটি ছিলো আমার শক্তি৷ অন্ধের ষষ্ঠি৷ অনেক স্বপ্নের জাদুকর৷ জীবন সঙ্গীনী৷ দুটি সন্তান নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার৷

আমি একটা মার্কিটিং ডিপার্টমেন্টে জব করি৷ পেশাগত কারণে আমাকে বিভিন্ন জেলাতে থাকতে হয়৷ বাড়িতে থাকা হয় কম৷

জবা মাঝে মাঝে এখনো স্বামী সন্তানসহ এখানে আসে৷ শরীর ভর্তি গহনা৷ রঙ বেরঙের পোষাক৷ কিছু নারীর মধ্যে এই পাগলামো দেখা যায়৷ গহনা আর পোষাক প্রদর্শন করে প্রমাণ করতে চায় যে তারা কত সুখী৷ ওর দুটি মেয়ে৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷ এখন জবার আনাগোনা আরো বাড়তে লাগলো৷

প্রায় মাস খানেক পর বাড়ি ফিরলাম৷ সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়েছি৷ রত্না আর সন্তানদের মতো আমিও ভীষণ খুশি৷ কটা দিন আনন্দে কাটানো যাবে৷ সেদিন শুক্রবার বিকেলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছি৷ একটু ঘুরবো বলে৷ বাড়ির গেটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো জবার সাথে৷ বুকটা ধক্ করে উঠলো৷ বিশ্রী একটা পরিস্থিতি৷ ঘামতে থাকলাম৷ কেমন আছো? বলে জবা পরিবেশটা স্বাভাবিক করলো৷ বললাম ভালো আছি, ধন্যবাদ৷ তুমি? ও মাথা উপর নীচ করে জানালো ভালো আছে৷ আচ্ছা দেখা হবে বলে আমরা বেরিয়ে পরলাম৷ রিক্সায় রত্না বারবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে৷ কারণ আমার আর জবার বিষয়টা ও জানে৷

পরেরদিন সন্ধ্যায় জবা আমাকে সেই জাম গাছটার নীচে দেখা করতে বললো৷ আমি জানালাম এর কোন প্রয়োজন নেই৷ কিন্ত ওর অনুরোধে দেখা করতে গেলাম৷

দুজনে মুখোমুখি৷ দামি পোষাক আর গহনায় মোড়া সামনে দন্ডায়মান জবাকে মনে হচ্ছে যেন শপিং মলে দাঁড়ানো “ডেমো পুতুল”৷ হঠাৎ জবা আমার হাত দুটো ধরে বলে উঠলো তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাস? চলো আমরা নতুন করে জীবন শুরু করি৷ আমি বিশ্মিত! কিছু বলবার আগেই কাঁদো কাঁদো স্বরে ও বলতে শুরু করলো৷ জানো জীবনে আমি কিছুই পেলাম না৷ টাকাওয়ালা ঐ অসৎ বুড়োকে বিয়ে করে জীবনটাই শেষ করে দিলাম৷ তুমি কি আমাকে আগের মতো গ্রহণ করবে? বিশ্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে আমি একবার জবা আর একবার ওর হাত দুটোর দিকে তাকাতে লাগলাম৷ আধো আলো আর আধো অন্ধকারে ওকে কেন যেন রাক্ষুসে মনে হচ্ছে৷ চামড়া কুচকানো আর বলিরেখা ভরা হাত দুটো যেন আমার গলা টিপে ধরবে৷ ভয় নয় বরং ঘৃণায় পিছু হটতে লাগলাম৷ যে নারী একদিন নিজের ইচ্ছায় পছন্দের বিত্তবান মানুষটাকে বিয়ে করলো৷ হোক বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে যার উপার্জিত অর্থে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করলো৷ সংসার করলো৷ আজ তাকেই অপবাদ দিচ্ছে৷ আর বিশ্বাস ঘাতকতা করে অন্যের ঘরনী হতে চায়৷ ৫০ পেরুনো মেনোপেজে পৌঁছানো এক বিকারগ্রস্থ নারীর পরকীয়ার প্রস্তাব আমাকে রত্না’র প্রতি ভালোবাসাকে তীব্র করে তুললো৷ এত কিছুর পরও রাক্ষুসেটাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম মনে মনে৷ কেননা ওর প্রত্যাখানের জন্যই রত্না’র মতো রত্ন আমি পেয়েছি জীবনে৷

এখানে এক মূহুর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না৷ রত্না’র স্যাক্রিফাইজ আর ভালোবাসা ভীষণভাবে উপলদ্ধি করলাম৷ ফিরে যেতে চাই সেই মানুষটার কাছে৷ যে শত বিপদের মাঝে আমাকে দিয়েছে সাহস৷ দিয়েছে নতুন ভাবে বাঁচবার প্রেরণা৷ সেই রত্নার কাছে৷ যেমনটি আগেও ছিলাম৷

আমি দৌড়াতে থাকলাম বাড়ির দিকে৷ অল্প দূরত্ব৷ আমি ঘেমে যাচ্ছি৷ দম কমে যাচ্ছে৷ কিন্ত কোন ভাবেই জবা’র থেকে দূরত্ব বাড়াতে পারছি না৷ সেই মেনোপেজকালীন ডাইনী থেকে যে এই বয়সে এসেও পরকীয়া প্রেমের প্রস্তাব দেয়৷

(লেখক কর্তৃক আপলোডকৃত। অসম্পাদিত)

গল্প-মেনোপেজকালীন প্রেম রবীন জাকারিয়া
268 Views

রবীন জাকারিয়া

১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ , ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ

সুন্দরী তরুনী

(লেখক কর্তৃক আপলোড করা লেখা। অসম্পাদিত।)

তরুনীটির বাবা স্থানীয় একটা মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম ছিলেন৷ সৎ আর ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী লোকটা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন তাঁর মাদরাসাতেই৷ স্ত্রী সন্তানদের ধর্মীয় বিধি বিধান, পোষাক-পরিচ্ছদ, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন৷ পরিবারের সকলেই তা হাসিমুখেই পালন করতো৷ বড় মেয়েটি বিজ্ঞান বিভাগে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে৷ মাস্টার্সের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে এমন সময় গত বছর তরুনীটির বাবাকে জঙ্গী সন্দেহে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়৷ পরদিন থানায় বাবার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলো পুলিশ গতকাল কাউকেও তুলে আনেনি৷ হয়তো কেউ ভূয়া পরিচয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে৷ তাদেরকে বলা হলো একটা মিসিং কেস করে রাখতে৷ পুলিশ তদন্ত করে এর সমাধান দিতে পারবে৷

বাবা হারানো দরিদ্র পরিবারের তরুনীটি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো৷ মা, ছোট দুই ভাই-বোন, আর তার লেখাপড়া খরচ এবং সংসার চালাবে কী করে?
বাবা বেঁচে থাকতেই মাদরাসায় যাওয়া ছাড়া বাহিরে তেমন একটা বের হতোনা৷ বের হলেও হিজাব পড়তো সব সময়৷ ফর্সা, লম্বা আর আকর্ষনীয় তরুনী বের হলেই পাড়ার বখাটেরা টোন করতো৷ শিষ দিতো৷ বলতো ইরানী গোলাপ কিংবা কাশ্মিরি সুন্দরী আরো কত কী৷ সে এড়িয়ে যেত৷

কিন্ত এখন এতসব ভাববার সময় তার নেই৷ সংসারের হাল ধরতে হবে৷ সংসার, ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া৷ তাই সে প্রথমের দিকে কিছু বাড়িতে কুরআন শিক্ষার প্রাইভেট পড়ানো শুরু করলো৷ কিন্ত বেতন খুবই কম৷ মাসে পাঁচশত টাকার বেশি কেউ দিতে চায়না৷ তাতে সংসার চলেনা৷ তাই সে গণিত, ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর কয়েকটা টিউশনি করাতে লাগলো৷ বাঁধ সাধলো স্টুডেন্টরা৷ হিজাব পড়া থাকলে নাকি তারা ভয় করে৷ তরুনীটি নেকাবটা খুলে পড়াতে লাগলো৷ স্টুডেন্টদের বাবাদের বাজে দৃষ্টি তার এড়ায় না৷ এড়ায়না শিক্ষার্থির মায়েদের চোখ৷ কিছুদিন যেতে টিউশনিগুলি হারিয়ে ফেলে৷ কেননা সে সুন্দরী তরুনী৷

দারিদ্য মানুষকে জেদী করে তোলে৷ ফলশ্রুতিতে তরুনীটি একটি প্রতিষ্ঠানে সেলস গার্ল হিসেবে চাকুরি পায়৷ প্রতিষ্ঠানের ড্রেসকোড অনুসারে তাকে শুধু নেকাব নয় হিজাবটাও খুলতে হয়৷ এখানে সুন্দর করে শাড়ি ও প্রসাধন ব্যবহার করে কাস্টমারদের আকর্ষন করতে হয়৷ বেতন ভালই ছিলো৷ তবে অফিসটাইমটা বেশি৷ সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত৷ তবুও তাকে করতেই হবে৷ তা নাহলে সবাইকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে৷
প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস আর সততার সাথেই সে চাকরিটা করছিলো৷ কিন্ত ম্যানেজার প্রতিদিন তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে৷ সে এড়িয়ে যেতো৷ কিন্ত একদিন অফিস ছুটির পর ম্যানেজার তাকে শারিরীক লাঞ্চিত করতে উদ্যত হওয়ায় কোনভাবে পালিয়ে বাঁচে সুন্দরী তরুনীটি৷

ভাগ্যক্রমে একদিন এক বড় কর্পোরেট অফিসে বসের পিএস হিসেবে চাকরি পেয়ে যায় সে৷ বেতন এতবেশি হবে তা কখনো কল্পনাই করেনি তরুনীটি৷ নতুন অফিস৷ নতুন আইন৷ নতুন ড্রেস কোড৷ এখানে পিএসের ড্রেস কোড হলো স্কাট ও টপস কিংবা প্যান্ট ও শার্ট/টিশার্ট৷
তরুনীটি নতুন আদলে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে থাকে৷ কেননা তার হাতে কোন অপশন নেই৷ আধুনিক আর বাহারি সজ্জায় সজ্জিত অফিস৷ অভিজাত আর কেতাদূরস্ত পোষাকে আবৃত পরচুলায় ঢাকা এক মধ্য বয়সি পৌঢ় যেন জোর করে নিজেকে যুবক প্রমাণে সদা তৎপর৷ কাজে অকাজে নিজের চেম্বারে ডেকে গুলতানি আলাপটাই যেন তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ কথার ফাঁকে বস কিছু যেন ইঙ্গিত দেয়৷ না বোঝার ভান করে তরুনীটি৷ ক্ষিপ্ত বস চোখের ইশারায় যেন বোঝাতে চান এর বদলা নেবো৷

কিছুদিন পর অফিসে বিদেশি একটা ডেলিগেট টিম আসলো৷ তারা এই প্রতিষ্ঠানের ফিসিবিলিটি, ভিজিবিলিটি ও সক্ষমতা যাচাই করবেন৷ ইতিবাচক হলে জয়েন ভেঞ্চার ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করবে৷ অফিসে সাজ সাজ রব৷ সকলে ব্যতিব্যস্ত৷ কনফারেন্স রুমে ডেলিগেট টিমের সাথে বস মিটিং করছেন৷ ইন্টারকমে টেলিফোন পেয়ে তরুনীটি সকলের জন্য স্ন্যাক্স ও ব্ল্যাক কফি পরিবেশন করে চলে আসবে কিন্ত বস বসতে বললেন৷ তরুনীটি বসলো৷ পরিচিতি পর্বের ভাষাটা বুঝতে পারলেও পরের সংলাপগুলো বুঝতে পারেনা তরুনী৷

বস বিদেশিদের আস্বস্থ করে যে তাঁদের সমস্ত এন্টারটেইনের ব্যবস্থা করা আছে৷ আর এই দায়িত্বটা পালন করবেন আমাদের পিএস৷ সেদিন রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারেনা তরুনীটি৷

পরেরদিন খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়৷ মৈত্রি সেতুর রেলিংয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বস্তাবন্দী এক সুন্দরী তরুনীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ৷

সুন্দরী তরুনী
404 Views

মাসুম মোরশেদ

৪ জুন, ২০২২ , ১২:২০ পূর্বাহ্ণ

সাবালক

ডিগ্রীতে পড়ি। বয়স কুড়িমতো হইবে। দুরবিন দিয়া খুঁজিয়া সারা মুখে কতক বাদামী পশম দেখিতে পাই। আমার নাকের নিচে, ডানে বামের অনুর্বর অঞ্চলে কিছুই জন্মায় না। নিজেকে বড় নাবালক লাগে। ডিগ্রীতে পড়া ছেলেদের কারো কারো ঝাঁকড়া চুল তাহাতে আবার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কেতাদুরস্ত ভাব লইয়া প্যান্টের ব্যাকপকেটে ভাঁজ করা রেখা খাতা লইয়া যখন কলেজে আসে, মাঠে ঘোরে, কলেজের পুকুরপাড়ে তাসের আড্ডায় চুল ঝাঁপিয়ে ট্রাম্পকার্ড ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করে কিংবা মেয়েদের দলে বসে বাদাম খুলটে ফুঁ দেয়- আমি ছেলে মানুষটা সেইসব ছেলেদের প্রেমে পড়িয়া যাই। ভাবি, আমার ইহজীবনে কিছুই হইবে না। ক্লিনশেভড মুখ আর সাথে তেমন ঝুলপি চুল যদি রাখিতে পারিতাম তবে আমার মতো সুখী মানুষ বুঝি কমই হইত। কিন্তু তেমন করিয়া রাখিতে পারিব না, কারণ বাবা তাহা পছন্দ করিবেন না। তিনি কঠিন ধাতের মানুষ। অতিবাস্তববাদী লোক। তিনি নিজে সর্বদা ক্লিন শেভ করিয়া থাকেন। তাই সেটাতে অসুবিধা হইবার কথা নহে। তাই সাবালকত্ব লাভের জন্য সেটার চিন্তা করিতেছি।

দোয়ানী বাজারের আজিজুল আমার বাল্যবন্ধু। ও যখন ক্লাশ নাইনে পড়ে তখন ওর সারামুখে ঘনকালো দৃশ্যমান দাড়ি, মোচ। আমি তখন ইন্টারমিডেয়েট সেকেন্ড ইয়ার। খুব বড়রা বাদ দিয়ে পাড়ায় কোন সিনিয়র জুনিয়র নাই। সবাই ভাইভাই, বন্ধু বা বন্ধুর মতো। কীভাবে যেন তাহার সাথে খুব ঘনিষ্ট হইলাম, জানি না। সেই স্বল্পবয়সেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। ঠিক সেসময়ই আফসোস করিতাম, আহা, আমার যদি এই মুখখানা হইত! শুধু হাপিত্যেস করিতাম আর ভাবিতাম, কখনো কী আমার তেমন হইবে? ডানহস্তে, বাঁহস্তে নিজের বদনখানি নাড়িচাড়ি আর ভাবি, আমি কি তবে বড় হইবো না?

সেইসবদিনে হকবাজারের বিখ্যাত ভোলা নাপিত যখন বন্ধুর চুল, দাড়ি কাটে আমি অপলক চাহিয়া থাকিতাম। অন্য চেয়ারে বসিয়া মাঝেমধ্যে প্রমানসাইজ আয়নায় আমার নিরসবদনখানি দেখিতাম আর মনে মনে প্রার্থনা করিতাম যেন দ্রুত আমারো তাহার মতো হয়।

কিন্তু যাহা তাহাই! যাহার হয় তাহারই হয়। আমার তাহা নহে।

বন্ধু আমার দুঃখ বোঝে। আমি তখন বি, এ ফার্স্ট ইয়ার। আর সে পড়ালেখা বাদ দিয়া বাড়ির সামনে মুদিখানা দিলো। বিকাল, সন্ধ্যায় তাহার দোকানে আড্ডা মারি আর তাহার সোনাবদনখানি দেখে দেখে কতশত গল্প করি। কথাচ্ছলে সে-ই একদিন বলিল, “শেভ কর্। দুই-চারিবার ক্ষুর পড়িলে প্রচুর গজাইবে।” কথাখানা একান্তই আমার মনের কথা। তাই মনে ধরিল। এই না হইলে বন্ধু কিসের! বন্ধুই তো বন্ধুর গোপন কথা, মনের ব্যথা বুঝিবে, স্বাভাবিক।

ভাবিলাম, তথাস্তু!

বন্ধু যেহেতু মুদিখানা সামলাইতে ব্যস্ত। তাহার আর আমাকে সঙ্গ দেবার সময় নাই বা অযথা ঘোরাঘুরি তাহার শোভা পায় না। তাহার সাথে প্লান প্রোগ্রাম ঠিক করিলাম বটে, কিন্তু একাই যাইতে হইবে এবং তা-ই সাব্যস্ত করিলাম।

বাড়ি হইতে তিন কিলোমিটার দূরে খানসামা হাট। সেইদিকে যাইব। শুক্কোরবার আর সোমবার হাটবার। হাট শুরু হয় দুপুরের নামায বাদ। সেই হাট জমাইয়া তুলিবার জন্য কাজকারবার শুরু হয় সকালবেলা থাকিয়া। ধোয়ামোছাসহ ইত্যকার কাজ। বাঁশের ফোল্লা (ব্যাঙ্ক) কাটিয়া লুঙ্গির খোঁটে ত্রিশ টাকা রাখিলাম। আমাদের বাজারের নাপিত চুলদাড়ি শেভ করা পাঁচ, ছয় টাকা নেয়। শুধু দাড়ি শেভ করিতে তিন টাকা লাগিত। কেউ কেউ দুই টাকাও দিয়া থাকেন। নাপিতরাও সেই টাকা কপালে ঠেকাইয়া ক্যাশবাক্সে রাখিতেন। খানসামায় যদি অনেক বেশি চায় বা নেয়, তাই অপদস্ত হইবার ভয়ে ত্রিশ টাকাই লুঙ্গির কোঁচে রাখিলাম। এখানে বলিয়া রাখি, আমাদের ছাত্রাবস্থায় গ্রামাঞ্চলে তখনো ফুলপ্যান্ট পরে ঘোরার চল শুরু হয়নি। শহরে চলে সেটা বেশ। তবে দুইএকজন, যাহারা শহরে পড়িত, হোস্টেলে বা মেসে থাকিত, সেই সময় তাহাদের কেউ কেউ গ্রামে আসিলে প্যান্ট পরিয়া বেড়াইত। অবশ্য আরামকে ভুলিয়া সেটা মেয়েদের দেখানো বা উন্নতজাতের ছাত্র হিসেবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতে তাহা করিত। কিন্তু আমরা যাহারা নিয়মিত গ্রামে থাকি তাহারা কখনো নয়। এমনকি শহরে সিনেমা দেখিতে যাইতাম লুঙ্গি পরিয়া। অন্য আরেকটা সত্য হইল আমাদের কেহ কেহ লুঙ্গি পরেই কলেজে ক্লাশ করিত পিছনে বসিয়া।

যাইহোক, বিভিন্ন ঘোরা পথ ব্যবহার

মাসুম মোরশেদের রম্যগল্প -মাসুম মোরশেদ

রবীন জাকারিয়া

৪ জুন, ২০২২ , ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

কোডাক ক্যামেরা

শাহেদ ভীষণ বিরক্ত হয়ে আছে৷ সারাটা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও সে তার অত্যন্ত একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না৷ ভয়াবহ ব্যাপার! ওটার ভেতরে নিজের সমস্ত একাডেমিক সার্টিফিকেট, বাড়ির মূল দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখা আছে৷ ফাইলটার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই সে ফাইলের কভারে মার্কার পেন দিয়ে বড় বড় হরফে লিখে রেখেছে “কাগজপত্রের মূলকপি”৷ অথচ এখন উধাও৷ সে কখনো এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়৷ জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি৷ সে এত পরিপাটি যে কোন জিনিস কোথায় আছে তা অন্ধকার বা বিদ্যূত চলে গেলেও বের করতে পারবে৷ কয়েল, মোমবাতি, দিয়াশলাই কিংবা টর্চলাইটটা কোথায় রাখা আছে তা ওর নখদর্পনে৷ কিন্ত এখন সে কোনোটাই জায়গামত পায় না৷ এটা শুরু হয়েছে বিয়ের পর থেকে৷ এখনকার বউরা কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে চায় না৷ শুধু দায়সারা কাজ৷ দরজার চাবিটা ঠাশ করে কোথায় রাখল সেটাই খুঁজতে নষ্ট করে ফেলে আধা ঘন্টা৷ শাহেদ এত বলে সঠিক স্থানে রাখ দেখবে তোমারই সুবিধা হবে৷ কিন্ত কে শোনে কার কথা৷ গত তিরিশ বছর ধরে একই চিত্র৷ বদলায় না কিছুই৷ না অভ্যাস আর না ভোগান্তি৷ অথচ আমাদের মায়েরা কত কষ্ট করে সংসার চালাত৷ সীমিত আয় আর অনেক সন্তানসহ যৌথ পরিবারের সীমাহীন কাজ শেষেও সবকিছু ছিল তাদের নখদর্পণে৷ তাঁরা সংসারটাকে Own করতেন৷ কিন্ত এখনকার মেয়েরা তা করে না বোধ হয়৷

শাহেদ কিছুটা সময় খোঁজাখুঁজিতে ক্ষান্ত দিলো৷ মেজাজটাকে ঠান্ডা করে চিন্তা করল৷ নতুন করে খুঁজতে হবে৷ যেভাবেই হোক ফাইলটা তাকে পেতেই হবে ৷ কারণ ঐ ফাইলে রাখা কিছু কাগজপত্র তার খুবই জরুরি৷ আর কিছুদিনের মধ্যে তাকে LPRএ যেতে হবে৷ সরকারি প্রসিডিউর মেইনটেইন আর কাগজপত্র সাবমিট করতে করতে এমনিতেই তার ত্রাহি অবস্থা৷ এর মধ্যে ফাইল খোঁজাটা যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া৷

বেশ কিছু পর শাহেদ আবারো ফাইলটা খোঁজা শুরু করল৷ বইয়ের আলমারি, ফাইল কেবিনেট এবং অবশেষে স্টিল আলমারি৷ পাওয়া গেল সিন্দুকের ভেতর৷ নিশ্চয়ই এটা তার স্ত্রী শেলী এখানে এনে রেখেছে৷ এটা নিশ্চিত আর যাই হোক সিন্দুকে সে ফাইলটা রাখেনি৷ রেখেছিল স্টিল আলমারিতে৷ যাক পাওয়াতো গেল৷ টেনশন কমলো৷ সে ফাইলটা বের করতে যাবে এমন সময় তার চোখে পড়ল ক্যামেরাটা৷ অনেক পুরোনো দিনের কোডাক ক্যামেরা৷ যেগুলো দিয়ে ছবি তুলতে ‘ফিল্ম রোল’ এর প্রয়োজন হতো৷ সেসময় ফুজি ফিল্ম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ এখনতো সব ডিজিটাল৷ আর সকলের হাতেই ক্যামেরা৷ মোবাইলে ক্যামেরা৷ ডিজিটাল ক্যামেরা কত কী! কিন্ত সে সময় একটা ক্যামেরা মানে একটা এসেট৷ আভিজাত্য৷ লোকে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমন করত অনেকটা গর্বের সাথে৷ পিকনিক কিংবা কোন অনুষ্ঠানে বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের কাছ থেকে ক্যামেরা ধার করে সকলে চাঁদা তুলে ফিল্ম কেনা হতো৷ এরপর সকলে সমানুপাতিক হারে ছবি তুলত৷ গ্রুপ ছবি৷ সিঙ্গেল ছবি৷ সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো ক্যামেরা সামনে ধরার আগে পর্যন্ত সকলে নরমাল থাকত৷ কিন্ত ছবি তোলার সময় কেন যেন সকলেই নার্ভাস হয়ে যেত৷ দাঁড়ানো, হাত দুটো সঠিকভাবে রাখা কিংবা মুখের হাসি সবকিছুই অস্বাভাবিক হতো৷ সে সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টাইলটা ছিল দুই বন্ধু হ্যান্ডশেকরত অবস্থায় ছবি তোলা৷ যার কারণে বেশিরভাগ ছবি ভাল হতো না৷ অবশ্য সে মূল্যায়ন করবার সক্ষমতাও ছিল না৷

একটা রিল ফিল্ম দিয়ে ৩০-৩৫টি ছবি তোলা যেত৷ তারপর ফিল্ম ডেভেলপ৷ পরিশেষে ল্যাবে ছবি ওয়াশ৷ আহ্ কী সময় ছিল৷ শাহেদ ক্যামেরাটা দেখতে পেয়ে নস্ট্রালজিক হয়ে পড়লো৷ মনে পড়লো কীভাবে সে ক্যামেরাটা কিনেছিল৷ স্বপ্ন থাকলেও বেকার শাহেদের পক্ষে ক্যামেরা কেনা অসম্ভব ছিল৷ একদিন এক বন্ধু ওকে সেটা কিনতে বলায় সে হাসি দিয়ে বলেছিল “আমাকে বিক্রি করলেও ওটা কিনতে পারব না৷ অসম্ভব! তখন বন্ধুটি জোর করে ওর হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বলেছিল তুই যা পারিস তাই দে৷ দরকার হলে পরে টাকা দিস৷ তবুও এই অলক্ষুণে জিনিসটা তুই নিয়ে নে৷ শাহেদ বলল, অলুক্ষণে মানে কী? বন্ধুটি বললো এটা অভিশপ্ত ক্যামেরা৷ এটা দিয়ে প্রথম যে ছবিটা তুলেছি সেটা হলো আমার মায়ের৷ ছবি তোলার দু’দিন পর মা হঠাৎ মারা গেলেন৷ শাহেদ হেসে বলল এতে কি প্রমাণ হয় এটা অভিশপ্ত? বন্ধুটি বলল আরেকটি কারণ আছে৷ সেটা হলো এর লুকিংটা কেমন ভূতুরে আর মাঝে মাঝে নিজে থেকেই “ক্লিক” শব্দ করে উঠে৷ আমার ভয় করে৷ এখন তুই নিলে নে৷ নাহলে এটা ভেঙে ফেলব৷ শাহেদ এসব আজগুবি আর ভূতুরে গল্পে বিশ্বাসী নয়৷ তাই সে ক্যামেরা নিল৷

মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনের কথা৷ যেদিন শাহেদ ফিল্ম লোড করে ক্যামেরাটা নিয়ে বাড়িতে এলো৷ তা দেখে আব্বা-মা, ভাই-বোন সকলে খুশি৷ আমার একটা ছবি তোল, আমার একটা ছবি তোল বলে সবাই হুড়োহুড়ি৷ কিন্ত শাহেদের এক কথা এটা দিয়ে প্রথম ছবি তুলবো আব্বা-মা’র যুগল ছবি৷ তারপর অন্যদের৷ আব্বা কেবল অফিস থেকে ফিরেছেন৷ তাঁদেরকে বলা হলো ভাল ড্রেস আর একটু মেকআপ করার জন্য৷ বাবা স্যুট-টাই পরলেন৷ আর মাকে শাহেদের বোন সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরিয়ে আর সাজিয়ে নিয়ে এলো৷ সব রেডি৷ ছবি তোলার স্পট পছন্দ হচ্ছিল না৷ অবশেষে বাড়ির ভেতর ছোট্ট গোলাপ বাগানের মাঝে তাঁদের বসানো হলো৷ ছবি তোলার ঠিক আগ মূহুর্তে তার বাবা বলে উঠলেন, তোল৷ ভাল করে ছবিটা তুলে রাখ৷ এটাই জীবনের শেষ ছবি৷ এ কথা শোনামাত্রই শাহেদের মা ভীষণ রাগান্বিত হলেন৷ বললেন, এসব কী অলুক্ষণে কথা বলো? মন খারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি উঠে চলে গেলেন৷ বললেন তিনি আর ছবিই তুলবেন না৷ শত চেষ্টা করেও তাঁর ছবি তোলা হলো না৷ আচমকা এমন ঘটনার ফলে সেদিন ঐ একটি ছবি ছাড়া আর কারোরই ছবি তোলা হলো না৷ আনন্দটা নষ্ট হয়ে গেল৷

দু’দিন পর শাহেদের বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন৷ বাবার মৃত্যুর পর সংসার, জীবন-জীবিকার তাগিদে সকলে ক্যামেরার কথা ভুলেই গেল৷ এমনকি শাহেদও৷ আজ প্রায় তিরিশ বছর পর ক্যামেরাটা দেখে সবকিছু যেন ছবির মত ভেসে উঠল৷ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ কৌতুহল বশে শাহেদ ক্যামেরাটাকে হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ আজ বন্ধুর কথাটা সত্য মনে হলো৷ আসলেই এটা দেখতে কেমন ভূতুরে৷ সে এগুলো পাত্তা দেয় না৷ পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই৷ এমন সময় ক্যামেরার সাটারটা একাই ক্লিক করে উঠলো৷ যেন কেউ একজন একটা চোখ টিপে দিলো৷ শাহেদ মজা পেল৷ ফিল্ম না থাকার পরও সে তাই মোবাইলে সেলফি তোলার মতো করে একবার ছবি তোলার বাটন চাপলো৷ এরপর খুঁজে পাওয়া ফাইলটা বের করল৷ আর আলো বাতাসে রাখবে বলে ক্যামেরাটা ড্রইং রুমের খোলা বুক শেলফে রেখে দিলো৷

দু’দিন পর শাহেদের বাড়িতে প্রচুর লোকের সমাগম৷ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কলিগ, পাড়া-প্রতিবেশিতে ভরপুর৷ হঠাৎ স্ট্রোক করে শাহেদ আজ মারা গেছে৷ অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ কেউ মানতে পারছে না৷ সকালেও সুস্থ্ একটা মানুষ ফজরের নামাজের পর জগিং শেষে ফ্রেকফাস্ট সারল৷ হালকা রসিকতা আর কথাবার্তায় পরিবারের সকলকে আনন্দে ভরে দিলো৷ অথচ হঠাৎ নেই হয়ে গেল৷

চারিদিকে কান্না আর হাহাজারিতে সারাটা বাড়ি বেদনায় ভরপুর৷ লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এসময়ে কান্নার বাঁধ যেন আরো ভেঙে পড়ল৷ কত লোক যে শেষকৃত্যের জন্য এসেছে তার হিসাব নেই৷ সকলেই পরিচিত নয়৷ বেশিরভাগই অচেনা৷ লাশ কাঁধে তোলার সময় চিৎকার শুনে এক তরুণ ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে এলো৷ হাতে একটা শপিং ব্যাগ৷ লাশের পিছু পিছু এলোমেলোভাবে পা ফেলে হাঁটছে তরুণ৷ ওকে দেখে সকলে দুঃখ পাচ্ছে এই ভেবে যে সে হয়তো মরহুম শাহেদের নিকটাত্মীয়৷ তাই সে কষ্টটা নিতে পারছে না৷ ধীরে ধীরে সেই তরুন একটা সময় লাশ দাফনের লাইন থেকে বেরিয়ে অন্য পথ ধরে৷ হাতে থাকা শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে “ক্লিক” শব্দটি কানে পৌছায় না মাদকাসক্ত সেই তরুণের৷ যার ফলে সে বুঝতে পারলো না শপিং ব্যাগে করে চুরি করা জিনিসটা শুধু কোডাক ক্যামেরা নয় বরং অদ্ভূতুরে ও অভিশপ্ত এক সিরিয়াল কিলার৷ আর যার পরবর্তী নিশানা হয়তো সে-ই৷

 

রবীন জাকারিয়ার গল্প - কোডাক ক্যামেরা

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

২৯ মে, ২০২২ , ১০:১৭ অপরাহ্ণ

প্রযত্নে নীলা

লোকটার বয়স কত হবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চুল, দাড়ি এমনকি ভ্রু পর্যন্ত সাদা। মারুফের ধারণা বয়স ৭৫ বছর তো হবেই। কথা বলার সময় দাঁত দেখা যাচ্ছে না, তাই দাঁত আছে না নাই, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে উচ্চারিত কথা ভেসে আসার সময় শব্দই বলে দিচ্ছে সামনের দাঁত কয়েকটা তার নাই। এই খেলাটা খেলতে মারুফের ভালো লাগে।  সামনের যে কোনও একজন লোক সম্বন্ধে ধারণা করতে। সবসময় মেলে না তবে মারুফ দেখেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যায়। লোকটা রসিক, লোক না বলে বৃদ্ধ বলাই মনে হয় ভালো। বৈকুন্ঠপুরের এই জৈষ্ঠের দুপুরে কাঁঠাল গাছের নিচে টং এ বসে লোকটার কথা শুনছে মারুফ। এদিকে কখনো আসা হয়নি আগে, যদিও রংপুর শহর থেকে বারো -তেরো কিলোমিটার দূর, তারপরও। সে এসেছে একটা বইয়ের পার্সেল ডেলিভারি দেবার জন্য।

প্রযত্নে,
নীলা, বৈকুন্ঠপুর, রংপুর।

এটুকুই ঠিকানা, সাথে মোবাইল নম্বর। প্রেরকের ঠিকানাটাও অদ্ভুত, শুধু লেখা-

প্রেরক,
নীল আর মোবাইল নম্বর।

নাম দুটো দেখে হাসি পায় মারুফের। নিশ্চিত নকল নাম। আসলে সম্পর্ক দানা বাঁধে না বলেই গোপন নাম প্রকাশ্যে চলে আসে। গোপন নামে সেও তো ডাকত সুলতানাকে, নয়না নামে। নয়না কেমন আছে? কতদিন পর তার নাম মনে পড়ল। পেটভাতে একটা চাকরি করে আর যাই হোক মনে প্রেম আসে না।

আহ,আজ এত গরম। বৃদ্ধ এখন সাপের গল্প বলছে। বুঝলা মিয়া, বলাটা কানে মনে হলো, ভুজলা মিয়ারা। মুই সাপের মনি দেখছুনু একবার বাঁশের ঝাঁড়োত। চইত মাস, মুই তখন চেংড়া মানুষ। রাইত বারোটার সম কতাকলি সিনেমা হলোত রুপবান ছিনেমা দেখি আসছুনু। মোর বাড়ির গোড়ত একখান বড় বাঁশের ঝাড় আছিল। ওটা পার হয়ে মোর বাড়ি। এলাও নাম আচে ওটার, আন্ধার বাঁশের তল। দিনের বেলাতো ওটে সূর্যের আলো ঢুকছিল না। ডাকাতের ভয়ত লোকজন এটে রাইতোত আইসে না। মুই তখন তাগড়া জোয়ান, এক বসাত একখান কাডোল খায়া খেলবার পারছুনু। মোর অতো ভয় আছিল না। বাঁশের আড়াতের মাজের রাস্তা দিয়া যাওছুনু। এটুকু বলেই মারুফের মুখের দিকে তাকায় বৃদ্ধ। একটু ঘোলা চোখ।চোখে কি ছানি আছে? মনে হয় আছে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করে,তোরা ক্যায় বাহে? তোমাক তো চিননো না?

আমি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করি। একটা পার্সেল ডেলিভারি দিতে আসছি, বলে মারুফ। আপনার গল্প শুনছি, খুব মজা করে গল্প বলতে পারেন আপনি।

এই ছ্যামড়া কয় কি? এগুলা গল্পো নোয়ায় সত্যি ঘটনা।

পাশে বসা লোকজন অধৈর্য হয়ে ওঠে, আরে তোরা থোন তো আন্দাসুন প্যাচাল। গল্পোটা শ্যাষ করেন।

বৃদ্ধ মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে। নিশ্বাস নেয় শব্দ করে, মাথা কাঁধ ওঠানামা করে দ্রুত।

কী হইল তোমার বাহে? ঘুমাইনেন নাকি?কতা কন না কেন তা?

বৃদ্ধ মাথা নিচু করে আরও, চিবুক মিশে যায় বুকের সাথে। কোনও দিকে খেয়াল নাই।

টং এর সামনের চায়ের দোকানদার বলে, বুড়া ঘুমি গেইছে। এলা উয়াক চা, বিস্কুট, পান না খওয়াইলে কতা কবার নয়।

ধান কাটামারা শেষ। লোকজনের হাতে টাকা আছে। বিকালে নতুন চামড়ার সেন্ডেল আর প্রিন্টের শার্ট পরে শ্যামপুর বন্দরে যায়। চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করে দেশ, ধর্ম আর নারীদের নিয়ে। শ্যাখের বেটি কী করলো, কী করা  দরকার ছিল এসব নিয়ে জোর আলোচনা হয়। চৈত্রের এই দুপুরে বাসায় থাকা কঠিন, আড্ডা বসেছে তাই এই টং এ।

রহিমুদ্দিন গজগজ করে লুঙ্গির কোচায় হাত দিয়ে টাকা বের করে। চা দিতে বলে দোকানদারকে।

বেশ জোরেই চায়ের অর্ডার দেবার কারণেই কি না, বৃদ্ধ জেগে ওঠে। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, মাঝ ঘাটাত আসি দ্যাকো আলো আর আলো, বাঁশের তলা উজাল হয়া গেইছে। একনা আগে গিয়া দেখো, দুইটা সেইরম বড়ো সাপ মারামারি করোচে আর একখান পাথর থাকি সেই আলো বেরাওচে। মুই বুঝবার পারনু এটা সাপের মাথার মনি। মুই আগবার গেনু, সেই শব্দ করোচে, ফোঁস ফোঁস শব্দোত, কান তালা নাগি যাবার অবস্থা। দৌড়ি বাড়ি চলি গেনু। হুড়োহুড়ি করি একখান ডালি নিয়া ফির আসি দ্যাকো কোনো কিছুই নাই। খালি ঐ জায়গাটা পুড়ি কালা হয়া গেছে। মুই ছুটাছুটি করনু, এপাক, ওপাক, কিছুই নাই। গলা জড়িয়ে আসে বৃদ্ধের, আবারও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পরে। কয়েক মুহুর্তেই আবার গা ঝাড়া দিয়ে, চায়ে চুমুক দিয়ে শব্দ করে, আহ্। মাথা দোলায়, চোখ বন্ধ করে।

তারপর কী হলো? মারুফ অধৈর্য হয়ে বলে বসে। বলেই লজ্জা পায় কিন্তু কেউ বিষয়টা খেয়াল করে না, যেন এ প্রশ্নটা সবার।

মোবাইল বেজে ওঠে, লক্ষ্য করে দেখে নীলা ফোন দিয়েছে।

হ্যালো, ম্যাম আর কতক্ষণ বসে থাকব?

আপনি কোথায়?  এই তো বৈকুন্ঠপুর, পুটিমারিতে একটা চায়ের দোকানে।

আরে ওখানে গেছেন কেন? আপনাকে না বললাম, জোদ্দার পাড়ায় আসেন।

ওহ্, আমি তাহলে শুনতে ভুল করেছি।

আসেন, তাড়াতাড়ি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

মারুফ তবুও বসে থাকে, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সবার মতো বৃদ্ধের দিকে। তার তাড়া আছে আরও একটা প্যাকেট ডেলিভারি দিতে হবে। নীলা অপেক্ষা করছে নীলের পাঠানো প্যাকেটের জন্য। জনা দশেক লোক আর চায়ের দোকানদার সবাই চুপ করে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে, গল্প শুরুর। বৃদ্ধ মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

প্রযত্নে নীলা - ফেরদৌস রহমান পলাশ

মুগ্ধতা.কম

২৯ মে, ২০২২ , ১০:০৬ অপরাহ্ণ

পরমাণু গল্প

করোনা পজিটিভ

বাবা, আমার করোনা পজিটিভ হলে কি আমাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসবে?
ছেলের এমন প্রশ্ন শুনে বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে, ‘না বাবা, কোনদিনও না, কখনোই না। বাবারা কখনোই ছেলে-মেয়েদের বোঝা মনে করে জঙ্গলে ফেলে আসে না। বাবা তুমি বাড়ি থেকে বের হবে না, তাহলে তোমাকে করোনা ধরতেই পারবে না।’

_______________________________

এন্ড্রয়েড মোবাইল 

শিলা ও সাগরের ডিভোর্স হয়ে গেলো আজ। সাগরের উপহার গুলো ফেরত দিলো শিলা। ফেরত উপহারের মাঝে  স্বামীর দেওয়া শেষ উপহার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটিও ছিলো। যা ডিভোর্সের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

___________________________

ঘুষখোরের লাশ

সারাজীবন ঘুষ খেয়ে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন জামাল উদ্দিন সাহেব। কিন্তু ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে পারেননি।
জামাল উদ্দিনের লাশ বিশাল অট্টলিকা বাড়ির আঙ্গিনায়। ৩ ছেলে ও ২ মেয়েরা জামাইসহ  এসেছেন। লাশ দাফন করার আগেই ছেলে মেয়েদের মাঝে মারামারি লেগে গেলো বাসার ভিতর। তুমুল মারামারি। আত্বিয়স্বজন সেই মারামারি থামাতে ঘরে ছুটলেন।
লাশ পড়ে রইলো একা।

সেই সুযোগে একদল কুকুর লাশকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেললো নিমিষেই। এলাকাবাসীর কেউ-ই আগে কখনো কুকুরগুলোকে দেখেছেন বলে মনে পড়লো না কারোই।
______________________________

সতীনের ছেলে

সতীনের একমাত্র ছেলেকে ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়ায় শবনম।

দ্বিতীয় স্বামীর ঘর ভাঙার ভয়ে সতীনের ছেলেকে খাওয়ানো শুরু করলেও তার মুখ দেখতে চায় না সে।
________________________

পরীক্ষায় পাশ

ছাত্র: স্যার, দেখি আমায় আপনি কিভাবে ফেল করান!

স্যার: গুড, তাহলে এবার তুমি ভালোই পরীক্ষা দিয়েছো?

ছাত্র: আমি এবার পরীক্ষাই দেইনি।
__________________

নতুন সকাল

সারারাত অপেক্ষায় থাকলো রাশেদ। গতকাল সকলে বলেছে, আগামীকাল একটি নতুন সকাল আসবে, সব দুঃখ কষ্ট চলে যাবে। সম্ভবনাময় আলোকিত হবে সব।

কিন্তু কোথায়? তার যেভাবে সকাল শুরু হয় সেভাবেই শুরু হলো। জীর্ণশীর্ণ  ছেঁড়া কাঁথায় বেড়িয়ে যাওয়া পা আজও বেড়িয়েছে। বিকট যান্ত্রিক আওয়াজে ঘুম না আসা সকাল সেই-ই। তবে নতুন সকাল কই?
___________________________

একটু হাসি

আকবর সাহেবের বিয়ে হয়েছে দশ বছর। মাত্র দুই দিন হলো তিনি প্রথম বাবা হলেন। কিন্তু বাবা হয়েও তিনি তার সন্তানকে কোলে তুলে নিতে পারছেন না। জন্মের পর হতেই তার সন্তান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের. … তে।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রতিদিন দুপুরে আসে আর একটি কথাই বলে- আকবর সাহেবকে ‘বাবু হেসেছিলো একবার’। ডাক্তার ১০ দিন যাবত এই একই প্রশ্ন করছেন আকবর সাহেবকে। যতবারই তিনি প্রশ্নটি শোনেন ততবারই তার কান্না পায়।
__________________

ত্রাণের চাল

চালের বস্তা দুর্বল হলে যা হয়। এক পাশে ফুটো হয়ে ধড়-ধড় করে পড়তে শুরু করলো। মাথা থেকে নামাতে নামাতে বেশ কিছু চাল রাস্তায় ইট পাথরে মিশে গেলো।

রহিমা শাড়ির আঁচল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলো। তাতে ঠিকমতো ঢাকা হলো না বুকটা।

ইজ্জত! হায়রে গরীবের ইজ্জত!

সাতদিন পর আজ পেলে ত্রানের চাল। তিনদিন অভুক্ত ছেলে মেয়েরা পথ চেয়ে আছে তার।

রোদে তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তায় জোড়ে জোড়ে পা চালায় রহিমা।
_______________________

সুদের টাকার বাড়ি

মহিবর চাচা সুদের ব্যবসা করেন। উনি মনে করেন তিনি অভাবী মানুষকে প্রয়োজনের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করছেন। বিনিময়ে কিছু টাকা নিচ্ছেন। তিনি এই সুদের টাকা দিয়ে একটি তিনতলা বাড়ি বানালেন। এলাকার লোকজন সেই বাড়ির নাম দিলো ‘সুদের টাকার বাড়ি’।
________________________

পরিষ্কার হাত

আবুল সাহেব এক পুরোনো দোকানে একটি মজার আয়না পেলেন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর আয়নার সামনে ধরলে সহজেই বোঝা যাবে হাত পরিষ্কার হয়েছে কিনা?

অফিস থেকে বাসায় ফিরে বার বার হাত ধোয়ার পরেও আবুল সাহেবের হাত পরিষ্কার হচ্ছে না!

উনি স্পষ্টই বুঝলেন ঘুষখোরের হাত কখনই পরিষ্কার হয়না।
__________________________

মায়ের মৃত্যু

মায়ের মৃত্যু সইতে পারলো না টগবগে যুবক শাহজাদা। মাত্র সতেরো ঘন্টার মধ্যে নিজেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলো সে।
___________________________

ইচ্ছের মৃত্যু

টুটুল আর সিমু পাশাপাশি নির্জনে বসে থাকার সময় টুটুলের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সিমুর গালে চুমু খেতে। কিন্তু ইচ্ছের মৃত্যু হলো অঙ্কুরেই। ইচ্ছের বাস্তবায়ন করতে যদি পাঁচ বছরের ভাল বন্ধুত্বই নষ্ট হয়ে যায়!

____________________

বন্যা শিশু

বানের জল এক্কা দোক্কা খেলে

অভুক্ত থেকে যায় সদ্য জন্মনেয়া শিশুটি

যেখানে জন্মদেয়ার পর জ্ঞান না ফেরা মা আর কষ্ট পায় না।

প্রসব বেদনা ভুলিয়ে দিয়েছিলো ক্ষুদার জ্বালা, আর কোন কষ্ট নেই মায়ের

সব কষ্ট দিয়ে গেছে সদ্য জন্মনেয়া শিশুটিকে।

কোথায় আজ সমাজ?

তাকে কী ঠাঁই দেবে বানের জলে ভেসে যাওয়া ভিটে?

১৯৮৮ সালের বন্যায় জন্মনেয়া মা

২০১৭ সালে জন্মদিল মেয়ের।

বানের জলের মতো ভাসতে-ভাসতে শেষ ঠাই হয়েছিল কছিম উদ্দিনের কুঁড়ে ঘরে,

বানের জলের সাথে চলে যাওয়া মায়ের প্রাণটা তছনছ করে দিলো আরেকটি শিশু কন্যার জীবন।

বানের জল এক্কাদোক্কা খেলে

খেলে যায়-দূর দিগন্ত কাছে দেখা যায় না,

শুধু দেখা যায় অবাধ্য জলময় দেশ।