রবীন জাকারিয়া

১২ নভেম্বর, ২০২২ , ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

মেনোপেজকালীন প্রেম

মেয়েটি প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার শেষে দাদা বাড়িতে বেড়াতে আসতো৷ সে আমার ছোট বোনের প্রিয় বান্ধবি৷ দু’বছরের ছোট৷ নাম জবা৷ ওর বাবা একটা স্কুলের শিক্ষক৷ নদী পরিবেষ্টিত পাশের জেলা শহরে থাকলেও যোগাযোগ জটীলতায় সর্বদা যাতায়াত করা যেত না৷ ওরা বেড়াতে আসলে একটানা এক-দেড়মাস থাকতো৷ ছোট বোনের বান্ধবি আবার বাড়ি লাগোয়া৷ যার কারণে ও দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়িতেই কাটায়৷ আমরা ছোট মানুষ৷ তাই সকলে একসঙ্গে খেলি৷ ছেলে-মেয়ের বিভেদ নেই৷ অবশ্য সে সময় এটাই প্রচলিত ছিল৷ ওর সাথে আমার সখ্যতা ছিল বেশ৷ সবসময় কেয়ার করতো৷ খেলতে গিয়ে আমি একটু ব্যাথা পেলে ও কান্নাকাটি করতো৷ সবাই ক্ষ্যাপাতো! কিন্ত আমরা ওসব পরোয়া করতাম না৷ আবার সারাদিন ঝগড়া, মান-অভিমানও চলতো সমান তালে৷ ঝগড়া লাগলে আড়ি দিতাম৷ আবার কিছুক্ষণ পর আড়ি খুলে ফেলতাম৷ আড়ি দেয়া এবং খোলার পদ্ধতিটাও ছিলো বেশ! দুজনের কনিষ্ঠ আঙ্গুল বাঁকা করে লাগালে আড়ি বলবৎ আর বৃদ্ধাঙ্গুল লাগালে আড়ি রদ৷ দিনে পাঁচ-সাতবার তো হতোই৷

এভাবেই সময় চলে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ পরবর্তিতে সে এসএসসি পাশ করে শহরেই কলেজে ভর্তি হলো৷ হোস্টেলে না থেকে দাদা বাড়ি থেকেই কলেজ করতো৷ হোস্টেলে থাকবেই বা কেন নিজের বাড়ি থাকতে?
ও যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো৷ আমি তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে৷ একই কলেজ৷ ইচ্ছে করলে একই সাথে যাতায়াত করা যায়৷ কিন্ত সামাজিক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি৷ ও রিক্সায় যেতো৷ বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে৷ ফনিক্স সাইকেল৷ ডুপ্লিকেট ফনিক্স নয়৷ চায়না ফনিক্স৷ তখন এই সাইকেল ছিল একটা এসেট৷ একটা স্ট্যাটাস৷ আমি রাজকীয়ভাবে সেটাতে করে যাতায়াত করি৷ কলেজে দেখা করি৷ কথা বলি৷ কিন্ত ফরম্যাল৷ অন্যরা বিশেষ করে কলেজে পড়ুয়া পাড়ার অন্য প্রতিবেশিরা কী চোখে দেখে! তাছাড়া এখনতো আর সেই ছোট্টটি নেই৷ কিন্ত বাড়িতে ফিরলে আর ফরম্যালিটির কোন বালাই নাই৷ টোকা-টুকি, কিল-ঘুসি, মান-অভিমান সবই চলে৷ জবা প্রচন্ড অভিমানী আর সাহসি টাইপের মেয়ে৷ যার কারণে এতো বড় হয়েছি তবুও দুষ্টুমি করতো খুব৷ একদিন আমি গোসলখানায় গোসল করতে গেছি৷ আগে গোসলখানাতো এতো বাহারি আর নিরাপদ ছিল না৷ চারিদিকে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দেয়া প্লাস্টার বিহীন ওয়াল৷ উপরে কোন ছাদ নেই৷ দরজাও নেই৷ গোসলখানার ঠিক পাশেই নলকুপ৷ পুরো জায়গাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ ব্যাস! গোসলের কাপড় রাখতে হয় ওয়ালের উপর৷ সেদিনও আমি গোসল শেষে ওয়ালের দিকে হাত দিয়ে দেখি কোন কাপড় নেই! ফাপড়ের মধ্যে পড়লাম৷ বিব্রতকর অবস্থা! এখন বেড়াই কী করে? কাপড়গুলোই বা কোথায় গেল? এমন সময় কলের পাড় থেকে জবা হেসে বলতে থাকলো এখন তুমি নেংটু হয়ে বের হও৷ আমার সাথে মাতব্বরির শাস্তি! অনেক অনুরোধ করলাম৷ শুনলো না৷ বরং বলে উঠলো তুমি সবকিছু ঠিকঠাক ঢেকে রাখো আমি ভেতরে যাচ্ছি৷ কোন মানাই সে শুনলো না৷ গেটহীন গোসলখানায় ঢুকে পড়লো৷ নিজের দুহাত দিয়ে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঢেকে রাখা যায় শুধু সেটাই চেপে ধরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক সুন্দরী তরুনীর সামনে দন্ডায়মান গুহা যুগের এক আদিম পুরুষ (Caveman). নিমিষের ভেতরে আদিম প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো৷ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে জবার হাতটাকে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে আনলাম৷ শক্ত করে চেপে ধরলাম বুকের ভেতর৷ ওর ঠোঁটে এঁকে দিলাম ভালোবাসার উষ্ণ চুম্বন৷ লজ্জায় ও পালিয়ে গেল তখনই৷ প্রথম উপলদ্ধি হলো আমরা একে অপরকে ভালোবাসি৷ এই ঘটনার পর ও দিন দুয়েক আমার সাথে দেখা করেনি৷ না কলেজে আর নাতো বাড়িতে৷

সময় থেকে থাকে না৷ সময়ের সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসার শেকড় প্রোথিত হয় আরো গভীরে৷ দুই পরিবারও ইচ্ছুক যেন আমাদের বিয়েটা দিয়ে সম্পর্কটাকে আরো দৃঢ় করে৷ দিনে দিনে আমরা হয়ে গেলাম আরো সাহসি৷ এখন প্রায় প্রতিদিনই পাড়ার মোড়ে দুজনে নাস্তা খেতে যাই৷ মাঝে মাঝে আমার ছোট বোন থাকে৷ কখনো দুজনেই যাই৷ পাড়ার মোড়ের দোকানে আর কী পাওয়া যায়? পিয়াজু, বেগুনি কিংবা আলু চপ৷ জবার ওগুলোই পছন্দ৷ তাছাড়া তখনো এতো থাই-চাইনিজ রেস্তোরার প্রচলন খুব বেশি হয়নি৷

সবই ঠিক ছিল৷ কিন্ত জবার এক চাচা যিনি খাদ্য অধিদপ্তরে কেরানি পোস্টে চাকুরী করার কারণে অবৈধ টাকার মালিক বনে গেলেন৷ টাকার গরমে আস্তে আস্তে তিনি এবং পরিবারকে প্রতিবেশি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন৷ বাড়ির কাঠামো, লাইফ স্টাইল সবই পরিবর্তিত হলো৷ বন্ধ হয়ে গেল জবার সাথে আমার অবাধ যোগাযোগ৷ কিছুদিন আমরা কলেজেই মেলামেশা করতাম৷ তা-ও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়৷ কথায় বলে যে অর্থ আর ক্ষমতা মানুষকে নেগেটিভ আর উচ্চাভিলাশী করে৷ জবার ক্ষেত্রেও তাই হলো৷

বেশ কিছুদিন কথা বলতে না পারাতে একদিন এক সন্ধ্যায় জবাকে বাড়ির সামনের রাস্তায় জাম গাছটার নীচে আসতে বললাম৷ কথা রাখলো৷ ও যখন আসলো তখন রাস্তাটা ফাঁকা৷ কেউ নেই৷ নেই কোন শব্দ৷ শুধু গাছ থেকে দু’একটা জাম পরার টুপ টুপ আর আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ ছাড়া নীরব চারিদিক৷ ও আসা মাত্রই ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম তুমি কি আমাকে চাওনা? নাকি আর ভালোবাসো না! কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? সে খুব স্বাভাবিক আর শান্ত স্বরে জানালো আমাদের সম্পর্ক আর রাখা সম্ভব নয়৷ কেননা বড় চাচা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন৷ ছেলে সরকারি চাকুরে৷ আমাকে ক্ষমা কোরো৷ বলে চলে গেল৷ আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ একাকী৷ কষ্ট পেয়েছি কিন্ত কাঁদিনি৷ বরং কেন যেন প্রচন্ড শব্দে হেসেছি৷

এরপর সময় বয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে৷ হঠাৎ বাবার মৃত্যু! সংসারের দায়িত্ব, ভাই বোন ও নিজের লেখাপড়া৷ বোনের পাত্রস্থ৷ নিজের একটা চাকুরী৷ সব মিলে একটা ঘোরের মধ্যে সময় চলে গেল৷ সব কিছু গুছিয়ে উঠে যখন বিয়ে করবো দেখি বয়স অনেক হয়ে গেছে৷ কেউ পাশে নেই৷ একা৷ ভীষণ একা৷ শুধু কাঁধে যার প্রেরণার হাত পেয়েছিলাম৷ সে হলো রত্না৷ আমার কাজিন৷ অনেক ছোট৷ কিন্ত ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে৷ রত্না আমার দ্বিতীয় প্রেম৷ জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে ওর হাত দুটি ছিলো আমার শক্তি৷ অন্ধের ষষ্ঠি৷ অনেক স্বপ্নের জাদুকর৷ জীবন সঙ্গীনী৷ দুটি সন্তান নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার৷

আমি একটা মার্কিটিং ডিপার্টমেন্টে জব করি৷ পেশাগত কারণে আমাকে বিভিন্ন জেলাতে থাকতে হয়৷ বাড়িতে থাকা হয় কম৷

জবা মাঝে মাঝে এখনো স্বামী সন্তানসহ এখানে আসে৷ শরীর ভর্তি গহনা৷ রঙ বেরঙের পোষাক৷ কিছু নারীর মধ্যে এই পাগলামো দেখা যায়৷ গহনা আর পোষাক প্রদর্শন করে প্রমাণ করতে চায় যে তারা কত সুখী৷ ওর দুটি মেয়ে৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷ এখন জবার আনাগোনা আরো বাড়তে লাগলো৷

প্রায় মাস খানেক পর বাড়ি ফিরলাম৷ সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়েছি৷ রত্না আর সন্তানদের মতো আমিও ভীষণ খুশি৷ কটা দিন আনন্দে কাটানো যাবে৷ সেদিন শুক্রবার বিকেলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছি৷ একটু ঘুরবো বলে৷ বাড়ির গেটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো জবার সাথে৷ বুকটা ধক্ করে উঠলো৷ বিশ্রী একটা পরিস্থিতি৷ ঘামতে থাকলাম৷ কেমন আছো? বলে জবা পরিবেশটা স্বাভাবিক করলো৷ বললাম ভালো আছি, ধন্যবাদ৷ তুমি? ও মাথা উপর নীচ করে জানালো ভালো আছে৷ আচ্ছা দেখা হবে বলে আমরা বেরিয়ে পরলাম৷ রিক্সায় রত্না বারবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে৷ কারণ আমার আর জবার বিষয়টা ও জানে৷

পরেরদিন সন্ধ্যায় জবা আমাকে সেই জাম গাছটার নীচে দেখা করতে বললো৷ আমি জানালাম এর কোন প্রয়োজন নেই৷ কিন্ত ওর অনুরোধে দেখা করতে গেলাম৷

দুজনে মুখোমুখি৷ দামি পোষাক আর গহনায় মোড়া সামনে দন্ডায়মান জবাকে মনে হচ্ছে যেন শপিং মলে দাঁড়ানো “ডেমো পুতুল”৷ হঠাৎ জবা আমার হাত দুটো ধরে বলে উঠলো তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাস? চলো আমরা নতুন করে জীবন শুরু করি৷ আমি বিশ্মিত! কিছু বলবার আগেই কাঁদো কাঁদো স্বরে ও বলতে শুরু করলো৷ জানো জীবনে আমি কিছুই পেলাম না৷ টাকাওয়ালা ঐ অসৎ বুড়োকে বিয়ে করে জীবনটাই শেষ করে দিলাম৷ তুমি কি আমাকে আগের মতো গ্রহণ করবে? বিশ্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে আমি একবার জবা আর একবার ওর হাত দুটোর দিকে তাকাতে লাগলাম৷ আধো আলো আর আধো অন্ধকারে ওকে কেন যেন রাক্ষুসে মনে হচ্ছে৷ চামড়া কুচকানো আর বলিরেখা ভরা হাত দুটো যেন আমার গলা টিপে ধরবে৷ ভয় নয় বরং ঘৃণায় পিছু হটতে লাগলাম৷ যে নারী একদিন নিজের ইচ্ছায় পছন্দের বিত্তবান মানুষটাকে বিয়ে করলো৷ হোক বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে যার উপার্জিত অর্থে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করলো৷ সংসার করলো৷ আজ তাকেই অপবাদ দিচ্ছে৷ আর বিশ্বাস ঘাতকতা করে অন্যের ঘরনী হতে চায়৷ ৫০ পেরুনো মেনোপেজে পৌঁছানো এক বিকারগ্রস্থ নারীর পরকীয়ার প্রস্তাব আমাকে রত্না’র প্রতি ভালোবাসাকে তীব্র করে তুললো৷ এত কিছুর পরও রাক্ষুসেটাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম মনে মনে৷ কেননা ওর প্রত্যাখানের জন্যই রত্না’র মতো রত্ন আমি পেয়েছি জীবনে৷

এখানে এক মূহুর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না৷ রত্না’র স্যাক্রিফাইজ আর ভালোবাসা ভীষণভাবে উপলদ্ধি করলাম৷ ফিরে যেতে চাই সেই মানুষটার কাছে৷ যে শত বিপদের মাঝে আমাকে দিয়েছে সাহস৷ দিয়েছে নতুন ভাবে বাঁচবার প্রেরণা৷ সেই রত্নার কাছে৷ যেমনটি আগেও ছিলাম৷

আমি দৌড়াতে থাকলাম বাড়ির দিকে৷ অল্প দূরত্ব৷ আমি ঘেমে যাচ্ছি৷ দম কমে যাচ্ছে৷ কিন্ত কোন ভাবেই জবা’র থেকে দূরত্ব বাড়াতে পারছি না৷ সেই মেনোপেজকালীন ডাইনী থেকে যে এই বয়সে এসেও পরকীয়া প্রেমের প্রস্তাব দেয়৷

(লেখক কর্তৃক আপলোডকৃত। অসম্পাদিত)

গল্প-মেনোপেজকালীন প্রেম রবীন জাকারিয়া
206 Views

রবীন জাকারিয়া

১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ , ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ

সুন্দরী তরুনী

(লেখক কর্তৃক আপলোড করা লেখা। অসম্পাদিত।)

তরুনীটির বাবা স্থানীয় একটা মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম ছিলেন৷ সৎ আর ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী লোকটা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন তাঁর মাদরাসাতেই৷ স্ত্রী সন্তানদের ধর্মীয় বিধি বিধান, পোষাক-পরিচ্ছদ, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন৷ পরিবারের সকলেই তা হাসিমুখেই পালন করতো৷ বড় মেয়েটি বিজ্ঞান বিভাগে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে৷ মাস্টার্সের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে এমন সময় গত বছর তরুনীটির বাবাকে জঙ্গী সন্দেহে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়৷ পরদিন থানায় বাবার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলো পুলিশ গতকাল কাউকেও তুলে আনেনি৷ হয়তো কেউ ভূয়া পরিচয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে৷ তাদেরকে বলা হলো একটা মিসিং কেস করে রাখতে৷ পুলিশ তদন্ত করে এর সমাধান দিতে পারবে৷

বাবা হারানো দরিদ্র পরিবারের তরুনীটি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো৷ মা, ছোট দুই ভাই-বোন, আর তার লেখাপড়া খরচ এবং সংসার চালাবে কী করে?
বাবা বেঁচে থাকতেই মাদরাসায় যাওয়া ছাড়া বাহিরে তেমন একটা বের হতোনা৷ বের হলেও হিজাব পড়তো সব সময়৷ ফর্সা, লম্বা আর আকর্ষনীয় তরুনী বের হলেই পাড়ার বখাটেরা টোন করতো৷ শিষ দিতো৷ বলতো ইরানী গোলাপ কিংবা কাশ্মিরি সুন্দরী আরো কত কী৷ সে এড়িয়ে যেত৷

কিন্ত এখন এতসব ভাববার সময় তার নেই৷ সংসারের হাল ধরতে হবে৷ সংসার, ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া৷ তাই সে প্রথমের দিকে কিছু বাড়িতে কুরআন শিক্ষার প্রাইভেট পড়ানো শুরু করলো৷ কিন্ত বেতন খুবই কম৷ মাসে পাঁচশত টাকার বেশি কেউ দিতে চায়না৷ তাতে সংসার চলেনা৷ তাই সে গণিত, ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর কয়েকটা টিউশনি করাতে লাগলো৷ বাঁধ সাধলো স্টুডেন্টরা৷ হিজাব পড়া থাকলে নাকি তারা ভয় করে৷ তরুনীটি নেকাবটা খুলে পড়াতে লাগলো৷ স্টুডেন্টদের বাবাদের বাজে দৃষ্টি তার এড়ায় না৷ এড়ায়না শিক্ষার্থির মায়েদের চোখ৷ কিছুদিন যেতে টিউশনিগুলি হারিয়ে ফেলে৷ কেননা সে সুন্দরী তরুনী৷

দারিদ্য মানুষকে জেদী করে তোলে৷ ফলশ্রুতিতে তরুনীটি একটি প্রতিষ্ঠানে সেলস গার্ল হিসেবে চাকুরি পায়৷ প্রতিষ্ঠানের ড্রেসকোড অনুসারে তাকে শুধু নেকাব নয় হিজাবটাও খুলতে হয়৷ এখানে সুন্দর করে শাড়ি ও প্রসাধন ব্যবহার করে কাস্টমারদের আকর্ষন করতে হয়৷ বেতন ভালই ছিলো৷ তবে অফিসটাইমটা বেশি৷ সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত৷ তবুও তাকে করতেই হবে৷ তা নাহলে সবাইকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে৷
প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস আর সততার সাথেই সে চাকরিটা করছিলো৷ কিন্ত ম্যানেজার প্রতিদিন তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে৷ সে এড়িয়ে যেতো৷ কিন্ত একদিন অফিস ছুটির পর ম্যানেজার তাকে শারিরীক লাঞ্চিত করতে উদ্যত হওয়ায় কোনভাবে পালিয়ে বাঁচে সুন্দরী তরুনীটি৷

ভাগ্যক্রমে একদিন এক বড় কর্পোরেট অফিসে বসের পিএস হিসেবে চাকরি পেয়ে যায় সে৷ বেতন এতবেশি হবে তা কখনো কল্পনাই করেনি তরুনীটি৷ নতুন অফিস৷ নতুন আইন৷ নতুন ড্রেস কোড৷ এখানে পিএসের ড্রেস কোড হলো স্কাট ও টপস কিংবা প্যান্ট ও শার্ট/টিশার্ট৷
তরুনীটি নতুন আদলে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে থাকে৷ কেননা তার হাতে কোন অপশন নেই৷ আধুনিক আর বাহারি সজ্জায় সজ্জিত অফিস৷ অভিজাত আর কেতাদূরস্ত পোষাকে আবৃত পরচুলায় ঢাকা এক মধ্য বয়সি পৌঢ় যেন জোর করে নিজেকে যুবক প্রমাণে সদা তৎপর৷ কাজে অকাজে নিজের চেম্বারে ডেকে গুলতানি আলাপটাই যেন তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ কথার ফাঁকে বস কিছু যেন ইঙ্গিত দেয়৷ না বোঝার ভান করে তরুনীটি৷ ক্ষিপ্ত বস চোখের ইশারায় যেন বোঝাতে চান এর বদলা নেবো৷

কিছুদিন পর অফিসে বিদেশি একটা ডেলিগেট টিম আসলো৷ তারা এই প্রতিষ্ঠানের ফিসিবিলিটি, ভিজিবিলিটি ও সক্ষমতা যাচাই করবেন৷ ইতিবাচক হলে জয়েন ভেঞ্চার ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করবে৷ অফিসে সাজ সাজ রব৷ সকলে ব্যতিব্যস্ত৷ কনফারেন্স রুমে ডেলিগেট টিমের সাথে বস মিটিং করছেন৷ ইন্টারকমে টেলিফোন পেয়ে তরুনীটি সকলের জন্য স্ন্যাক্স ও ব্ল্যাক কফি পরিবেশন করে চলে আসবে কিন্ত বস বসতে বললেন৷ তরুনীটি বসলো৷ পরিচিতি পর্বের ভাষাটা বুঝতে পারলেও পরের সংলাপগুলো বুঝতে পারেনা তরুনী৷

বস বিদেশিদের আস্বস্থ করে যে তাঁদের সমস্ত এন্টারটেইনের ব্যবস্থা করা আছে৷ আর এই দায়িত্বটা পালন করবেন আমাদের পিএস৷ সেদিন রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারেনা তরুনীটি৷

পরেরদিন খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়৷ মৈত্রি সেতুর রেলিংয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় বস্তাবন্দী এক সুন্দরী তরুনীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ৷

সুন্দরী তরুনী
362 Views

মাসুম মোরশেদ

৪ জুন, ২০২২ , ১২:২০ পূর্বাহ্ণ

সাবালক

ডিগ্রীতে পড়ি। বয়স কুড়িমতো হইবে। দুরবিন দিয়া খুঁজিয়া সারা মুখে কতক বাদামী পশম দেখিতে পাই। আমার নাকের নিচে, ডানে বামের অনুর্বর অঞ্চলে কিছুই জন্মায় না। নিজেকে বড় নাবালক লাগে। ডিগ্রীতে পড়া ছেলেদের কারো কারো ঝাঁকড়া চুল তাহাতে আবার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কেতাদুরস্ত ভাব লইয়া প্যান্টের ব্যাকপকেটে ভাঁজ করা রেখা খাতা লইয়া যখন কলেজে আসে, মাঠে ঘোরে, কলেজের পুকুরপাড়ে তাসের আড্ডায় চুল ঝাঁপিয়ে ট্রাম্পকার্ড ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করে কিংবা মেয়েদের দলে বসে বাদাম খুলটে ফুঁ দেয়- আমি ছেলে মানুষটা সেইসব ছেলেদের প্রেমে পড়িয়া যাই। ভাবি, আমার ইহজীবনে কিছুই হইবে না। ক্লিনশেভড মুখ আর সাথে তেমন ঝুলপি চুল যদি রাখিতে পারিতাম তবে আমার মতো সুখী মানুষ বুঝি কমই হইত। কিন্তু তেমন করিয়া রাখিতে পারিব না, কারণ বাবা তাহা পছন্দ করিবেন না। তিনি কঠিন ধাতের মানুষ। অতিবাস্তববাদী লোক। তিনি নিজে সর্বদা ক্লিন শেভ করিয়া থাকেন। তাই সেটাতে অসুবিধা হইবার কথা নহে। তাই সাবালকত্ব লাভের জন্য সেটার চিন্তা করিতেছি।

দোয়ানী বাজারের আজিজুল আমার বাল্যবন্ধু। ও যখন ক্লাশ নাইনে পড়ে তখন ওর সারামুখে ঘনকালো দৃশ্যমান দাড়ি, মোচ। আমি তখন ইন্টারমিডেয়েট সেকেন্ড ইয়ার। খুব বড়রা বাদ দিয়ে পাড়ায় কোন সিনিয়র জুনিয়র নাই। সবাই ভাইভাই, বন্ধু বা বন্ধুর মতো। কীভাবে যেন তাহার সাথে খুব ঘনিষ্ট হইলাম, জানি না। সেই স্বল্পবয়সেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। ঠিক সেসময়ই আফসোস করিতাম, আহা, আমার যদি এই মুখখানা হইত! শুধু হাপিত্যেস করিতাম আর ভাবিতাম, কখনো কী আমার তেমন হইবে? ডানহস্তে, বাঁহস্তে নিজের বদনখানি নাড়িচাড়ি আর ভাবি, আমি কি তবে বড় হইবো না?

সেইসবদিনে হকবাজারের বিখ্যাত ভোলা নাপিত যখন বন্ধুর চুল, দাড়ি কাটে আমি অপলক চাহিয়া থাকিতাম। অন্য চেয়ারে বসিয়া মাঝেমধ্যে প্রমানসাইজ আয়নায় আমার নিরসবদনখানি দেখিতাম আর মনে মনে প্রার্থনা করিতাম যেন দ্রুত আমারো তাহার মতো হয়।

কিন্তু যাহা তাহাই! যাহার হয় তাহারই হয়। আমার তাহা নহে।

বন্ধু আমার দুঃখ বোঝে। আমি তখন বি, এ ফার্স্ট ইয়ার। আর সে পড়ালেখা বাদ দিয়া বাড়ির সামনে মুদিখানা দিলো। বিকাল, সন্ধ্যায় তাহার দোকানে আড্ডা মারি আর তাহার সোনাবদনখানি দেখে দেখে কতশত গল্প করি। কথাচ্ছলে সে-ই একদিন বলিল, “শেভ কর্। দুই-চারিবার ক্ষুর পড়িলে প্রচুর গজাইবে।” কথাখানা একান্তই আমার মনের কথা। তাই মনে ধরিল। এই না হইলে বন্ধু কিসের! বন্ধুই তো বন্ধুর গোপন কথা, মনের ব্যথা বুঝিবে, স্বাভাবিক।

ভাবিলাম, তথাস্তু!

বন্ধু যেহেতু মুদিখানা সামলাইতে ব্যস্ত। তাহার আর আমাকে সঙ্গ দেবার সময় নাই বা অযথা ঘোরাঘুরি তাহার শোভা পায় না। তাহার সাথে প্লান প্রোগ্রাম ঠিক করিলাম বটে, কিন্তু একাই যাইতে হইবে এবং তা-ই সাব্যস্ত করিলাম।

বাড়ি হইতে তিন কিলোমিটার দূরে খানসামা হাট। সেইদিকে যাইব। শুক্কোরবার আর সোমবার হাটবার। হাট শুরু হয় দুপুরের নামায বাদ। সেই হাট জমাইয়া তুলিবার জন্য কাজকারবার শুরু হয় সকালবেলা থাকিয়া। ধোয়ামোছাসহ ইত্যকার কাজ। বাঁশের ফোল্লা (ব্যাঙ্ক) কাটিয়া লুঙ্গির খোঁটে ত্রিশ টাকা রাখিলাম। আমাদের বাজারের নাপিত চুলদাড়ি শেভ করা পাঁচ, ছয় টাকা নেয়। শুধু দাড়ি শেভ করিতে তিন টাকা লাগিত। কেউ কেউ দুই টাকাও দিয়া থাকেন। নাপিতরাও সেই টাকা কপালে ঠেকাইয়া ক্যাশবাক্সে রাখিতেন। খানসামায় যদি অনেক বেশি চায় বা নেয়, তাই অপদস্ত হইবার ভয়ে ত্রিশ টাকাই লুঙ্গির কোঁচে রাখিলাম। এখানে বলিয়া রাখি, আমাদের ছাত্রাবস্থায় গ্রামাঞ্চলে তখনো ফুলপ্যান্ট পরে ঘোরার চল শুরু হয়নি। শহরে চলে সেটা বেশ। তবে দুইএকজন, যাহারা শহরে পড়িত, হোস্টেলে বা মেসে থাকিত, সেই সময় তাহাদের কেউ কেউ গ্রামে আসিলে প্যান্ট পরিয়া বেড়াইত। অবশ্য আরামকে ভুলিয়া সেটা মেয়েদের দেখানো বা উন্নতজাতের ছাত্র হিসেবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতে তাহা করিত। কিন্তু আমরা যাহারা নিয়মিত গ্রামে থাকি তাহারা কখনো নয়। এমনকি শহরে সিনেমা দেখিতে যাইতাম লুঙ্গি পরিয়া। অন্য আরেকটা সত্য হইল আমাদের কেহ কেহ লুঙ্গি পরেই কলেজে ক্লাশ করিত পিছনে বসিয়া।

যাইহোক, বিভিন্ন ঘোরা পথ ব্যবহার

মাসুম মোরশেদের রম্যগল্প -মাসুম মোরশেদ

রবীন জাকারিয়া

৪ জুন, ২০২২ , ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

কোডাক ক্যামেরা

শাহেদ ভীষণ বিরক্ত হয়ে আছে৷ সারাটা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও সে তার অত্যন্ত একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না৷ ভয়াবহ ব্যাপার! ওটার ভেতরে নিজের সমস্ত একাডেমিক সার্টিফিকেট, বাড়ির মূল দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখা আছে৷ ফাইলটার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই সে ফাইলের কভারে মার্কার পেন দিয়ে বড় বড় হরফে লিখে রেখেছে “কাগজপত্রের মূলকপি”৷ অথচ এখন উধাও৷ সে কখনো এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়৷ জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি৷ সে এত পরিপাটি যে কোন জিনিস কোথায় আছে তা অন্ধকার বা বিদ্যূত চলে গেলেও বের করতে পারবে৷ কয়েল, মোমবাতি, দিয়াশলাই কিংবা টর্চলাইটটা কোথায় রাখা আছে তা ওর নখদর্পনে৷ কিন্ত এখন সে কোনোটাই জায়গামত পায় না৷ এটা শুরু হয়েছে বিয়ের পর থেকে৷ এখনকার বউরা কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে চায় না৷ শুধু দায়সারা কাজ৷ দরজার চাবিটা ঠাশ করে কোথায় রাখল সেটাই খুঁজতে নষ্ট করে ফেলে আধা ঘন্টা৷ শাহেদ এত বলে সঠিক স্থানে রাখ দেখবে তোমারই সুবিধা হবে৷ কিন্ত কে শোনে কার কথা৷ গত তিরিশ বছর ধরে একই চিত্র৷ বদলায় না কিছুই৷ না অভ্যাস আর না ভোগান্তি৷ অথচ আমাদের মায়েরা কত কষ্ট করে সংসার চালাত৷ সীমিত আয় আর অনেক সন্তানসহ যৌথ পরিবারের সীমাহীন কাজ শেষেও সবকিছু ছিল তাদের নখদর্পণে৷ তাঁরা সংসারটাকে Own করতেন৷ কিন্ত এখনকার মেয়েরা তা করে না বোধ হয়৷

শাহেদ কিছুটা সময় খোঁজাখুঁজিতে ক্ষান্ত দিলো৷ মেজাজটাকে ঠান্ডা করে চিন্তা করল৷ নতুন করে খুঁজতে হবে৷ যেভাবেই হোক ফাইলটা তাকে পেতেই হবে ৷ কারণ ঐ ফাইলে রাখা কিছু কাগজপত্র তার খুবই জরুরি৷ আর কিছুদিনের মধ্যে তাকে LPRএ যেতে হবে৷ সরকারি প্রসিডিউর মেইনটেইন আর কাগজপত্র সাবমিট করতে করতে এমনিতেই তার ত্রাহি অবস্থা৷ এর মধ্যে ফাইল খোঁজাটা যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া৷

বেশ কিছু পর শাহেদ আবারো ফাইলটা খোঁজা শুরু করল৷ বইয়ের আলমারি, ফাইল কেবিনেট এবং অবশেষে স্টিল আলমারি৷ পাওয়া গেল সিন্দুকের ভেতর৷ নিশ্চয়ই এটা তার স্ত্রী শেলী এখানে এনে রেখেছে৷ এটা নিশ্চিত আর যাই হোক সিন্দুকে সে ফাইলটা রাখেনি৷ রেখেছিল স্টিল আলমারিতে৷ যাক পাওয়াতো গেল৷ টেনশন কমলো৷ সে ফাইলটা বের করতে যাবে এমন সময় তার চোখে পড়ল ক্যামেরাটা৷ অনেক পুরোনো দিনের কোডাক ক্যামেরা৷ যেগুলো দিয়ে ছবি তুলতে ‘ফিল্ম রোল’ এর প্রয়োজন হতো৷ সেসময় ফুজি ফিল্ম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ এখনতো সব ডিজিটাল৷ আর সকলের হাতেই ক্যামেরা৷ মোবাইলে ক্যামেরা৷ ডিজিটাল ক্যামেরা কত কী! কিন্ত সে সময় একটা ক্যামেরা মানে একটা এসেট৷ আভিজাত্য৷ লোকে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমন করত অনেকটা গর্বের সাথে৷ পিকনিক কিংবা কোন অনুষ্ঠানে বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের কাছ থেকে ক্যামেরা ধার করে সকলে চাঁদা তুলে ফিল্ম কেনা হতো৷ এরপর সকলে সমানুপাতিক হারে ছবি তুলত৷ গ্রুপ ছবি৷ সিঙ্গেল ছবি৷ সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো ক্যামেরা সামনে ধরার আগে পর্যন্ত সকলে নরমাল থাকত৷ কিন্ত ছবি তোলার সময় কেন যেন সকলেই নার্ভাস হয়ে যেত৷ দাঁড়ানো, হাত দুটো সঠিকভাবে রাখা কিংবা মুখের হাসি সবকিছুই অস্বাভাবিক হতো৷ সে সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টাইলটা ছিল দুই বন্ধু হ্যান্ডশেকরত অবস্থায় ছবি তোলা৷ যার কারণে বেশিরভাগ ছবি ভাল হতো না৷ অবশ্য সে মূল্যায়ন করবার সক্ষমতাও ছিল না৷

একটা রিল ফিল্ম দিয়ে ৩০-৩৫টি ছবি তোলা যেত৷ তারপর ফিল্ম ডেভেলপ৷ পরিশেষে ল্যাবে ছবি ওয়াশ৷ আহ্ কী সময় ছিল৷ শাহেদ ক্যামেরাটা দেখতে পেয়ে নস্ট্রালজিক হয়ে পড়লো৷ মনে পড়লো কীভাবে সে ক্যামেরাটা কিনেছিল৷ স্বপ্ন থাকলেও বেকার শাহেদের পক্ষে ক্যামেরা কেনা অসম্ভব ছিল৷ একদিন এক বন্ধু ওকে সেটা কিনতে বলায় সে হাসি দিয়ে বলেছিল “আমাকে বিক্রি করলেও ওটা কিনতে পারব না৷ অসম্ভব! তখন বন্ধুটি জোর করে ওর হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বলেছিল তুই যা পারিস তাই দে৷ দরকার হলে পরে টাকা দিস৷ তবুও এই অলক্ষুণে জিনিসটা তুই নিয়ে নে৷ শাহেদ বলল, অলুক্ষণে মানে কী? বন্ধুটি বললো এটা অভিশপ্ত ক্যামেরা৷ এটা দিয়ে প্রথম যে ছবিটা তুলেছি সেটা হলো আমার মায়ের৷ ছবি তোলার দু’দিন পর মা হঠাৎ মারা গেলেন৷ শাহেদ হেসে বলল এতে কি প্রমাণ হয় এটা অভিশপ্ত? বন্ধুটি বলল আরেকটি কারণ আছে৷ সেটা হলো এর লুকিংটা কেমন ভূতুরে আর মাঝে মাঝে নিজে থেকেই “ক্লিক” শব্দ করে উঠে৷ আমার ভয় করে৷ এখন তুই নিলে নে৷ নাহলে এটা ভেঙে ফেলব৷ শাহেদ এসব আজগুবি আর ভূতুরে গল্পে বিশ্বাসী নয়৷ তাই সে ক্যামেরা নিল৷

মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনের কথা৷ যেদিন শাহেদ ফিল্ম লোড করে ক্যামেরাটা নিয়ে বাড়িতে এলো৷ তা দেখে আব্বা-মা, ভাই-বোন সকলে খুশি৷ আমার একটা ছবি তোল, আমার একটা ছবি তোল বলে সবাই হুড়োহুড়ি৷ কিন্ত শাহেদের এক কথা এটা দিয়ে প্রথম ছবি তুলবো আব্বা-মা’র যুগল ছবি৷ তারপর অন্যদের৷ আব্বা কেবল অফিস থেকে ফিরেছেন৷ তাঁদেরকে বলা হলো ভাল ড্রেস আর একটু মেকআপ করার জন্য৷ বাবা স্যুট-টাই পরলেন৷ আর মাকে শাহেদের বোন সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরিয়ে আর সাজিয়ে নিয়ে এলো৷ সব রেডি৷ ছবি তোলার স্পট পছন্দ হচ্ছিল না৷ অবশেষে বাড়ির ভেতর ছোট্ট গোলাপ বাগানের মাঝে তাঁদের বসানো হলো৷ ছবি তোলার ঠিক আগ মূহুর্তে তার বাবা বলে উঠলেন, তোল৷ ভাল করে ছবিটা তুলে রাখ৷ এটাই জীবনের শেষ ছবি৷ এ কথা শোনামাত্রই শাহেদের মা ভীষণ রাগান্বিত হলেন৷ বললেন, এসব কী অলুক্ষণে কথা বলো? মন খারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি উঠে চলে গেলেন৷ বললেন তিনি আর ছবিই তুলবেন না৷ শত চেষ্টা করেও তাঁর ছবি তোলা হলো না৷ আচমকা এমন ঘটনার ফলে সেদিন ঐ একটি ছবি ছাড়া আর কারোরই ছবি তোলা হলো না৷ আনন্দটা নষ্ট হয়ে গেল৷

দু’দিন পর শাহেদের বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলেন৷ বাবার মৃত্যুর পর সংসার, জীবন-জীবিকার তাগিদে সকলে ক্যামেরার কথা ভুলেই গেল৷ এমনকি শাহেদও৷ আজ প্রায় তিরিশ বছর পর ক্যামেরাটা দেখে সবকিছু যেন ছবির মত ভেসে উঠল৷ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ কৌতুহল বশে শাহেদ ক্যামেরাটাকে হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ আজ বন্ধুর কথাটা সত্য মনে হলো৷ আসলেই এটা দেখতে কেমন ভূতুরে৷ সে এগুলো পাত্তা দেয় না৷ পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই৷ এমন সময় ক্যামেরার সাটারটা একাই ক্লিক করে উঠলো৷ যেন কেউ একজন একটা চোখ টিপে দিলো৷ শাহেদ মজা পেল৷ ফিল্ম না থাকার পরও সে তাই মোবাইলে সেলফি তোলার মতো করে একবার ছবি তোলার বাটন চাপলো৷ এরপর খুঁজে পাওয়া ফাইলটা বের করল৷ আর আলো বাতাসে রাখবে বলে ক্যামেরাটা ড্রইং রুমের খোলা বুক শেলফে রেখে দিলো৷

দু’দিন পর শাহেদের বাড়িতে প্রচুর লোকের সমাগম৷ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কলিগ, পাড়া-প্রতিবেশিতে ভরপুর৷ হঠাৎ স্ট্রোক করে শাহেদ আজ মারা গেছে৷ অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ কেউ মানতে পারছে না৷ সকালেও সুস্থ্ একটা মানুষ ফজরের নামাজের পর জগিং শেষে ফ্রেকফাস্ট সারল৷ হালকা রসিকতা আর কথাবার্তায় পরিবারের সকলকে আনন্দে ভরে দিলো৷ অথচ হঠাৎ নেই হয়ে গেল৷

চারিদিকে কান্না আর হাহাজারিতে সারাটা বাড়ি বেদনায় ভরপুর৷ লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এসময়ে কান্নার বাঁধ যেন আরো ভেঙে পড়ল৷ কত লোক যে শেষকৃত্যের জন্য এসেছে তার হিসাব নেই৷ সকলেই পরিচিত নয়৷ বেশিরভাগই অচেনা৷ লাশ কাঁধে তোলার সময় চিৎকার শুনে এক তরুণ ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে এলো৷ হাতে একটা শপিং ব্যাগ৷ লাশের পিছু পিছু এলোমেলোভাবে পা ফেলে হাঁটছে তরুণ৷ ওকে দেখে সকলে দুঃখ পাচ্ছে এই ভেবে যে সে হয়তো মরহুম শাহেদের নিকটাত্মীয়৷ তাই সে কষ্টটা নিতে পারছে না৷ ধীরে ধীরে সেই তরুন একটা সময় লাশ দাফনের লাইন থেকে বেরিয়ে অন্য পথ ধরে৷ হাতে থাকা শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে “ক্লিক” শব্দটি কানে পৌছায় না মাদকাসক্ত সেই তরুণের৷ যার ফলে সে বুঝতে পারলো না শপিং ব্যাগে করে চুরি করা জিনিসটা শুধু কোডাক ক্যামেরা নয় বরং অদ্ভূতুরে ও অভিশপ্ত এক সিরিয়াল কিলার৷ আর যার পরবর্তী নিশানা হয়তো সে-ই৷

 

রবীন জাকারিয়ার গল্প - কোডাক ক্যামেরা

ডা.ফেরদৌস রহমান পলাশ

২৯ মে, ২০২২ , ১০:১৭ অপরাহ্ণ

প্রযত্নে নীলা

লোকটার বয়স কত হবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চুল, দাড়ি এমনকি ভ্রু পর্যন্ত সাদা। মারুফের ধারণা বয়স ৭৫ বছর তো হবেই। কথা বলার সময় দাঁত দেখা যাচ্ছে না, তাই দাঁত আছে না নাই, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে উচ্চারিত কথা ভেসে আসার সময় শব্দই বলে দিচ্ছে সামনের দাঁত কয়েকটা তার নাই। এই খেলাটা খেলতে মারুফের ভালো লাগে।  সামনের যে কোনও একজন লোক সম্বন্ধে ধারণা করতে। সবসময় মেলে না তবে মারুফ দেখেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যায়। লোকটা রসিক, লোক না বলে বৃদ্ধ বলাই মনে হয় ভালো। বৈকুন্ঠপুরের এই জৈষ্ঠের দুপুরে কাঁঠাল গাছের নিচে টং এ বসে লোকটার কথা শুনছে মারুফ। এদিকে কখনো আসা হয়নি আগে, যদিও রংপুর শহর থেকে বারো -তেরো কিলোমিটার দূর, তারপরও। সে এসেছে একটা বইয়ের পার্সেল ডেলিভারি দেবার জন্য।

প্রযত্নে,
নীলা, বৈকুন্ঠপুর, রংপুর।

এটুকুই ঠিকানা, সাথে মোবাইল নম্বর। প্রেরকের ঠিকানাটাও অদ্ভুত, শুধু লেখা-

প্রেরক,
নীল আর মোবাইল নম্বর।

নাম দুটো দেখে হাসি পায় মারুফের। নিশ্চিত নকল নাম। আসলে সম্পর্ক দানা বাঁধে না বলেই গোপন নাম প্রকাশ্যে চলে আসে। গোপন নামে সেও তো ডাকত সুলতানাকে, নয়না নামে। নয়না কেমন আছে? কতদিন পর তার নাম মনে পড়ল। পেটভাতে একটা চাকরি করে আর যাই হোক মনে প্রেম আসে না।

আহ,আজ এত গরম। বৃদ্ধ এখন সাপের গল্প বলছে। বুঝলা মিয়া, বলাটা কানে মনে হলো, ভুজলা মিয়ারা। মুই সাপের মনি দেখছুনু একবার বাঁশের ঝাঁড়োত। চইত মাস, মুই তখন চেংড়া মানুষ। রাইত বারোটার সম কতাকলি সিনেমা হলোত রুপবান ছিনেমা দেখি আসছুনু। মোর বাড়ির গোড়ত একখান বড় বাঁশের ঝাড় আছিল। ওটা পার হয়ে মোর বাড়ি। এলাও নাম আচে ওটার, আন্ধার বাঁশের তল। দিনের বেলাতো ওটে সূর্যের আলো ঢুকছিল না। ডাকাতের ভয়ত লোকজন এটে রাইতোত আইসে না। মুই তখন তাগড়া জোয়ান, এক বসাত একখান কাডোল খায়া খেলবার পারছুনু। মোর অতো ভয় আছিল না। বাঁশের আড়াতের মাজের রাস্তা দিয়া যাওছুনু। এটুকু বলেই মারুফের মুখের দিকে তাকায় বৃদ্ধ। একটু ঘোলা চোখ।চোখে কি ছানি আছে? মনে হয় আছে। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করে,তোরা ক্যায় বাহে? তোমাক তো চিননো না?

আমি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করি। একটা পার্সেল ডেলিভারি দিতে আসছি, বলে মারুফ। আপনার গল্প শুনছি, খুব মজা করে গল্প বলতে পারেন আপনি।

এই ছ্যামড়া কয় কি? এগুলা গল্পো নোয়ায় সত্যি ঘটনা।

পাশে বসা লোকজন অধৈর্য হয়ে ওঠে, আরে তোরা থোন তো আন্দাসুন প্যাচাল। গল্পোটা শ্যাষ করেন।

বৃদ্ধ মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে। নিশ্বাস নেয় শব্দ করে, মাথা কাঁধ ওঠানামা করে দ্রুত।

কী হইল তোমার বাহে? ঘুমাইনেন নাকি?কতা কন না কেন তা?

বৃদ্ধ মাথা নিচু করে আরও, চিবুক মিশে যায় বুকের সাথে। কোনও দিকে খেয়াল নাই।

টং এর সামনের চায়ের দোকানদার বলে, বুড়া ঘুমি গেইছে। এলা উয়াক চা, বিস্কুট, পান না খওয়াইলে কতা কবার নয়।

ধান কাটামারা শেষ। লোকজনের হাতে টাকা আছে। বিকালে নতুন চামড়ার সেন্ডেল আর প্রিন্টের শার্ট পরে শ্যামপুর বন্দরে যায়। চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করে দেশ, ধর্ম আর নারীদের নিয়ে। শ্যাখের বেটি কী করলো, কী করা  দরকার ছিল এসব নিয়ে জোর আলোচনা হয়। চৈত্রের এই দুপুরে বাসায় থাকা কঠিন, আড্ডা বসেছে তাই এই টং এ।

রহিমুদ্দিন গজগজ করে লুঙ্গির কোচায় হাত দিয়ে টাকা বের করে। চা দিতে বলে দোকানদারকে।

বেশ জোরেই চায়ের অর্ডার দেবার কারণেই কি না, বৃদ্ধ জেগে ওঠে। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, মাঝ ঘাটাত আসি দ্যাকো আলো আর আলো, বাঁশের তলা উজাল হয়া গেইছে। একনা আগে গিয়া দেখো, দুইটা সেইরম বড়ো সাপ মারামারি করোচে আর একখান পাথর থাকি সেই আলো বেরাওচে। মুই বুঝবার পারনু এটা সাপের মাথার মনি। মুই আগবার গেনু, সেই শব্দ করোচে, ফোঁস ফোঁস শব্দোত, কান তালা নাগি যাবার অবস্থা। দৌড়ি বাড়ি চলি গেনু। হুড়োহুড়ি করি একখান ডালি নিয়া ফির আসি দ্যাকো কোনো কিছুই নাই। খালি ঐ জায়গাটা পুড়ি কালা হয়া গেছে। মুই ছুটাছুটি করনু, এপাক, ওপাক, কিছুই নাই। গলা জড়িয়ে আসে বৃদ্ধের, আবারও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পরে। কয়েক মুহুর্তেই আবার গা ঝাড়া দিয়ে, চায়ে চুমুক দিয়ে শব্দ করে, আহ্। মাথা দোলায়, চোখ বন্ধ করে।

তারপর কী হলো? মারুফ অধৈর্য হয়ে বলে বসে। বলেই লজ্জা পায় কিন্তু কেউ বিষয়টা খেয়াল করে না, যেন এ প্রশ্নটা সবার।

মোবাইল বেজে ওঠে, লক্ষ্য করে দেখে নীলা ফোন দিয়েছে।

হ্যালো, ম্যাম আর কতক্ষণ বসে থাকব?

আপনি কোথায়?  এই তো বৈকুন্ঠপুর, পুটিমারিতে একটা চায়ের দোকানে।

আরে ওখানে গেছেন কেন? আপনাকে না বললাম, জোদ্দার পাড়ায় আসেন।

ওহ্, আমি তাহলে শুনতে ভুল করেছি।

আসেন, তাড়াতাড়ি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

মারুফ তবুও বসে থাকে, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সবার মতো বৃদ্ধের দিকে। তার তাড়া আছে আরও একটা প্যাকেট ডেলিভারি দিতে হবে। নীলা অপেক্ষা করছে নীলের পাঠানো প্যাকেটের জন্য। জনা দশেক লোক আর চায়ের দোকানদার সবাই চুপ করে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে, গল্প শুরুর। বৃদ্ধ মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

প্রযত্নে নীলা - ফেরদৌস রহমান পলাশ

মুগ্ধতা.কম

২৯ মে, ২০২২ , ১০:০৬ অপরাহ্ণ

পরমাণু গল্প

করোনা পজিটিভ

বাবা, আমার করোনা পজিটিভ হলে কি আমাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসবে?
ছেলের এমন প্রশ্ন শুনে বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে, ‘না বাবা, কোনদিনও না, কখনোই না। বাবারা কখনোই ছেলে-মেয়েদের বোঝা মনে করে জঙ্গলে ফেলে আসে না। বাবা তুমি বাড়ি থেকে বের হবে না, তাহলে তোমাকে করোনা ধরতেই পারবে না।’

_______________________________

এন্ড্রয়েড মোবাইল 

শিলা ও সাগরের ডিভোর্স হয়ে গেলো আজ। সাগরের উপহার গুলো ফেরত দিলো শিলা। ফেরত উপহারের মাঝে  স্বামীর দেওয়া শেষ উপহার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটিও ছিলো। যা ডিভোর্সের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

___________________________

ঘুষখোরের লাশ

সারাজীবন ঘুষ খেয়ে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন জামাল উদ্দিন সাহেব। কিন্তু ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে পারেননি।
জামাল উদ্দিনের লাশ বিশাল অট্টলিকা বাড়ির আঙ্গিনায়। ৩ ছেলে ও ২ মেয়েরা জামাইসহ  এসেছেন। লাশ দাফন করার আগেই ছেলে মেয়েদের মাঝে মারামারি লেগে গেলো বাসার ভিতর। তুমুল মারামারি। আত্বিয়স্বজন সেই মারামারি থামাতে ঘরে ছুটলেন।
লাশ পড়ে রইলো একা।

সেই সুযোগে একদল কুকুর লাশকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেললো নিমিষেই। এলাকাবাসীর কেউ-ই আগে কখনো কুকুরগুলোকে দেখেছেন বলে মনে পড়লো না কারোই।
______________________________

সতীনের ছেলে

সতীনের একমাত্র ছেলেকে ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়ায় শবনম।

দ্বিতীয় স্বামীর ঘর ভাঙার ভয়ে সতীনের ছেলেকে খাওয়ানো শুরু করলেও তার মুখ দেখতে চায় না সে।
________________________

পরীক্ষায় পাশ

ছাত্র: স্যার, দেখি আমায় আপনি কিভাবে ফেল করান!

স্যার: গুড, তাহলে এবার তুমি ভালোই পরীক্ষা দিয়েছো?

ছাত্র: আমি এবার পরীক্ষাই দেইনি।
__________________

নতুন সকাল

সারারাত অপেক্ষায় থাকলো রাশেদ। গতকাল সকলে বলেছে, আগামীকাল একটি নতুন সকাল আসবে, সব দুঃখ কষ্ট চলে যাবে। সম্ভবনাময় আলোকিত হবে সব।

কিন্তু কোথায়? তার যেভাবে সকাল শুরু হয় সেভাবেই শুরু হলো। জীর্ণশীর্ণ  ছেঁড়া কাঁথায় বেড়িয়ে যাওয়া পা আজও বেড়িয়েছে। বিকট যান্ত্রিক আওয়াজে ঘুম না আসা সকাল সেই-ই। তবে নতুন সকাল কই?
___________________________

একটু হাসি

আকবর সাহেবের বিয়ে হয়েছে দশ বছর। মাত্র দুই দিন হলো তিনি প্রথম বাবা হলেন। কিন্তু বাবা হয়েও তিনি তার সন্তানকে কোলে তুলে নিতে পারছেন না। জন্মের পর হতেই তার সন্তান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের. … তে।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রতিদিন দুপুরে আসে আর একটি কথাই বলে- আকবর সাহেবকে ‘বাবু হেসেছিলো একবার’। ডাক্তার ১০ দিন যাবত এই একই প্রশ্ন করছেন আকবর সাহেবকে। যতবারই তিনি প্রশ্নটি শোনেন ততবারই তার কান্না পায়।
__________________

ত্রাণের চাল

চালের বস্তা দুর্বল হলে যা হয়। এক পাশে ফুটো হয়ে ধড়-ধড় করে পড়তে শুরু করলো। মাথা থেকে নামাতে নামাতে বেশ কিছু চাল রাস্তায় ইট পাথরে মিশে গেলো।

রহিমা শাড়ির আঁচল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলো। তাতে ঠিকমতো ঢাকা হলো না বুকটা।

ইজ্জত! হায়রে গরীবের ইজ্জত!

সাতদিন পর আজ পেলে ত্রানের চাল। তিনদিন অভুক্ত ছেলে মেয়েরা পথ চেয়ে আছে তার।

রোদে তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তায় জোড়ে জোড়ে পা চালায় রহিমা।
_______________________

সুদের টাকার বাড়ি

মহিবর চাচা সুদের ব্যবসা করেন। উনি মনে করেন তিনি অভাবী মানুষকে প্রয়োজনের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করছেন। বিনিময়ে কিছু টাকা নিচ্ছেন। তিনি এই সুদের টাকা দিয়ে একটি তিনতলা বাড়ি বানালেন। এলাকার লোকজন সেই বাড়ির নাম দিলো ‘সুদের টাকার বাড়ি’।
________________________

পরিষ্কার হাত

আবুল সাহেব এক পুরোনো দোকানে একটি মজার আয়না পেলেন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর আয়নার সামনে ধরলে সহজেই বোঝা যাবে হাত পরিষ্কার হয়েছে কিনা?

অফিস থেকে বাসায় ফিরে বার বার হাত ধোয়ার পরেও আবুল সাহেবের হাত পরিষ্কার হচ্ছে না!

উনি স্পষ্টই বুঝলেন ঘুষখোরের হাত কখনই পরিষ্কার হয়না।
__________________________

মায়ের মৃত্যু

মায়ের মৃত্যু সইতে পারলো না টগবগে যুবক শাহজাদা। মাত্র সতেরো ঘন্টার মধ্যে নিজেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলো সে।
___________________________

ইচ্ছের মৃত্যু

টুটুল আর সিমু পাশাপাশি নির্জনে বসে থাকার সময় টুটুলের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সিমুর গালে চুমু খেতে। কিন্তু ইচ্ছের মৃত্যু হলো অঙ্কুরেই। ইচ্ছের বাস্তবায়ন করতে যদি পাঁচ বছরের ভাল বন্ধুত্বই নষ্ট হয়ে যায়!

____________________

বন্যা শিশু

বানের জল এক্কা দোক্কা খেলে

অভুক্ত থেকে যায় সদ্য জন্মনেয়া শিশুটি

যেখানে জন্মদেয়ার পর জ্ঞান না ফেরা মা আর কষ্ট পায় না।

প্রসব বেদনা ভুলিয়ে দিয়েছিলো ক্ষুদার জ্বালা, আর কোন কষ্ট নেই মায়ের

সব কষ্ট দিয়ে গেছে সদ্য জন্মনেয়া শিশুটিকে।

কোথায় আজ সমাজ?

তাকে কী ঠাঁই দেবে বানের জলে ভেসে যাওয়া ভিটে?

১৯৮৮ সালের বন্যায় জন্মনেয়া মা

২০১৭ সালে জন্মদিল মেয়ের।

বানের জলের মতো ভাসতে-ভাসতে শেষ ঠাই হয়েছিল কছিম উদ্দিনের কুঁড়ে ঘরে,

বানের জলের সাথে চলে যাওয়া মায়ের প্রাণটা তছনছ করে দিলো আরেকটি শিশু কন্যার জীবন।

বানের জল এক্কাদোক্কা খেলে

খেলে যায়-দূর দিগন্ত কাছে দেখা যায় না,

শুধু দেখা যায় অবাধ্য জলময় দেশ।

পরমাণু গল্প - আসহাদুজ্জামান মিলন

মুগ্ধতা.কম

২৭ মে, ২০২২ , ১২:৪৩ অপরাহ্ণ

সাবালক

ডিগ্রীতে পড়ি। বয়স কুড়িমতো হইবে। দুরবিন দিয়া খুঁজিয়া সারা মুখে কতক বাদামী পশম দেখিতে পাই। আমার নাকের নিচে, ডানে বামের অনুর্বর অঞ্চলে কিছুই জন্মায় না। নিজেকে বড় নাবালক লাগে। ডিগ্রীতে পড়া ছেলেদের কারো কারো ঝাঁকড়া চুল তাহাতে আবার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কেতাদুরস্ত ভাব লইয়া প্যান্টের ব্যাকপকেটে ভাঁজকরা রেখা খাতা লইয়া যখন কলেজে আসে, মাঠে ঘোরে, কলেজের পুকুরপাড়ে তাসের আড্ডায় চুল ঝাঁপিয়ে ট্রাম্পকার্ড ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করে কিংবা মেয়েদের দলে বসে বাদাম খুলটে ফু দেয়- আমি ছেলে মানুষটা সেইসব ছেলেদের প্রেমে পড়িয়া যাই। ভাবি, আমার ইহজীবনে কিছুই হইবে না। ক্লিনশেভড মুখ আর সাথে তেমন ঝুলপি চুল যদি রাখিতে পারিতাম তবে আমার মতো সুখী মানুষ বুঝি কমই হইত। কিন্তু তেমন করিয়া রাখিতে পারিব না, কারণ বাবা তাহা পছন্দ করিবেন না। তিনি কঠিনধাতের মানুষ। অতিবাস্তববাদী লোক। তিনি নিজে সর্বদা ক্লিন শেভ করিয়া থাকেন। তাই সেটাতে অসুবিধা হইবার কথা নহে। তাই সাবালকত্ব লাভের জন্য সেটার চিন্তা করিতেছি।

দোয়ানী বাজারের আজিজুল আমার বাল্যবন্ধু। ও যখন ক্লাশ নাইনে পড়ে তখন ওর সারামুখে ঘনকালো দৃশ্যমান দাড়ি, মোচ। আমি তখন ইন্টারমিডেয়েট সেকেন্ড ইয়ার। খুব বড়রা বাদ দিয়ে পাড়ায় কোন সিনিয়র জুনিয়র নাই। সবাই ভাইভাই, বন্ধু বা বন্ধুর মতো। কিভাবে যেন তাহার সাথে খুব ঘনিষ্ট হইলাম, জানি না। সেই স্বল্পবয়সেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। ঠিক সেসময়ই আফসোস করিতাম, আহা, আমার যদি এই মুখখানা হইত! শুধু হাপিত্যেস করিতাম আর ভাবিতাম, কখনো কী আমার তেমন হইবে? ডানহস্তে, বাঁহস্তে নিজের বদনখানি নাড়িচাড়ি আর ভাবি, আমি কি তবে বড় হইবো না?

সেইসবদিনে হকবাজারের বিখ্যাত ভোলা নাপিত যখন বন্ধুর চুল, দাড়ি কাটে আমি অপলক চাহিয়া থাকিতাম। অন্য চেয়ারে বসিয়া মাঝেমধ্যে প্রমানসাইজ আয়নায় আমার নিরসবদনখানি দেখিতাম আর মনে মনে প্রার্থণা করিতাম যেন দ্রুত আমারো তাহার মতো হয়।

কিন্তু যাহা তাহাই! যাহার হয় তাহারই হয়। আমার তাহা নহে।

বন্ধু আমার দু:খ বোঝে। আমি তখন বি, এ ফার্স্ট ইয়ার। আর সে পড়ালেখা বাদ দিয়া বাড়ির সামনে মুদিখানা দিল। বিকাল, সন্ধ্যায় তাহার দোকানে আড্ডা মারি আর তাহার সোনাবদনখানি দেখে দেখে কতশত গল্প করি। কথাচ্ছলে সে-ই একদিন বলিল, “শেভ কর্। দুই-চারিবার ক্ষুর পড়িলে প্রচুর গজাইবে।” কথাখানা একান্তই আমার মনের কথা। তাই মনে ধরিলো। এই না হইলে বন্ধু কিসের! বন্ধুই তো বন্ধুর গোপন কথা, মনের ব্যথা বুঝিবে, স্বাভাবিক।
ভাবলাম, তথাস্তু!

বন্ধু যেহেতু মুদিখানা সামলাইতে ব্যস্ত। তাহার আর আমাকে সঙ্গ দেবার সময় নাই বা অযথা ঘোরাঘুরি তাহার শোভা পায় না। তাহার সাথে প্লান প্রোগ্রাম ঠিক করিলাম বটে, কিন্তু একাই যাইতে হইবে এবং তা-ই সাব্যস্ত করিলাম।

বাড়ি হইতে তিনকিলোমিটার দূরে খানসামা হাট। সেইদিকে যাইবো। শুক্কোরবার আর সোমবার হাটবার। হাট শুরু হয় দুপুরের নামাযবাদ। সেই হাট জমাইয়া তোলার জন্য কাজকারবার শুরু হয় সকালবেলা থেকে। ধোয়ামোছাসহ ইত্যকার কাজ। বাঁশের ফোল্লা ( ব্যাঙ্ক) কেটে লুঙ্গির খোঁটে ত্রিশ টাকা রাখিলাম। আমাদের বাজারের নাপিত চুলদাড়ি শেভ করা পাঁচ, ছয় টাকা নেয়। শুধু দাড়ি শেভ করিতে তিন টাকা লাগিত। কেউ কেউ দুই টাকাও দিয়া থাকেন। নাপিতরাও সেইটাকা কপালে ঠেকাইয়া ক্যাশবাক্সে রাখিতেন। খানসামায় যদি অনেক বেশি চায় বা নেয়, তাই অপদস্ত হইবার ভয়ে ত্রিশ টাকাই লুঙ্গির কোঁচে রাখিলাম। এখানে বলিয়া রাখি, আমাদের ছাত্রাবস্থায় গ্রামাঞ্চলে তখনো ফুলপ্যান্ট পরে ঘোরার চল শুরু হয়নি। শহরে চলে সেটা বেশ। তবে দু’একজন, যারা শহরে পড়িত, হোস্টেলে বা মেসে থাকিত, সেসময় তাহাদের কেউ কেউ গ্রামে আসিলে প্যান্ট পরিয়া বেড়াইত। অবশ্য আরামকে ভুলে সেটা মেয়েদের দেখানো বা উন্নতজাতের ছাত্র হিসেবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতে তাহা করিত। কিন্তু আমরা যাহারা নিয়মিত গ্রামে থাকি তাহারা কখনো নয়। এমনকি শহরে সিনেমা দেখিতে যাইতাম লুঙ্গি পরিয়া। অন্য আরেকটা সত্য হইল আমাদের কেহ কেহ লুঙ্গি পরেই কলেজে ক্লাশ করিতো পিছনে বসিয়া।

যাইহোক, বিভিন্ন ঘোরা পথ ব্যবহার করিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া খানসামা হাটের দিকে যাই আর পিছন ফিরিয়া দেখি কেউ আমাকে দেখিতেছে কি না। চেনাশোনা কাউকে দেখিলে বড়সড় কোন গাছের আড়ালে বা পথের ধারে বাঁশঝাড়ে লুকাইয়া পড়িতাম।

কুড়ি মিনিটের পথকে ঘন্টা বানাইয়া অবশেষে হাটে এসে বিক্ষিপ্তভাবে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করিয়া দেখি তুলে বসিয়া পাশাপাশি দুইজন নাপিত বিরসবদনে বসিয়া আছে খদ্দেরের আশায়। না, তাহাদের নিকট যাইবো না। রাস্তার পাশে চাকচিক্যময় এক নাপিতের দোকানে সুযোগ নিলাম। দোকান ছিল ফাঁকা। সাহস করিয়া চেয়ারে বসিলাম। বলিলাম, চাচা, আমাকে শেভ করিয়া দিন। শরীরখানা একটু নড়াচড়া করিলেই আয়নায় মুখখানা এমনভাবে উঠানামা করিতেছিল মনে হইল যেন আমাকে ব্যঙ্গ করিতেছে। তখন চেয়ারটাকে তপ্ত উনুন মনে হইতেছিল। নাপিত চাচা দ্রুতই সাদা কাপড়ে পেঁচাইয়া মুখে পানি মাখিলে, ক্রীম ঘষে ব্রাশে ফেনা তুলিলে একটা স্বর্গীয় আবেশ ভর করিল। বারবার কৌশল করিয়া চক্ষু ঘুরাইয়া দোকানের বাহিরে দেখি, কেউ আবার দেখিতেছে কিনা। ভেতরে একটা ছটফটানি কাজ করিতেছিল। যাইহোক, নাপিতের নিকট প্রত্যাশিত কাজটা করাইয়া শেষে বিপদে পড়িলাম। এই মুখ নিয়া কেমনে গ্রামে ঢুকিবো? সবাই যে দেখিতে পাইবে। সে আর এক ভীষণ জ্বালা হইলো। বুকে সাহস আনিয়া নাকে হাত দিয়া, কখনো গাল চুলকাইয়া চুলকাইয়া মুখখানা আড়াল করিয়া আগেরমতো করিয়া বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করিলাম। আবার সাবালকত্ব লাভে মনে মনে পুলকিত হইতেছিলাম। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুরুষতো হইলাম! মেয়েদের কারো কারো মুখ মনে ভাসে তখন। শরীরটা চনমন করে। সারাবিকাল দিগ্বিদিক ঘোরাঘুরি করিয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়িতে আসিয়া হাত-মুখ ধুইয়া খাবার চাইলাম। মা হারিকেনের আলোতে টের পায় নাই। তারপরও মুখ ঢাকিয়া খাইলাম। পড়িতে বসিলাম। পড়া ভাল্লাগে না। আমার মানিব্যাগের ছোট একটা আয়নায় নিজের সোনাবদন দেখি আর পুলকিত হই। ভাবি, বালিকা মহলে বুক উঁচু করিয়া কথা বলিবার অধিকার পাইলাম।

যাইহোক, সেইসব প্রেমপ্রীতির কথা বা কাহিনি অন্য একদিন বলিব। যে দাড়ি, মোচের জন্য এত কাণ্ড আজ তাহারই জন্য বিরক্ত বোধ করি। দাড়ি, মোচ শেভ করিবার মতো অসহ্য কাজ আর দ্বিতীয়টি নাই।

রম্যগল্প - মাসুম মোরশেদ - সাবালক

রবীন জাকারিয়া

৩০ মার্চ, ২০২২ , ১০:৪৭ অপরাহ্ণ

বইমেলা দর্শন

(বর্ণিত স্থান, কাল, পাত্র কাল্পনিক৷ প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের এ গ্রামটাতে কাকতালীয়ভাবে কিছু মিলে গেলে সেটার দায়ভার লেখকের নয়৷)

আয়াজ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে৷ এ সেক্টরে চাকরি হলো কচু পাতার পানি৷ এই আছে, এই নেই৷ সঙ্গত কারণে তার চাকরি আর কর্ম এলাকা কম দেখা হলো না৷ বিষয়টাকে সে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে৷ কেননা সে হতাশাবাদী নয় বরং বাস্তববাদী৷ এটা একটা বড় গুণ৷ একটা দক্ষতা৷ এটা জ্ঞানের প্রকাশ৷ আর জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠাভ্যাস জরুরি৷ সে প্রচুর বই পড়ে৷ বলা যায় বইয়ের পোকা৷

প্রতিবছর বইমেলায় মানুষের ঢল দেখলে তার ভালো লাগে৷ সে চায় সকলে বই পড়ুক৷ লেখক তৈরি হোক৷ কেননা যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি ততো উন্নত৷ কিন্ত ইদানীং মনে হচ্ছে এটা মিথ্যা কথা৷ শ্রীলংকায় প্রায় ৯৯% শিক্ষিত হওয়ার পরও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই করুণ যে সরকার কাগজের অভাবে পরীক্ষা স্থগিত করে দিয়েছে৷ নিজেদের মূদ্রার দাম এতই কমে গেছে যে চালের দাম ৫০০ শ্রীলংকান রুপি৷ ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকায় দেশ ছাড়ছে মানুষ৷ আয়াজ ভেবে পায় না কারণটা কী? তবে কি শিক্ষা ব্যবস্থাটা বাস্তব উপযোগী ছিল না? না কি শিক্ষার হারের তথ্যটা সঠিক নয়?

আয়াজের কখনো বই মেলায় যাওয়া হয়নি৷ অবশ্য ইচ্ছেও করেনি৷ তবে গত বছর চাকরির সুবাদে ঢাকায় ছিল৷ তাই ভেবেছিল এবার সে বইমেলায় যাবে৷ কিন্ত করোনার কারনে সরকার মেলা বন্ধ করে দেওয়ায় যাওয়া হয়নি৷

এ বছর মেলা চলেছে পুরোদমে৷ সে কী তোলপাড়! গণজোয়ার! তার বেশ কিছু বন্ধু লেখক৷ তারা নতুন বই ছেপেছে৷ মেলায় উম্মোচন করবে৷ বন্ধুদের বেশিরভাগ বইয়ের প্রুফ দেখার কাজ যেহেতু আয়াজকে দিয়ে করানো হয়৷ তাই লেখক বন্ধুরা তাকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করে৷ সে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে৷ তবে ফেসবুকে লাইভে সে নিয়মিত বইমেলার হাল হকিকত জানতে পারে৷ কিছুদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে ফেসবুক লাইভে দিবা নিশি একজন বান্দরের মত লাফালাফি আর ঝাপাঝাপি করে প্রকাশ করছেন তার লেখা বইগুলো নাকি অত্যন্ত ভালো৷ শুধুমাত্র বইমেলায় নাকি তার বইয়ের শততম এডিশন হয়েছে৷ এমনকি এমন কথাও বলছেন যে তার বইয়ের দাম একটু বেশি৷ কারণ ভাল লেখকের বইয়ের দামটাও বেশি হয়৷ উনি কমদামি বই লেখেন না! আয়াজ পরে জানতে পারল এই বান্দরটা নাকি বর্তমানে দেশের একজন নামজাদা লেখক! ভয়ঙ্কর অবস্থা৷ তবে কি বর্তমানের লেখকরা ম্যানার বা শালীনতা বোধটুকুও নষ্ট করে ফেলেছেন? এদের বই পড়া যাবে না৷ এই আচরণের লেখকদের বইয়ে কী-ই বা থাকবে যা দেশ-সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগবে? এসব দেখে বই মেলা দর্শনের ইচ্ছেটুকুই নষ্ট হয়ে গেল৷

আয়াজ এখন নিজ শহরেই থাকেন৷ করোনার কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানেই কিছু একটা করছেন৷ অনেক হয়েছে চাকরি৷ আর গোলামি না করে সে নিজে একটা এগ্রো ফার্ম প্রতিষ্ঠা করছে৷ তাছাড়া ছেলে-মেয়ে দুটোর লেখাপড়ার জন্য তার এখন নিজ শহরে থাকা দরকার৷ তার স্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভব নয়৷ একে যদি স্কুলে নিয়ে যাও তো ওকে কোচিং-য়ে৷

গত দুদিন আগে শুরু হয়েছে জেলা ভিত্তিক বই মেলা৷ আয়াজ ফেসবুক পোস্ট থেকে জেনেছে৷ এ বিষয়ে তার কোন কৌতুহল নেই৷ তার কিছু বন্ধু লেখক তাকে মেলায় আসার নিমন্ত্রণ করেছে৷ ঠিক আছে যাব বলে পাশ কাটিয়েছে৷

আগামী পরশু আয়াজের সন্তানদের ১ম সেমিস্টার পরীক্ষা৷ তাই তার মেয়ে তাকে একটা বাংলা ব্যাকরণ বই কিনে আনতে বলল৷ সে বই কিনে ফেরার পথে কী মনে করে অথবা বলা যায় কৌতুহল বসে বই মেলার সামনে দাঁড়াল৷ ভেতরে যাবে কি যাবে না দোটানায় পড়ল৷ শেষে ঢুকেই পড়ল৷ চারিদিকে সাজ সাজ ভাব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তীব্র গানের আওয়াজ আর হৈ হুল্লোর দেখে মনে হলো মেলা বেশ জমে গেছে৷ ভাল লাগলো৷ সে একটা গেট দিয়ে ঢুকে তো অবাক! কীসের বই মেলা! বিশাল এলাকা জুড়ে স্টলে ভরপুর৷ এটা আসলে SME মেলা৷ ও ঘুরে ঘুরে দেখল৷ কারুপণ্য৷ সেলাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে মেয়েদের অন্তর্বাস পর্যন্ত কিনিবিকি চলছে৷ প্রতিটি স্টলে দাঁড়িয়ে আছে সাজুগুজু করা সুন্দরি ললনা৷ মানুষের ভীড় বেশ৷

মেলার গেট পেরিয়ে আয়াজ দেখতে পেল বিশাল এক মঞ্চ৷ যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে৷ আর পুরো এলাকা জুড়ে আবালবৃদ্ধবণিতার ঢল৷ কিছু ছেলে মেয়ে মিউজিকের তালে তালে প্যান্ডেলের বাহিরে নাচে উম্মত্ত৷ কিছুটা সময় সেখানে কাটাল৷ তার মনে হলো গানগুলো আর শ্রুতি মধুর নেই যেন শব্দদুষণ৷

আয়াজ অবশেষে খুঁজে পেল তার কাঙ্খিত বইমেলা৷ ছোট্ট গেট৷ ভেতরে ঢুকে বহু কারণে সে অবাক! এত ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে ছোট ছোট স্টল৷ আচ্ছা তবে কি এটা বই মেলার জন্য মেলা করেছে! নাকি SME মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নামক সোনার সোহাগা হিসেবে বই মেলা আয়োজন করেছে৷ আরো আজব বিষয় এখানে প্রায় সব স্টলে সুন্দরি ললনারা দাঁড়িয়ে৷ পেশাদার বিক্রয়কর্মীর ন্যায় মুখে হাসি নিয়ে অপেক্ষায় আছে ক্রেতার আগমনের জন্য৷ যদিও প্রায় ফাঁকা প্রতিটি স্টল৷ আচ্ছা এ শহরে কি পুরুষ লেখক নেই? যদি না-ও থাকে তথাপিও একজন লেখিকাকে মঞ্চের অভিনেত্রীর মতো উগ্র সাজে আর আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় বই বিক্রি করতে হবে কেন? একজন লেখক আর SME মেলার একজন বিক্রয় প্রতিনিধির কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না৷ আয়াজ লেখক নয় তাই সে বলতে পারছে না বই বিক্রি করা আসলে লেখকের নাকি প্রকাশকের দায়! জীবনের প্রথম বই মেলা দর্শনে হতাশ হয়ে লেখক বন্ধুদের ফোন করে জানতে পারে তারা চলে গেছে৷ আয়াজ রসিকতা করে বলল, আসলাম ঠিকই কিন্ত তোমাদের সুন্দর মুখগুলো দেখা হলো না৷ একজন মজা করে বললো অসুবিধা নেই সুন্দরীরা আছে৷ সে বললো, “আমি সুন্দর পছন্দ করি, শুধুই সুন্দরী নয়”৷

হতাশ হয়ে আয়াজ ফিরে আসছে এমন সময় গেটে এক বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার সাথে দেখা৷ ঠিকমতো চলতে পারছে না৷ সে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো চাচা এগুলো কী বিক্রি করছেন? চাচা বলল, খেলনা, বাঁশি, হেড ব্যান্ড, পতাকা এই সব ব্যাটা৷ তারপর বলতে লাগল, সে বিহারী৷ বয়স নব্বই বছর৷ স্টেশনের পাশে থাকে৷ ১৯৭১ সাল থেকে সে এই ফেরি ব্যবসার সাথে জড়িত৷ তিন ছেলে দুই মেয়ে৷ সকলেই বিবাহিত৷ আলাদা থাকে৷ বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী৷

ছেলেরা দেখাশোনা করে না?

অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে কান্নামাখা কন্ঠে বলল, “বাবারে বউরা রূপ যৌবন দিয়ে ওদের ভুলিয়ে দিয়েছেরে বাবা! নাহলে কি এই বয়সে আমাকে ফেরি করতে হয়?”

আয়াজ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিরতি পথে হাঁটতে লাগল৷ আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল চাচা শুধু আপনার বউমারা নয় আমরা সবকিছুকেই, এমনকি সম্পর্কটাকেও পণ্য বানিয়েছি৷  আর হয়ে গেছি Sex appeal এ ঠাসা একেকজন নষ্ট ফেরিওয়ালা৷

গল্প - বইমেলা দর্শন - রবীন জাকারিয়া

রবীন জাকারিয়া

২২ মার্চ, ২০২২ , ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

পরকীয়া

জয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় সহপাঠী জয়িতাকে গোপনে বিয়ে করে৷ তিন বছরের প্রণয়ের সম্পর্ক রূপ পায় পরিণয়ে৷ তার পরিকল্পনা ছিল পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে একটা চাকরি জোগাড় করার পর বাবা-মাকে জানাবে৷ যদিও হৃদয় কোণে একটা সুক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করে৷ তবুও কিছু করার নেই৷

জয়িতা এক অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে৷ বাবা গৃহস্থালী কাজ করেন৷ দুই ভাই টেনেটুনে মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে৷ জয়িতা মাঝারি টাইপের মেধাবী হলেও উচ্চাকাঙ্খি৷ অত্যন্ত বৈষয়িক আর সংগ্রামী৷ যে কোনো মূল্যেই সে তার স্বপ্ন পূরণে বদ্ধ পরিকর৷ এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রাইভেট স্কুলগুলোর একটায় স্বল্প বেতনের চাকরি করত৷ চাকরির বেতনের চেয়ে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্কুলের ব্র্যান্ডটাকে কাজে লাগিয়ে টিউশনির ফি-টা বেশি পাওয়া৷ কয়েকটি টিউশনি, স্কুলের বেতন আর নিজের স্কলারশিপের টাকা আয় হিসাবে মন্দ নয়৷ সুন্দরী হবার কারণে অনেকের ক্রাশ ছিল৷ স্থানীয় কলেজের মেধাবী সহপাঠী ও বড় ভাইদের সাপোর্টটুকু কৌশলে নিতে পারত৷ সকলের সাথে সাবলীল মেলামেশার কারণে জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না৷ তাই বিত্তবান বন্ধুরাও তাকে আর্থিক সাহায্য করত৷ সে ‘‘এসব চাই না, শুধু দোয়া কোরো তোমরা’’-এসব বললেও কখনও তা প্রত্যাখান করেনি৷

গৃহস্থ বাবা-মা সহজভাবেই মেয়ের এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করেনি৷ শুধু দোয়া করেছে আর হাহাকার করেছে তাদের মেয়ের জন্য তেমন কোন সাহায্য না করার অপরাধে৷ ভেবেছে ইশ! মেয়েটাকে যদি আরো একটু খরচাপাতি দিতে পারত!

মাধ্যমিক থেকে ভার্সিটির পরীক্ষা পর্যন্ত ওকে সবচেয়ে সহায়তা করেছে রাশেদ৷ ওর এক ক্লাশ সিনিয়র৷ ও বড়লোকের ছেলে এবং ভীষণ মেধাবী৷ রাশেদ জয়িতাকে ভালোবাসত৷ পাগলের মতো ভালবাসতো৷ ওকে হারানোর ভয়ে রাশেদ ওর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করত৷ শুধু পড়াশুনার খরচ নয়৷ হাত খরচ, কাপড়-চোপড়, গহনা-পাতি সব৷ জয়িতার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করার জন্য সে তার সাথে পুনরায় পরীক্ষা দিত এবং একসাথে ফরম ফিলাপ করত যেন পাশাপাশি সিট বসে৷ আর সে জয়িতাকে সাহায্য করতে পারে৷ প্রেমিক রাশেদের অফুরান ভালোবাসা আর সাপোর্টে জয়িতা অবশেষে চান্স পেয়ে গেল ভার্সিটিতে৷ কিন্ত দুঃখজনকভাবে রাশেদ ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেলেও জয়িতা পেল রাজশাহী ভার্সিটিতে৷ রাশেদ এরপরও খরচ চালিয়ে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ জয়িতাই তাকে আর টাকা পাঠাতে নিষেধ করল৷ জানাল এখন সে নিজে বহন করতে পারবে৷

এ সময়ে জয়িতার সাথে জয়ের পরিচয় হয়৷ সে জানতে পারে জয়ের বাবা পুলিশ অফিসার৷ শহরে তাদের চারটি বাড়ি৷ গ্রামে কয়েক একর আবাদি জমি৷ সেখানে খামার বাড়ি আছে৷ মাঝে মাঝে বিনোদনের জন্য তারা সকলে মিট টুগেদার করে৷ এলাকায় তাদেরকে জমিদার হিসেবে মান্য করে৷ জয়রা দুভাই-বোন৷ বাবা পুলিশ অফিসার আলতাব হোসেন৷

জয়কে দেখেই ভালো লেগে যায় জয়িতার৷ অন্যদিকে জয়িতার জীবন সংগ্রাম জয়কে মুগ্ধ করে৷ তাই করুণা নয় বরং ভালোবেসেই জয় জয়িতার পড়াশুনাসহ যাবতীয় খরচের দায়ভার নিয়ে নেয়৷ এভাবেই চলতে থাকল তিন বছর৷ হঠাৎ একদিন জয়িতা তাকে বিয়ে করতে বলে৷ তা না হলে বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবে৷ এমনকি পড়াশুনাটাও বন্ধ করে দিতে হবে বলে জয়িতা কাঁদতে শুরু করে৷ ওর কান্না দেখে জয় কোনো কিছু চিন্তা না করেই সেদিন কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেললো৷

পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে জয় একটা চাকরির জন্য ছুটে বেড়াতে লাগল৷ জয়িতা আর এক বছর পর বেরিয়ে আসবে৷ হাতে মোটে একটা বছর৷ অবিরাম চেষ্টার পরও কোনো চাকরি জুটল না৷ জয়িতা পড়াশুনা শেষ করে বের হলো৷
কোনো উপায় না দেখে অবশেষে জয় জয়িতাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে এলো৷ সকলে ভীষণ খুশি৷ উচ্চ শিক্ষা শেষ করার জন্য বাবা পার্টি দিলো৷ হৈ হুল্লোর হলো৷ এরপর একদিন যায়৷ দুদিন যায়৷ এমনিভাবে প্রায় মাস শেষ হতে চলল৷ কিন্ত মেয়েটা কেন এখনো চলে যাচ্ছে না! মহা মুশকিল৷ এতদিন বন্ধুর বাড়িতে একটা মেয়ের যেমন থাকাটা শোভনীয় নয় তেমনি আলতাব সাহেব নিজে থেকে চলে যাবার কথাও বলতে পারছেন না৷ তিনি স্ত্রীকে ডেকে বিষয়টা হ্যান্ডল করতে বললেন৷

এক ফাঁকে জয়কে ওর মা জয়িতা চলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন৷ জয় মাথা নিচু করে শুধু বললো “ও তোমাদের বৌমা”৷ আমি তোমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছি৷

আলতাব সাহেব এটা শুনে কিছুদিন ছেলের সাথে কথাই বন্ধ করে দিলেন৷ বন্ধুসুলভ বাবার এমন গম্ভীর আচরণে জয় অবাক! কিন্ত ভয়ে কিছু বলতে পারছে না৷

এর মধ্যে আলতাব সাহেব স্হানীয় থানা থেকে জয়িতার জীবনবৃত্তান্ত যোগাড় করেন৷ তাঁর মতে দরিদ্রতা অপরাধ নয়৷ সকলেই অভিজাত পরিবারের হবে এমন কোনো কথা নাই বরং জয়িতাদের পরিবারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানাটাই উদ্দেশ্য ছিল৷ কারণ একজন পুলিশ অফিসার হয়ে কোনো ক্রিমিনালদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাটা নীতি বহির্ভূত৷ কিন্ত তিনি জয়িতার লাইফ স্টাইল দেখে আশ্চর্য হয়েছেন৷ মেয়েটি নিজের স্বার্থে যে কাউকে যেমন ব্যবহার করতে পার, তেমনি যে কোনো জঘণ্য কর্মকাণ্ডও ঘটাতে কুন্ঠিত হবে না৷

একদিন আলতাব সাহেব জয়কে ডেকে পুরো কাহিনিটা তুলে ধরলেন৷ রাগ করলেন না বরং যৌক্তিক বিশ্লেষণ করতে বললেন৷ অবশেষে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তটা ছেলেকে জানিয়ে দিলেন৷ বললেন তোমার কাছে দুটো অপশন: প্রথমত যদি আমাদের সাথে থাকতে চাও তাহলে তোমার স্ত্রীকে আইনগতভাবেই ত্যাগ করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত তোমার স্ত্রীর সাথে থাকতে চাইলে আমাদের ত্যাগ করতে হবে৷ তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন তা আগামী তিনদিনের মধ্যেই জানাবে৷

তিনদিন পর আজ বাড়িতে ভীষণ কান্নাকাটি৷ একদিকে মা চিৎকার করে কাঁদছে৷ অন্যদিকে ছোট বোন৷ ব্যালকনিতে একটি রকিং চেয়ারে বসে আলতাব সাহেব দূর আকাশে চেয়ে আছেন৷ অভিব্যক্তি বোঝা দায়৷ জয় বাড়ি ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছে জয়িতাকে নিয়ে৷ কোনো ঠিকানা জানাবে না সে৷ সেওতো কম জেদি নয়৷

জয় জয়িতাকে নিয়ে অন্য এক জেলা শহরে সংসার গড়ে৷ এক রুমের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে৷ কয়েকটি টিউশনি করে চালাতে থাকে সংসার৷ মাস ছয়েকের ভেতর একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি পায়৷ বেতন মন্দ নয়৷ তবুও টিউশনিগুলোও চালাতে থাকে৷ তার জেদ যে করেই হোক প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ জয়িতার জন্য যারা বাড়ি ছাড়া করেছে৷ একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েই তাঁদের সামনে দাঁড়াব৷ বলব সংগ্রাম করে নিজেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়৷
এভাবে দিন গড়াতে থাকে৷

জয়-জয়িতার সংসারের সমৃদ্ধি আসতে থাকে৷ এখন তারা একটা নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে৷ এলাকাটা অভিজাত৷ সুন্দর আর গোছানো সংসার৷ আল্লাহ্ যখন দেয় তখন বেহিসাবি দেয়৷ তাইতো বছর দেড়েক পর তাদের ঘর আলোকিত করে এলো ভালোবাসার সন্তান৷ একটি নয়, দুটি৷ যমজ সন্তান৷ একটি পুত্র আরেকটি কন্যা৷ ভালোবাসা আর সুখে ভরে উঠলো তাদের সংসার৷

বছর দুয়েক পর জয় জাপানে যাবে বলে ঠিক করল৷ তখন বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো৷ যে কেউ টুরিস্ট ভিসা নিয়ে সেখানে যেতে পারে৷ সকলেই যাচ্ছে৷ প্রথমে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে ঢুকতে হবে৷ এরপর কোনো জাপানি নারী বিয়ে করে বিশেষ কায়দায় দীর্ঘদিন থাকা যায়৷ নতুবা পালিয়ে বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করা যায়৷ পারিশ্রমিক মন্দ নয়৷ বিষয়টা নিয়ে জয়িতার সাথে আলাপ করলো৷ আর জানাল যে করে হোক দশটা বছর কাটাতে পারলে নিজেরাই গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে যাব৷ জয়িতা নিষেধতো করলই না বরং উৎসাহ যোগালো৷

অবশেষে একদিন জয় তাদের ছোট্ট দুটি যমজ সন্তানকে রেখে আকাশচুম্বি স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশ ত্যাগ করল৷ প্রথম প্রথম জয়িতার খারাপ লাগলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়৷ জয় যাবার আগেই তার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে সেখানে বেশ কিছু টাকা রেখে দিয়েছে৷ বলেছে টাকা পাঠানো শুরু করা পর্যন্ত এই টাকা দিয়ে চলতে৷ আর মাঝে মাঝে ব্যাংক একাউন্ট চেক করতে৷ টাকা পাঠালাম কি না জানতে৷

মাস তিনেক পর থেকে জয় টাকা পাঠাতে লাগল৷ বাড়িতে টেলিফোন লাগানো হলো৷ প্রায় দিন জয় টেলিফোন করে৷ কথা বলে৷ স্বপ্ন দেখায়৷ জয়িতা বিভোর হয়৷ জয় বলেছে একটা জমি কিনতে৷ সেই জমিতে জাপানের বৌদ্ধ টেম্পলগুলোর মতো একটা বাড়ি বানাতে৷ নাম হবে টোকিও হাউজ৷ জয়িতা একটা জিনিস বুঝতে পারে না৷ প্রবাসিরা যে দেশে থাকে তারা নিজ দেশে সাধারণত: সেই দেশের কিংবা রাজধানীর নামে বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করে৷ যেমন সিঙ্গাপুর হাউজ, সৌদি ভিলা, নিপ্পন কার, নিপ্পন ভিডিও ইত্যাদি৷ এটা অবশ্য বাহিনীর লোকদের মধ্যেও দেখা যায়৷ যেমন সেনা হোটেল, সৈনিক স্টোর, রাইফেলস স্টোর ইত্যাদি৷

দিন বদলে যেতে লাগল৷ বদলাতে লাগল জয়িতা৷ প্রবাসী স্বামীর পাঠানো অর্থ আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক আধিপত্য তাকে লোভী করে তুলল৷

এ সময়ের মধ্যে হঠাৎ করে তার পুরোনো প্রেমিক রাশেদের সাথে দেখা হয়৷ কাকতলীয়! বসন্ত বরণ উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জয়িতা দেখল রাশেদ নামে এক কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করছেন৷ চমকে উঠল সে। রাশেদ এখানে কেন? অনুষ্ঠানের শেষে সে তার সাথে দেখা করে৷ কথা হয়৷ জানতে পারে রাশেদ বিসিএস কমপ্লিট করে একটা সরকারি কলেজের প্রভাষক৷ ওর পোস্টিংটা হয়েছে এ জেলাতে৷ বাংলার শিক্ষক, তাই যথারীতি সাহিত্যচর্চার সাথে জড়িত৷ ইতিমধ্যে বেশ ক’খানা বই প্রকাশ করেছে৷ জনপ্রিয় লেখকের তকমা পেয়ে গেছে৷ জেলার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিয়মিত৷ এখনো বিয়ে করেনি৷ প্রতিষ্ঠিত, সুদর্শন আর অবিবাহিত এক জনপ্রিয় লেখকের জন্য অনেক মেয়েই ক্রাশ খাবে এটাই স্বাভাবিক৷ রাশেদের পিছনে অন্য নারীর সম্পর্ক জয়িতা মানতে পারে না৷ ঈর্ষা হয়! প্রচণ্ড রাগ লাগে৷ ভুলেই যায় যে সে অন্যের স্ত্রী এবং তাদের দু’টো সন্তান আছে৷

সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে জয়িতা আর রাশেদের যোগাযোগ নিয়মিত হতে থাকে৷ অবশ্য টেলিফোনেই বেশি কথা বলা হয়৷ কারণ এখন বাইরে বেশি সময় দেওয়ার সময় নেই৷ বাচ্চা দুটো বড় হয়েছে৷ প্রায় আট বছর৷ ভালো স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য চাপ আরো বেড়ে গেছে৷ স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট পড়াতে নিয়ে যাওয়া৷ আবার বাড়িতে এসে হোম ওয়ার্কগুলো করানো৷ রান্না-বান্নাসহ সংসারের সব কাজ একাই সামলানো৷ ওদের বাবা প্রবাসে থাকার কারণে সেই তাদের বাবা৷ সেই তাদের মা৷ তাছাড়া বাচ্চা দুটো হয়েছেও মা ঘেঁসা৷ সবকিছুতেই আম্মু৷ এখনো ওদের না খাইয়ে দিলে নিজ হাতে খাবে না৷ ঘুমানোর সময় দুজনকে দুদিকে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে গুনগুন করে গান না গাইলে ঘুমাবেই না৷ মাঝে মাঝে ভালো লাগে৷ কিছু সময় বিরক্ত লাগে৷ জয়িতা অনেক সময় ধমক দিয়ে বলে তোদের আম্মু যদি মরে যায়? ওরা বলবে আমরা মরে যাব তবু তোমাকে মরতে দিব না৷ তুমি না থাকলে ভয় করে আম্মু৷ মনে হয় কারা যেন আমাদের মেরে ফেলছে

জয়িতা ধমক দিয়ে চুপ করে দেয়৷

আস্তে আস্তে রাশেদের সাথে ওর সম্পর্ক আরো গভীর হতে থাকে৷ একদিকে পুরোনো প্রেমের জাগরণ আর অন্যদিকে প্রবাসীর স্ত্রী—যে কি না বায়োলোজিক্যাল ডিমান্ড থেকে বঞ্চিত—এক ডেজার্ট ফক্স৷ যা তার নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন ঘটায়৷ যার ফলশ্রুতিতে রাশেদ এখন নিয়মিত তার বাসায় যাতায়াত শুরু করে৷
বাচ্চারা প্রতিদিন আংকেলের বাসায় আসাটা অপছন্দ করতে থাকে৷ জয়িতা রাশেদকে কিছু একটা সমাধানের পথ বের করতে বলে৷ রাশেদের এক কথা জয়িতাকে সে বিয়ে করতে রাজি কিন্ত বাচ্চাদের ছাড়তে হবে৷ জয়িতা দোটানার মধ্যে পড়ে যায়৷ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না৷

হঠাৎ একদিন কোচিং থেকে এসে বাচ্চারা জয়িতা এবং রাশেদকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে৷ জয়িতা হতবাক এ সময়ে তো ওদের ছুটি হয় না৷ পরে জানা গেল মিস অসুস্থ্য তাই ছুটি দিয়েছে৷ প্রজনন বিষয়ে ওদের গভীর জ্ঞান না থাকলেও এটা যে পচা কাজ তা তারা বুঝতে পারে৷ বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জয়িতা আর রাশেদ ওদের সাথে রাগ না করে বরং চাইনিজ খেতে নিয়ে যায়৷ বিষয়টা যেন এখানেই শেষ হয়ে যায়৷

রাতে জয় টেলিফোন করল৷ জয়িতা আদুরে গলায় অনেক কথা বলতে লাগল৷ বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে চাইলে বলল ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিন্ত বাচ্চারা দৌড়ে এসে টেলিফোন ধরে বললো ওরা ঘুমায়নি৷ অগত্যা জয়িতাকে টেলিফোনটা ছেড়ে দিতে হলো৷ সবই ঠিক ছিল কিন্ত হঠাৎ ওরা রাশেদের সাথে ঘটনাটা তাদের আব্বুকে বলে দিলো৷ ভয়ের একটা শীতল স্রোত জয়িতার মেরুদণ্ড বরাবর নামতে থাকল৷ রাগে আর ভয়ে কাঁপতে থাকল৷ এতদিন যে দোটানার মধ্যে ছিল৷ তা ঝেড়ে ফেলল৷ এক পৈশাচিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো৷

পরের দিন রাশেদকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাল৷ জয়িতা ভাবলো ব্যাংকে জয়ের পাঠানো প্রচুর টাকা৷ ইচ্ছে করলেই এগুলো আমার হতে পারে৷ আর একটা কঠিন কাজ করলে রাশেদও আমার৷ জয়িতার সুন্দর মুখে ফুটে উঠে ক্রুর হাসি৷ যে হাসিটাকে জয়িতা নিজেই কখনো দেখেনি৷

সারাদেশ হঠাৎ করে একটা তোলপাড় করা খবর জানতে পারল৷ জ্বর নাশক ঔষধ সেবনে একই পরিবারের দুটি শিশুর মৃত্যু৷ সরকার নিমিষের মধ্যেই সেই ঔষধটি বিক্রয়-বিপণন বন্ধ করা শুধু নয়, বাতিল করে দিলো৷ নির্দিষ্ট ঔষধের নির্দিষ্ট ব্যাচ নম্বর নিয়ে গবেষণাগারে গবেষণা করা হতে থাকল৷ কী ক্ষতিকর কারণ থাকতে পারে যার জন্য দুটো শিশুর প্রাণহানী ঘটল? রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতামূলক বার্তা দিতে থাকল৷ সকলেই বিশেষ করে যাদের ছোট শিশু আছে তারা আতঙ্কিত৷

দুইদিন পর সবাই সত্যটা জানল৷ আসলে ঔষধের কারণে নয়৷ বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে তাদের৷ নিজের মা, গর্ভধারিণী, একইসাথে হত্যা করেছে দুই সন্তানকে৷ প্রথমে বিষ খাইয়েছে৷ তারপর তাদেরকে ঔষধ খাইয়েছে৷ যাতে সকলকে মিসগাইড করা যায়৷ কিন্ত বিধিবাম৷ ডাক্তাররা সেই মায়ের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা দেখে পুলিশকে খবর দেয়৷

প্রাণচঞ্চল আলতাব সাহেব এখন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষে পরিণত হয়েছেন৷ তাঁর একমাত্র ছেলে আজ প্রায় দশ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে গেছে কিন্ত কোনো যোগাযোগ নেই৷ সে কি বেঁচে আছে নাকি…

প্রমোশন পেয়ে তিনি এই জেলার পুলিশ সুপার হয়ে এসেছেন৷ এই কিছুদিন আগে৷ এর মধ্যে এই জেলায় ঔষধ খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু৷ ভাইরাল৷ পুলিশ হেড কোয়ার্টার, মিনিস্ট্রি থেকে চাপ আসছে৷ হালনাগাদ রিপোর্ট করতে করতে বেহাল অবস্থা৷ তার ভাবতে অবাক লাগে সমাজের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এতটাই? সকলেই বিশ্বাস করি যে একজন স্ত্রী খারাপ হতে পারে৷ একজন নারী খারাপ হতে পারে৷ কিন্ত একজন মা কখনো খারাপ হতে পারে না৷ পারে না বলেই আমরা মায়ের জন্য জীবন দিই৷ আমারাইতো একমাত্র সেই জাতি যারা মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি৷ আমারাইতো একমাত্র সেই জাতি যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নয় মাসে তিরিশ লক্ষ প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছি৷ আমারাইতো একমাত্র সেই জাতি যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতা এনেছি জনযুদ্ধে৷ আমারাইতো একমাত্র সেই জাতি যারা মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি সবচেয়ে কম সময়ে৷ অথচ আজ একি ঘটছে?

আলতাব সাহেব ড্রাইভারকে বললেন মর্গে যেতে৷ এমন দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে না করলেও তাঁকে শিশু দুটির লাশ দেখতে হবে৷ বেডে সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো লাশ৷ চাদর সরানো হলো৷ তিনি দেখলেন ছোট্ট দুটি যমজ শিশুর নিথর দেহ৷ দুজনের চোখগুলো খোলা৷ তিনি চিন্তা করলেন মরার আগে হয়তো ওরা খোলা চোখে তাদের মাকে খুঁজছিল৷ বিশ্বাস ছিল মা আসলে ওদের কিচ্ছু হবে না৷ কিন্ত ওরা জানে না ওদের মা-ই হত্যাকারী৷

আলতাব সাহেব বাইরে এলেন৷ একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন৷ গাড়িতে উঠলেন৷ উনি এখন থানায় যাচ্ছেন৷ নিজের যমজ দুটি সন্তান হত্যাকারী মাকে দেখতে৷ গাড়ি চলছে৷ পুলিশ সুপার ঘামছেন৷ তাঁর প্রচণ্ড রাগ লাগছে৷ তবে আলতাব সাহেব এখনও জানেন না যমজ শিশু দুটি কিংবা হত্যাকারী আসলে কে!

গল্প - পরকীয়া - রবীন জাকারিয়া

মুগ্ধতা.কম

২৪ জানুয়ারি, ২০২২ , ১১:১৯ অপরাহ্ণ

অন্ন

লোকটা ভিখেরি নয়; বেশভূষায় মনে হলো খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ। দিনমজুর।  ঘরে তার পাঁচ পাঁচটি মেয়ে। আছে প্রিয়তমা স্ত্রী। সবার মুখে অন্ন তুলে দেবার বাসনায় আর অভাবের তাড়নায় ঢাকা শহরে এসেছে একটা কাজের সন্ধানে। এসেছে সুনামগঞ্জের কোন এক হাওর থেকে।

আমি বসে আছি কমলাপুর রেলস্টেশনে ৯.১০ এর রংপুর এক্সপ্রেসে চেপে মায়ের কাছে ফিরব বলে। মলিন মুখে ঘুম মরা দুটি চোখ নিয়ে মুখে কি ভীষণ আকুতি ঝরিয়ে আদ্র গলায়- সালাম ঠুকে লোকটা বললো-স্যার, কিছু মনে করবেন না। আমি ভিক্ষা করিনা। সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি একটা কাজের জন্য। গাবতলি যাব। পকেটে টাকা নাই। নাস্তাও খায় নাই। গাবতলিতে আমার মত আরও লোকজন আছে। তাদের কাছে গিয়ে একটা কাজ খুঁজে নিব। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় নড়তে পারতেছি না। কিছু খাব। খেয়ে গাবতলি যাব। যদি কিছু সাহায্য করতেন। আমি বললাম- এই মুহুর্তে আমি যেটা দিতে পারব তা দিয়ে আপনার একবেলার খাবার হবে, তারপর?

স্যার, তাই দেন। খেয়েই ওখানে চলে যাব। আমার লোকজন আছে। সে গরীব কিন্তু ভিক্ষুক নয় কিছু টাকা ধরিয়ে দিতেই খুশির বাষ্প ছড়িয়ে সালাম ঠুকে লোকটা গেট পেরিয়ে মিলিয়ে গেল চোখের পলকে! আমি অপলক সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের ভেতর থেকে একটা তপ্ত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো মনের অজান্তে। হঠাৎ খেয়াল করলাম- চোখ দুটো আমার আদ্র হয়ে আসছে। নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। শুধু ভাবনার আকাশে একটি বেখাপ্পা ঘুড়ি ডিগবাজি খেয়ে আছড়ে পড়ল- হায়! আমার সোনার বাংলা; অন্ন যদি নাই-ই দিবার পারো তবে কেন ধারণ করেছিলে নিষ্ঠুর জঠরে?!

নূরনবী বেলাল
কমলাপুর || ২৩.০১.২০২২

অন্ন - নূরনবী বেলাল

রবীন জাকারিয়া

৭ জানুয়ারি, ২০২২ , ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাবার প্রতিচ্ছায়া-গল্প

করোনার থাবায়৷ হঠাৎ করে সারা বিশ্ব যেন থমকে দাঁড়িয়েছে৷ চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল৷ লক ডাইন৷ শাট ডাউন৷ প্রথম পর্যায়েতো বলা যায় কার্ফ্যু জারির মত অবস্থা৷ রাস্তা ঘাট৷ দোকান পাট৷ হাট বাজার৷ রিকসা, ভ্যান, বাস, ট্রেনসহ যোগাযোগের সবই প্রায় বন্ধ৷ এক অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে নিস্তব্দ চারিদিক৷ ক’দিন আগে যে ব্যক্তিটা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নিজেকে বস্তবাদী-ইহলৌকিক দর্শনবাদী হিসেবে জাহির করতো৷ আজ সেই ব্যক্তিই সুন্নতি দাড়ি-পোষাক পরে নিজেকে ইসলামী দর্শনের অগ্রগামী সৈনিক হিসেবে প্রকাশ করছে৷ সন্দেহ আছে যে করোনা নির্মূলের অষুধ বের হবার পরও এ অবস্থানে থাকবে কি-না!

বিশ্ব জুড়ে করোনার করাল থাবায় মরছে মানুষ৷ কী করুণ মৃত্যু! শেষ কৃত্যে পাশে থাকছে না প্রিয় স্বজন৷ যাদের জন্য যন্ত্রের ন্যায় শুধু উপার্জন করে গেছে নিরন্তর৷ বৈধ অথবা অবৈধ উপায়ে৷ জীবনের শেষ লগ্নে প্রিয়জনকে কাছে না পেয়ে কত হৃদয়বিদারক কথা বলে গেল সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর আর বিত্তবান ব্যক্তি! ভাবতে অবাক লাগে এত সম্পদ কিংবা ক্ষমতা তার কোন কাজেই আসেনি৷ আঞ্জুমান মফিদিন কিংবা কিছু সাহসি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠণের গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া কেউ ছিলনা শেষ বিদায়ে৷

সন্তান জঙ্গলে ফেলে আসছে করোনায় আক্রান্ত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন৷ কোন মৃত্যুই কাম্য নয়৷ কাম্য নয় মহামারী৷ কিন্ত তবুও কেন যেন সাদিক সাহেব এটাকে অবশ্যাম্ভাবী একটা বিষয় বলে মনে করেন৷ তার কাছে এটা একটা আশির্বাদ৷  বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ যে নিজেই একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ মানবিক মূল্যবোধ আজ ভূলন্ঠিত৷ সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজেকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এটাইতো সময়৷ মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি যারা ভেবে এসেছিলেন নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা কিংবা চিকিৎসা প্রয়োজন হলে বিদেশে যাবেন৷ তাই চিরকাল অবহেলিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আজ তাদের কাছে অন্ধের ষষ্ঠি৷ প্রচুর অর্থ ছিল৷ ক্ষমতা ছিল৷ হয়তো ভিআইপি পাসপোর্টও ছিল৷ কিন্ত পরিশেষে মরতে হয়েছে এখানেই৷ বেঁচে থাকার কী করুণ আর্তনাদ! কাজে লাগেনি৷

সাদিক সাহেবের কাছে জীবন মানে কিছু দায়বদ্ধতা৷ সামর্থ্য অনুসারে সকলে নিজ দায়িত্বটুকুই পালন করুক৷ তাতেই দেশ-সমাজ পাল্টে যাবে৷ আর মৃত্যু? এটা একদিন হবেই৷ ভয়ের কিছু নাই৷ বরং এটাকে গৌরবান্বিত করাটাই বড় কথা৷

সাদিক সাহেব একটা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন৷ অফিস ঢাকায়৷ গুলশান এমবাসি পাড়ায়৷ রাশান এমবাসির পাশেই৷ দেশব্যাপি লক ডাউনের কারনে সকল স্ট্যাফকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে অফিস করার আদেশ করেন অফিস কর্তৃপক্ষ৷ যেহেতু ডোনার পার্ট৷ সেহেতু পার্টনার অর্গানাইজেশনের কার্যক্রমের রিপোর্টগুলো সামারাইজ করে হেড অফিসে পাঠাতে হবে৷ সপ্তাহে একদিন ভার্চুয়াল মিটিং হবে৷ এভাবেই চলছে অফিস৷ ভার্চুয়াল লাইফ৷

প্রথমদিকে ভালই লাগছিল৷ বাড়িতে শুয়ে বসে থাকা৷ পরিবারের সাথে একসাথে থাকা৷ আবার মাস ফুরোলে একগাদা বেতন৷ মন্দ কী! মনে হলো করোনা যেন মহা সুবিধা এনে দিয়েছে তাকে৷ যদিও অনেক কলিগ৷ অনেক বন্ধু-শুভাকাঙ্খি কর্মচ্যুত হয়ে পড়লো৷ ধীরে ধীরে হাহাকার বাড়ছে৷ এর শেষ কোথায় জানা নেই৷

নিজের বাড়ি মানে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত একখন্ড জায়গায় একতলা একটা বাড়ি৷ অবশ্য শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত৷ বাসা নং ৫০, রোড নং-১৷ বাড়ি থেকে অফিস করা৷ এত সুবিধা৷ কিন্ত সাদিক সাহেবকে বিচলিত করে৷ ভাল লাগে না৷ আসলে এভাবে তিনি অভ্যস্থ নন৷ নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলাবোধের ভেতরেই তার বসবাস৷ অফিসে যাওয়ার সময় নেই৷ পোষাক পরিচ্ছদের বিষয় নেই৷ কেমন যেন একটা অগোছালো জীবন৷ কোন চ্যালেঞ্জ নেই৷ নেই কোন থ্রিল৷

ইদানিং সাদিক সাহেব লক্ষ করছেন তিনি যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন৷ অফিসে কিংবা বাহিরে বের হতে হয়না৷ তাই প্রতিদিন দাড়ি শেভ করা, নিয়মিত চুল কাঁটা কিংবা হেয়ার কালারের প্রয়োজন পড়েনা৷ এতদিন একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মেয়েরাই শুধু সাজুগুজু করে৷ কিন্ত এখন বুঝতে পারছেন নিজেরা কম করেন না৷ নিজেটে পরিপাটি আর স্মার্ট রাখতে কত কৌশল আর প্রসাধন ব্যবহার করতে হতো তা তিনি টের পাচ্ছেন৷ সেলুনে যেতে না পারার কারণে চুল আর দাড়িগুলো যেমনি বড় হয়েছে৷ তেমনি হেয়ার কালার না করার কারণে সফেদ শুভ্র চুল-দাড়িতে নিজেকেই অচেনা মনে হয়৷ বেসিনের আয়নায় নিজেকে মনে হয় এক মধ্য বয়স্ক লোক৷

সাদিক সাহেবের বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন৷ অবসর নেয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন৷ অনেক আগে৷ ২০০০ সালে৷ সুস্থ্য একটা মানুষ৷ রাতে ডাইনিং টেবিলে সকলে একসাথে গল্পগুজব করে খাওয়া-দাওয়া করলো৷ সোফায় বসে বিটিভির খবর দেখছিলেন৷ হঠাৎ শুধু একটা হিচকি দিয়ে পড়ে গেলেন৷ হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা গেলেন৷ অবিশ্বাস্য! বেদনাদায়ক৷ মানতে কষ্টকর হলেও এটাই বাস্তবতা৷ জীবন রেখা একেবারেই ঠুনকো৷ বাবার মৃত্যু কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয় তাদেরকে৷ তখন তিনি লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন৷ তার বয়স ছিল ঊনতিরিশ৷ আর বাবার বয়স পঞ্চাশ৷ মায়ের বয়স ছিল চুয়াল্লিশ৷ অর্থাৎ সাদিক সাহেবের সাথে তার বাবার বয়সের পার্থক্য হলো একুশ বছরের আর মায়ের সাথে পনেরো বছরের৷ অন্যদিকে বাবা-মার বয়সের পার্থক্য হলো ছয় বছরের৷ অর্থাৎ কুড়ি বছর বয়সি  বাবা বিয়ে করেছিলেন চৌদ্দ বছর বয়সি মাকে৷ সে সময় এটাই স্বাভাবিক ছিল৷ কেননা বাল্য বিবাহ বলে কোন বিষয় ছিলনা৷

সময় পাল্টেছে৷ রুচির পরিবর্তন, শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে নারী শিক্ষার উন্নয়ন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন প্রবর্তিত হলো৷ অর্থ উপার্জন আর ক্যারিয়ার সচেতনতা মানুষকে বিত্ত-বৈভব আর চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছে এমন ভাবে ছোটাতে লাগলো যে সে নিজেই ভুলে বসলো নিজের সার্টিফিকেটের নয় সত্যিকারের বয়স৷ সে হোক নারী অথবা পুরুষ৷ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সংসার জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকলো ভীষণভাবে৷ প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের অবাধ যৌণ সম্পর্ক স্থাপন করার বিধি বিধান থাকার পরেও তারা এত বিলম্বিত বিয়ে করেনা৷ কিংবা এত কম সন্তানও নেয়না৷

সাদিক সাহেব যখন বিয়ে করলেন তখন তার বয়স চল্লিশ৷ আর তার স্ত্রীর বয়স পঁচিশ৷ তাদের দুটো সন্তান৷ বড়টি মেয়ে৷ বয়স প্রায় নয়৷ আর ছোটটি ছেলে৷ বয়স চার৷

বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন৷ তাই তার মা পেনশন পান৷ বাড়ি ভাড়া পান৷ তা দিয়ে তিনি স্বচ্ছন্দে চলেন৷ সাদিক সাহেবের মত একজন মধ্য বয়স্ক সন্তানকে নিয়ে তাকে ভাবতে হয়না৷ সাদিক সাহেব অবশ্য মায়ের কাছ থেকে কোন টাকা নেন না৷ বরং নিজেই মাঝে মাঝে বাজার হাট করে দেন৷ মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ অস্বীকার করা কোন সন্তানের উচিৎ নয়৷

আজ কদিন ধরে কেন যেন আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে বড্ড বয়স্ক লাগে৷ একটু সময় ধরে নিজেকে গভীরভাবে লক্ষ্য করেন৷ আয়নায় ভেসে উঠা মুখটা নিজের বলে মনে হয়না৷ কিন্ত খুব চেনা চেনা লাগে৷ হঠাৎ মনে হয় এ মুখটা আর কারো নয়৷ বাবার৷ সাদিক সাহেব ভীত হন৷ চোখ সরিয়ে নেন আয়না থেকে৷

কদিন ধরে সাদিক সাহেব আয়না দেখেন না৷ এমনকি চুল আঁচরানোর সময়ও তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ান না৷ কেননা ইদানিং তিনি প্রতিনিয়ত  আয়নায় বাবার প্রতিচ্ছবি দেখেন৷

চুল-দাড়ি বড় আর সাদা রাখার কারণে প্রতিদিন মেয়ে রাগ করে৷ বলে বাবা তুমি শেভ করতো৷ চুল কালার করো৷ বিশ্রী লাগে! তুমি না করলে দেখবে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি চুল-দাড়ি কেঁটে কলপ লাগিয়ে দেবো৷ তুমি টেরই পাবে না৷ তাছাড়া সামনে তোমার জন্মদিন৷

সাদিক সাহেব অভিভূত হয়৷ এই ছোট্ট মেয়েটা তার জন্মদিন মনে রেখেছে৷ একটা ভাল লাগা অনুভূতি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে৷ তিনি জানেন তার প্রত্যেকটা জন্মদিনে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা বিশাল আয়োজন করে৷ নিজের হাতে কেক বানানো৷ গিফট কেনা৷ সারপ্রাইজড দেয়া৷ তিনি ভীষণ এনজয় করেন৷ অন্যদিকে নিজের চরম ভুলটাও ধরতে পারে৷ বিয়েটা যদি সঠিক সময়ে করতে পারতেন৷ তাহলে এই সন্তানদের মমতাভরা মুখগুলো আরো বেশি বেশি দেখতে পারতেন৷

বাসা ন-৫০, রোড নং-১৷ আজ এ বাড়ির সামনে প্রচুর লোক সমাগম৷ ডেকোরেটর থেকে বিশাল সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে৷ তার নীচে অনেক চেয়ার৷ চেয়ারগুলো ফাঁকা নেই৷ সকলে শৃঙ্খলা আর পরিশালীনভাবে আসীন৷ একটু দূরে একটা জটলার ভেতর থেকে চার বছর বয়সী শিশুর নির্মল হাসির শব্দ উপস্থিত সকলকে ইমোশনাল করছে৷ শিশুটির এক হাতে জন্মদিনের কেক খন্ড অন্যহাতে গোলাপ জলের কনটেইনার৷ দুহাত নাড়াচ্ছে আর সেখান থেকে ছলাৎ ছলাৎ করে গোলাপ জল বেড়িয়ে বাবার গায়ে পড়ছে৷ তা দেখেই সে মজা পাচ্ছে৷ সে এখনো বুঝতে শেখেনি যে সামনে চিরতরে শুয়ে আছে তার বাবা৷ সাদিক সাহেবের আজ পঞ্চাশতম জন্মদিন৷

বাবার প্রতিচ্ছায়া-গল্প - রবীন জাকারিয়া 

রবীন জাকারিয়া

২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ , ৭:৪৮ অপরাহ্ণ

ভাই-শেষ পর্ব

(এই ধারাবাহিক গল্পের প্রত্যেকটি পর্বই স্বতন্ত্র৷ বলা যায় একেকটি গল্প৷ তাই একটি পর্বের পর অন্য পর্ব না পড়লেও পাঠকদের অসুবিধা হবেনা৷ তবে প্রত্যেকটি পর্ব পাঠ করলে একটা উপন্যাসের স্বাদ পাবেন বলে আশা করি৷)

বড়দার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবারটা যেন একেবারে ভেঙ্গে পড়লো৷ বিশেষ করে মা আর যেন স্বাভাবিক হতে পারলো না৷ একদিকে বড়দা’র অভাব আর অন্যদিকে আর্থিক সংকট৷ আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল৷ নিকটাত্মীয়রা একটু টিটকিরি মারতে শুরু করলো৷ এটাই আমাকে আর মাকে প্রচন্ডভাবে জাগিয়ে তুললো৷ যুদ্ধ করতে হবে নিরন্তর৷ হয় লড়ে যাও নয় মরে যাও৷ সমস্ত প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে আবারো লড়াইয়ে নেমে পড়লাম৷ এ লড়াই আমার একার নয়৷ আমার বাবা আর বড়দা’র আত্মত্যাগ৷ আমার মায়ের অধরা স্বপ্ন৷ যাকে লালন আর পূরণ করার জন্য তার এত সংগ্রাম৷ এ স্বপ্ন আমাকে পূরণ করতেই হবে৷ দেশ মাতৃকার জন্য যদি এত মানুষ নিজের জীবন অকাতরে দিতে পারে৷ সেই স্বাধীন দেশের সন্তান হয়ে কেন আমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো না?

আমাদের এই দূর্দিনে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখলো জোতদার তারেক চাচা৷ নিয়তির কী অদ্ভূত ঘটনা! বড়দা’র সাথে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা যখন পাকাপাকি৷ বড়দা তখন অন্যলোকে পাড়ি জমালো! জয়িতা৷ আমার ভাবি৷ যদিও বয়সে আমার ছোট৷ কিন্ত সে আমাদের এই ক্রান্তিকালে সবচেয়ে সাহস জুগিয়েছে৷ যে মেয়ে তার হবু স্বামীকে চিরতরে হারালো৷ তাকেতো আমাদেরই সহানুভূতি জানানো প্রয়োজন৷ নতুবা কিছুই হয়নি ভাব দেখিয়ে তার কেটে পড়বার কথা৷ নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করেই৷ অথচ সে সারাদিন মাকে সান্তনা দেয়৷ রান্না-বান্না করে৷ সেবা যত্ন করে৷ এখনো সে মাকে মা বলে ডাকে৷ আর মার এককথা ও হলো আমার বৌমা৷ আমার মেয়ে৷ জোতদার চাচা মেয়েকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে৷ লাভ হয়নি৷

ইদানিং মা একটু চলাফেরা করে৷ আশে পাশে হাঁটে৷ গল্প করে৷ ভাল লাগে৷ সময় পাল্টায়৷ পরিবর্তিত সময়ের সাথে মানুষ খাপ খাইয়ে নেয়৷ এটাই জীবন৷ আসলে সব কিছুই এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ কিংবা হতে হয়৷ কথায় আছে না Time is the best sealer, killer also. সময় সব ক্ষত মুছে দেয়৷
ধীরে ধীরে আমরাও নতুন স্বপ্নের বাতিঘরের দিকে নাও ভাসিয়ে দেই৷ জীবনের আখেরী লক্ষ যে পূরণ করতেই হবে৷

সমস্ত প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে অবশেষে আমি ডাক্তার হলাম৷ বিসিএস কমপ্লিট করে সরকারী চাকরী পেলাম৷ কর্মএলাকাও আমার পাশের জেলার লাগোয়া উপজেলার হাসপাতালে৷ তাই বাড়ি যাতায়াত প্রতিদিনই বলা যায়৷ মা এখন ভীষণ খুশী৷ তার আচরণে বোঝা যায় জীবন যুদ্ধে জয়ী এক জয়িতা৷ নিজের অজান্তে মাকে স্যালুট জানাই৷ এ শুধু আমার মা নয়৷ হার না মানা এক সংগ্রামী৷ এক বীরঙ্গণা৷

চাকরী পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মা আমার বিয়ে ঠিক করলেন৷ পাত্রী তিনি নির্বাচন করেছেন৷ বড়দা’র মত আমিও বললাম “তুমি যাকে ঠিক করবে আমি তাকেই বিয়ে করবো৷” অবশেষে মার পছন্দের মেয়েকেই আমি বিয়ে করলাম৷ সে আর কেউ নয়৷ আমার হবু ভাবি রেবেকা৷

মা যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ সেটা ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারিনি৷ একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি৷ একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে৷  কেন যেন মনে হতে থাকলো৷ বড়দা’র সবকিছুই আমরা হাতিয়ে নিচ্ছি৷ জীবদ্দশায় তার উপার্জন, ত্যাগ এমনকি শরীরের একটা অঙ্গ নিয়েও থেমে থাকলাম না৷ বরং মৃত্যুর পর তার হবু স্ত্রীকেও ছিনিয়ে নিচ্ছি৷ কী লজ্জা!

বিষয়টা নিয়ে মা’র সাথে কথা বললাম৷ এ পর্যন্ত জীবনে ঐ একরারই মা’র মুখোমুখি দাঁড়ালাম৷ কিন্ত সে যে ব্যাখ্যা দিল৷ তা আমার সমস্ত অনুভূতি নাড়া দিল৷ মা বললো আমাদের সমাজে ঐ মেয়েকে আর কে বিয়ে করতে চাইবে? আমাদের সবচেয়ে বিপদের সময় যে মেয়েটি এত সাহসের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছে৷ সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে৷ দিন রাত আমার সেবা করেছে৷ তাকে কি ফেলে দেয়ার নাম মানবতা বাবা? তোর বড়দা”র সাথে বিয়ের কথা ছিল৷ বিয়েতো হয়নি৷ তাছাড়া ধর্মীয় বা আইনী কোন বাঁধা নেই যে তুই অপরাধবোধে ভুগবি৷

তবুও বিয়ের প্রথম দিকে আমাদের দু’জনের ভেতরে একটা জড়তাবোধ কাজ করতো৷ পরে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়৷
আমাদের দুটি সন্তান৷ দুটিই ছেলে৷ মা দুই নাতিকে নিয়ে এখন সারাদিন ব্যস্ত৷ আমার ধারণা রেবেকার চেয়ে মা-ই ওদের বেশি তদারকি করে৷ আমরা দুজনেও চাই মা ওদেরকে নিয়ে একটু হৈ-হুল্লোর, আনন্দ-স্ফূর্তি করুক৷ জীবনটাকে উপভোগ করুক৷ সারাটা জীবনতো শুধু কষ্টই করলেন৷ এটুকু তো তিনি প্রত্যাশা করতেই পারেন৷

দাদাবাড়িতে অবহেলিত আর অসম্মানে পড়ে থাকা কবর থেকে বাবার কবরটাকে বড়দা’র কবরের পাশে স্হানান্তরিত করেছি৷ কবরের পাশের আতা গাছটা বেশ বড় হয়েছে৷ যেন মমতা ভরা ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে৷ গাছ ভর্তি কাচা-পাকা আতা৷ ডালে অনেক পাখির বসতি৷ মন ভরা দৃশ্য৷ ভাল লাগে৷ মনে হয় এইতো আমাদের মাঝেই আছে সে৷ আমি দেখছি না৷ কিন্ত সে নিশ্চয়ই দেখছে৷ ভাল থাক তোমরা৷ মানুষের জন্য, নীতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা দুই যোদ্ধার কবর আর অবহেলিত হতে দেবো না৷ এ আমার অঙ্গীকার৷ এরা আগামীর বিপ্লবীর প্রেরণা৷ এদের মৃত্যু নেই৷

আমার শশুর আর আমি দুজনে মিলে একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি৷ নাম দিয়েছি “মানব সেবা ফাউন্ডেশন৷” শশুর একটি বড় পুকুরসহ পাঁচ বিঘা জমি দান করেছেন৷ ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ সম্পৃক্ত হয়৷ যা অভাবনীয়৷ এমনকি দরিদ্র ও প্রান্তিকগোষ্ঠির লোকজন মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে সহযোগীতা করে আসছে৷ এছাড়াও বড়দা’র বন্ধু-সহপাঠিরা দেশ-বিদেশ থেকে আর্থিক সহায়তা অব্যহত রেখেছে৷ বিদেশি বেশ কিছু শুভাকাঙ্খি ও দানশীল ব্যক্তি দরিদ্র কিছু শিশুর Sponsorship child এর নামে অর্থ পাঠান৷ আসলে ভাল উদ্যোগ কখনো বিফলে যায় না৷ পৃথিবীতে এখনো ভাল লোক আছে অনেক৷ শুধু আমরা জানি না৷ সকলের সহযোগীতায় নির্মাণ করেছি ইয়াতীমখানা, আধুনিক মাদ্রাসা৷ স্পোর্টস ক্লাব৷ কারিগরি শিক্ষা৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র৷ যেখানে সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র মানুষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে নিজের ও দেশের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারে৷ হয়তো ক্ষুদ্র পরিসরে৷ কিন্ত একদিন এটাকে মানুষ আরো এগিয়ে যাবে৷ কেননা সহজাতভাবেই মানুষ ইতিবাচক পরিবর্তন চায়৷

চাকরীর পাশাপাশি আমি গ্রামে ছোট্ট পরিসরে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছি৷ একেবারে দাতব্য বলাটাও ঠিক হবে না৷ কেননা ১০০/- টাকা ভিজিট নেয়া হয়৷ সবটাকাই দেয়া হয় ফাউন্ডেশনে৷ যাদের সামর্থ নেই৷ তাদেরকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও ঔষধ দেয়া হয়৷ উদ্দেশ্য একটাই যেন অবহেলিত মানুষগুলো চিকিৎসা সেবাটা পায়৷ এটা মায়ের শুধু স্বপ্ন নয় আদেশও বটে৷

অফিস, ফাউন্ডেশনের কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে স্ত্রী-সন্তান-মা সকলকে নিয়ে ঘুরতে বেড়াই৷ এখন রাস্তা ঘাট আগের মত নেই৷ গ্রামের রাস্তাও পাকা৷ তাই গাড়ি নিয়ে ঘুরতে সমস্যা হয়না৷

আজ সকলে এসেছি আমাদের সেই স্কুলে৷ স্কুলটার একপাশে নতুন তিন তলা বিল্ডিং হয়েছে৷ অন্যপাশে স্মৃতি বিজড়িত সেই স্কুল ঘর এখনো আছে৷ বিরাট খেলার মাঠ৷ মাঠের এক কোণে গাড়িটা দাঁড় করলাম৷ সবাই নামলাম৷ মাঠে নেমেই আমার ছেলে দুটো ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷ কে কাকে ধরতে পারে! মা ওদের পেছনে ছুটতে চাচ্ছিল৷ মানা করলাম৷ কেননা তাকে সংযত থাকতে হবে৷ তিনি হচ্ছেন এক কিডনীওয়ালা মানুষ৷ আমাদেরকে বানোয়াট গল্প বানিয়ে যেটি দান করেছে আমার বড়দা৷ যেটা আজো মা জানে না৷ আমি জানাইনি৷ কেননা তাতে মা আহত হবে৷

মাঠে ঘুরতে ঘুরতেই কখন যে মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরাতন স্কুল ঘরের সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি৷ যেখানে একদিন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলাম৷ পাশে মমতা আর ভালবাসায় ভরা বড়দা’র অশ্রুসজল মুখ৷ হেল্যুশিনেশন তৈরি হয়ে আমি যেন নিমিষে সেই মূহুর্তকে দেখতে পাচ্ছি৷ বড়দা বলছে চল বাড়ি যাই৷ মা জিজ্ঞেস করলে বলবি পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে৷

“তোর খুব ক্ষেদে লেগেছেরে ছোট৷ এই নে আতা ফল৷ খেয়ে নে৷ ভাল লাগবে৷” পিছন থেকে কেউ একজন কথাগুলো বললো৷ আরে এটাতো বড়দা’র কথা৷ তবে কি…৷ ঘুড়ে দেখা মা দাঁড়িয়ে৷ হাতে এক জোড়া আতা ফল৷ মার চোখে ভাল করে তাকিয়ে থাকি৷ কিন্ত একি সেখানে দেখতে পাই বড়দা’র প্রতিচ্ছবি৷ আবেগ আপ্লুত হই৷ মা জিজ্ঞেস করে৷ কিরে ছোট কাঁদছিস কেন? কিন্ত কিছুতেই বলতে পারি না যে ইদানিং আমি মায়ের চোখে দুটো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাই৷ একটি মা স্বয়ং৷ অন্যটি হলো বড়দা৷

আচ্ছা আমি কি “সাইকো” হয়ে যাচ্ছি? ইদানিং আমি সবকিছুতেই বড়দাকে দেখি৷ মায়ের চোখে৷ রেবেকার মাঝে৷ এই যে মাঠে সন্তান দু”টো ছুটোছুটি করছে৷ একজন আরেকজন ধরে ফেলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা৷ আসলে ওরা কারা? আমাদের সন্তান নাকি কুড়ি বছর আগের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া আকাশচুম্বি স্বপ্ন দেখা সেই সাজু-রাজু! আমি এবং বড়দা৷ প্রিয় দুই ভাই?

ভাই – পর্ব ১

ভাই – পর্ব ২

ভাই – পর্ব ৩

ধারাবাহিক গল্প - ভাই-শেষ পর্ব - রবীন জাকারিয়া

রবীন জাকারিয়া

২২ ডিসেম্বর, ২০২১ , ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

ভাই – ৩য় পর্ব

আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে একটা বড় ঝড় বয়ে গেল৷ আলহামদুলিল্লাহ্ এর পরেও মার সুচিকিৎসা হলো৷ আমরাতো মার বেঁচে ফেরার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ কিন্ত স্বপ্নের মত সব কিছু ঠিক ঠাক মিলে গেল৷ আমার আশ্চর্য লাগে আল্লাহ্ কোথা থেকে কিডনীর ব্যবস্থা করে দিলেন৷ বড়দা পারেও ম্যানেজ করতে সবকিছু৷ ওকে বলবো মাকে কিডনী দানকারী ঐ ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে যেতে৷ ওনার জন্য দোয়া করবো সারা জীবন৷

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠছে৷ তবে শক্ত কাজ করা বারণ৷ আর ক’দিন পর বড়দা চলে যাবে৷ ইউনিভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে ইতিমধ্যে অনেকদিন কাটালো৷ সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা৷ যদিও পরীক্ষা হয় হয় করে আর হয় না৷ সেশন জট বেড়ে যাচ্ছে৷ আমাদের মত পরিবারের সন্তানদের জন্য এটা জুলুম ছাড়া কিছু নয়৷ অবশ্য শুধু সরকার নয়৷ নোংরা ছাত্র রাজনীতি করে যারা ফায়দা লুটতে চায়৷ তারাও কম দায়ি নয়!
কিছুদিন ধরে বড়দাকে খুব মলিন আর নিস্তেজ মনে হয়৷ জিজ্ঞেস করলে বলে পরীক্ষায় চিন্তা করছিরে ছোট৷ তাছাড়া চাকরি বাকরি না করলে তোর আর মা”র কী হবে? মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে হবে না? বলে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “শোন ছোট আমি যদি না-ও পারি৷ কথা দে তুই মা’র স্বপ্ন পূরণ করবি!” বললাম করবো৷ তবে তুই আগে বড় হ বড়দা৷ তুই যে আমার প্রেরণা৷

বড়দা চলে যাবার পর বাড়িটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ মা সারাদিন কান্নাকাটি করে৷ মাকে বোঝাই এ শরীরে বেশি টেনশন না করতে৷ শোনে না৷ বোঝে না৷ যতই দিন মা যেন অবুঝ হচ্ছে৷ মায়া হয়৷ রাগ লাগে৷ কিন্ত রাগ হইনা৷ বরং সংসারের টুকিটাকি কাজ করি৷ মাকে সাহায্য করি৷ এ বাড়িতে কোন মেয়ে নেই৷ ইদানিং মা বৌমার মুখ দেখতে চায়৷ বড়দার বিয়ের পাত্রিও ঠিক করে রেখেছে৷ আমাদের গ্রামের জোতদারের মেয়ে৷ বড়দা হ্যা-না কিছুই বলেনি৷ বলেছে মা যা চাবে, তাই হবে৷ কনে পক্ষকে বড়দার চাকরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ ওরা খুশি৷ মাঝে মাঝে এটা ওটা পাঠায় হবু বেয়াইনির বাড়িতে৷ আমার হবু ভাবি সুযোগ খুঁজে প্রায়ই মা’র সাথে দেখা করে৷

বড়দা অনেকদিন ধরে আসে না৷ বলেছে সামনে পরীক্ষা৷ পড়ার চাপ৷ পরীক্ষা শেষ হলে একেবারে আসবে৷ আর যাবে না৷

নব্বই এর দশক৷ চারিদিকে আন্দোলন৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটির অবস্থাও দিন দিন খারাপ হতে থাকলো৷ ছাত্রদের আন্দোলন চলমান৷ সংঘাত প্রকট আকার ধারণ করলো৷ হত্যা, খুন, হল দখল আর পুলিশের গুলির সংবাদ প্রতিদিন আসতে থাকলো৷ কর্তৃপক্ষকে পুনরায় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিতে থাকলো ছাত্র সংগঠণগুলো৷ এমন অবস্থায় বড়দার মতো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রিরা পরীক্ষা আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান করলো৷ এটা ছাত্র সংগঠণগুলো ভাল ভাবে গ্রহণ করলো না৷ হুশিয়ার করলো৷ এদের উপযুক্ত শাস্তি দিবে৷ কিন্ত বড়দার মত সত্যিকারের শিক্ষার্থিরা ক্ষেপে উঠলো৷ সংগঠিত হলো৷ প্রতিবাদ করতে থাকলো৷ এমনিতেই বড়দার উপর ছাত্র নেতাদের একটা পূর্ব আক্রোশ আছে৷ কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকেই বিভিন্ন সংগঠণ তাকে দলে ঢুকানোর চেষ্টা করেছে৷ বিশেষ করে ভাল ছাত্রদের সব দল দলে টানতে চায়৷ কিন্ত বড়দা বিনয়ের সাথে এসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করে৷ তার একটাই কথা৷ পড়তে এসেছি৷ পড়বো৷ লেখাপড়া শেষ করে যদি রাজনীতি পছন্দ হয়৷ রাজনীতি করবো৷ না হলে অন্য পেশায় যাবো৷ এখন স্বপ্ন একটাই লেখাপড়া শেষ করে দেশের কাজে লাগাবো৷

প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷ মা, আমি, আমরা টেনশন করি৷ ভয়ে মা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে৷

প্রতিদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতিবেদন দেখায়৷ বাজারের চায়ের দোকানগুলো নতুন কৌশল চালু করেছে৷ সব সময় টেলিভিশন চালু থাকে৷ এতে বেচা বিক্রি বাড়ে৷ শুধু শুধু বসে টিভি দেখা যাবে না৷ কিছু খেতে হবে৷ আমি ক’দিন ধরে নিয়মিত টিভি দেখি৷ চা খাই৷ শেষ হলে আরো চা খাই৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি বিভিন্ন ছাত্রের সাক্ষাৎ নিচ্ছে৷ পরীক্ষা নিয়ে ভাবনার কথা বলছে৷ এমন সময় হঠাৎ দেখলাম বড়দা তার নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরলো৷ তার মতে “পরীক্ষাটা যথা সময়ে হওয়া দরকার৷ না হলে আমাদের মত দরীদ্র ছাত্ররা ঝরে পরবে৷ তারা শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবেনা৷ আমরা শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ব বিদ্যালয়ে এসেছি৷ রাজনীতি করতে নয়৷” টেলিভিশনে বড়দাকে দেখাচ্ছে শুনে দোকানে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল৷ সকলে গর্ব করলো৷ আমিতো বেজায় খুশি৷ আমার গুরু৷ আমার অহংকার বড়দাকে টিভিতে দেখা গেছে৷ ছুটে এসে মাকে বললাম৷ সব শুনে মা কেমন ভীত হয়ে গেল৷ তাকে আতঙ্কিত মনে হলো৷ মা ওকে চিঠি লিখতে বললো৷ যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে৷ তাই করলাম৷

চিঠিটা পেয়েছে কি-না জানিনা৷ কেননা দু’দিন পর এক মহা দুঃসংবাদ পেলাম৷ ছাত্র সংগঠণের নেতা দাবী করা গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা বড়দাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে৷ তার অপরাধ ছিল সে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার পক্ষে মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছে৷ ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে এবং সরকারের পক্ষে দালালি করেছে৷ কিন্ত সাধারণ ছাত্ররা জানে কেন তাকে প্রাণ দিতে হলো৷

বড়দাকে তারা ক্যাম্পাস থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় একটি হলে৷ সেখানে ছাত্রবেশী সন্ত্রাসীরা আটকিয়ে রাখে৷ ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে দফায় দফায় মারতে থাকে৷ বড়দা প্রাণ চেয়েছে৷ ওরা শোনেনি৷ পালাক্রমে নির্যাতন চালায়৷ ব্যথায় কাতরাতে থাকে৷ প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ায়৷ কিছুটা সুস্থ্য হলে আবার পেটাতে থাকে৷ শেষে রাতের বেলা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে লাশটা গায়েব করার চেষ্টা করে৷ কিন্ত অন্যদের হাতে ধরা পরে৷ লাশ ফেলে তারা পালিয়ে যায়৷ এরমধ্যে সারাদেশে জঘণ্য হত্যার খবর ছড়িয়ে পরে৷

কী করে এতো নির্মম আর বিভৎস হয় মানুষ৷ বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থি৷ যারা আগামীতে এক বৈষম্যহীন, উন্নত আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করবে৷

আমাদেরকে পরেরদিন খবরটা নিশ্চিত করে স্থানীয় প্রশাসন৷

বাড়িতে শোকের ছায়া৷ মা বার বার “সাজুরে, আমার সাজু” বলে চিৎকার করে মূর্ছা যাচ্ছে৷ আমার বুকের ভেতর কেন জানি কোন আবেগ দেখতে পাচ্ছি৷ কাঁন্না বেরুচ্ছে না৷ আমার সবচেয়ে প্রিয়জন৷ গুরু৷ নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল৷ স্বপ্নের বাতিঘর৷ বড়দা আর নেই৷ বিশ্বাস হচ্ছে না৷ শুধু মা’র কথা ভাবছি৷ এবার বোধ হয় মাকে আর বাঁচানো যাবে না৷ বুকের ভেতর হাহাকার৷ তীব্র ক্ষোভ৷ প্রকাশ করতে পারছি না৷ তবে কি আমিও বেঁচে নেই? নাকি এ কষ্ট আর যন্ত্রনার জন্য একটা যন্ত্র হয়ে গেলাম!

বিকেলের দিকে ভার্সিটির কয়েকটি গাড়ি আসলো৷ ছাত্র-শিক্ষক ভরা গাড়ি৷ সাথে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি৷ যে গাড়িতে শুয়ে আছে আমার প্রিয় বড়দা৷ দৌড়ে গেলাম গাড়িটার কাছে৷ চিৎকার ডাকলাম বড়দা উঠনা বড়দা৷ চল গাছে কত ফল ধরেছে৷ পেড়ে আনি৷ দু”ভাই পেট ভরে খাব৷ আমরা যে অনেক গরীব৷ দ্যাখ আজকে যে পেটে কোন ক্ষিদে নেই৷ বুকে ক্ষিদে৷ বড্ড ক্ষিদেরে বড়দা৷ আর কান্না আটকাতে পারলাম না৷ কখন মা এসে জড়িয়ে ধরেছে জানিনা৷ মাকে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম৷ বুকের ভেতর যেন মস্ত পাথর চাপা দিয়েছে৷

বাড়ির চারিদিকে লোকারণ্য৷ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে৷ চিনি না৷ বড়দার কারণে এমন দৃশ্য অনেকবার হয়েছে৷ বৃর্ত্তি পাওয়ার সময়৷ এসএসসি ও এইচএসসি-তে স্ট্যান্ড করার সময়ও অনেক লোক এসেছিল৷ সাংবাদিক এসেছিল৷ আজ বড়দার লাশ এসেছে৷ আজও অনেক লোক৷ শুধু পার্থক্য হলো৷ অন্যদিনগুলোতে আনন্দ করেছি আর মায়ের মুখে ছিল বিজয়ের হাসি৷ আজ অত্যন্ত বেদনার দিন এবং মাকে দেখে মনে হচ্ছে পরাজিত এক সৈনিক৷

ফুলে ভরা লাশের গাড়ি থেকে বড়দাকে বের করে আনলো৷ চারিদিকে প্ল্যাকার্ড আর ব্যানারে লেখা “শহীদ সাজু আহমেদ” হাতে নিয়ে ভার্সিটির বন্ধু, সহপাঠি, শিক্ষকরা সম্মান জানালো৷ বিশাল জানাজা শেষে বাড়ির পাশের একটা আতা গাছের নীচে সমাধিস্থ করা হলো৷
মা কবরের উপর মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল৷ তাকে বাড়িতে নেয়া হলো৷

ভার্সিটি থেকে আগত সকলেই বিদায় নিয়ে নিজ নিজ গাড়িতে বসলো৷ কান্নামাখা কন্ঠে বিদায় জানিয়ে মা’র কাছে চলে আসবো৷ এমন সময় একজন শিক্ষক আমাকে ডাকলেন৷ কাছে গেলাম৷ তিনি আমার হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে বললেন এটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের কাগজ পত্র৷ যত্ন করে রেখে দিয়ো৷ এসব কোন কাজে লাগবে না৷ তাছাড়া বুঝিও না৷ তবুও হাতে নিলাম৷ চলে আসবো এমন সময় উনি বিশ্মিত করার মতো একটা তথ্য দিলেন৷ তোমার বড়দার শরীরে দুটি নয়৷ একটি কিডনীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে৷ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম দূর দিগন্তের দিকে৷ কতক্ষণ জানিনা৷ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম কেউ নেই৷ আমি দাঁড়িয়ে আছি একা৷ এই প্রথম নিজেকে একলা একা মনে হলো৷ ভয় পেলাম৷ প্রচন্ড ভয়! বড়দা ছাড়া একা আমি পারবোতো টিকে থাকতে? বাবা-মা আর বড়দা অধরা স্বপ্নকে পূরণ করতে? অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে খেল৷ ভর করলো জেদ আর অভিমান৷ তাই বিড়বিড় করে ভীষণ অভিমান মাখা কন্ঠে শুধু বললাম বড়দা তুই মিথ্যুক৷ আমাদের জন্য তুই নিজের জীবনের সবটাই যে বিলিয়ে দিলি বড়দা৷ তুই সারা জীবন বেঁচে থাকবি৷ হয়তো শারীরিকভাবে নয়৷ আত্মিকভাবে৷ বিমূর্তরুপে৷

ভাই – পর্ব ১

ভাই – পর্ব ২

ভাই – পর্ব ৪

ভাই-৩য় পর্ব (ধারাবাহিক গল্প)
1108 Views

রবীন জাকারিয়া

১৩ ডিসেম্বর, ২০২১ , ২:২৩ অপরাহ্ণ

ভাই

২য় পর্ব

আমার বড়দা জেলা শহরে পড়তে যাওয়ায় মা অনেক খুশি৷ তিনি ভাবেন তাঁর লালিত স্বপ্নগুলো পূরণ হতে চলেছে৷ ছেলে দু’টি অনেক মেধাবী৷ নিশ্চয় মানুষের মত মানুষ হবে ইনশা’আল্লাহ্৷ কিন্ত মনের ভেতর চাঁপা বেদনা৷ ওদের জন্য কিছুই করতে পারছেন না৷ না দিতে পারলেন ভাল খাবার-দাবার৷ আর না ভাল জামা কাপড়৷ এতটুকু বয়স থেকেই ওরা শুধু কষ্টই করে গেল৷ পিতৃহীন এই দু’টি ছেলেকে সহায়তা করতে কেউ এগিয়ে এলো না৷ এমন কি চাচা-ফুফু, মামা-খালা কেউ নয়৷ যতদূর এগিয়েছে৷ ওদের নিজস্ব যোগ্যতা আর কঠোর পরিশ্রমে৷ খুব কষ্ট হয়৷ মা হয়ে এর চেয়ে কষ্ট আর কী আছে? বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে৷

ক’দিন থেকে মাকে খুব মলিন মনে হচ্ছে৷ চোখগুলো লালটে বর্ণের৷ মাকে কাছে ডেকে বলি, “কী হয়েছে মা? আমায় খুলে বলতো?” কিছু না বলে মা এড়িয়ে যায়৷ আমি অভিমান করে বলি যদি না বলো তাহলে কিছু খাবোনা৷ আমার জেদ দেখে মা মলিন একটা হাসি দিয়ে খুলে বললো সাজুটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছেরে বাবা৷ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেমানুষের কাঁদতে শুরু করলো৷ তাঁকে সান্তনা দিতে না পেরে আমিও কাঁদতে লাগলাম৷ আমার সব সহ্য হয়৷ কিন্ত মায়ের কান্না দেখলে নিজের কান্না রোধ করতে পারিনা৷ তাছাড়া মা’র এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে৷ আগের মতো মামাদের সংসারের সব কাজ করতে পারে না৷ তাই মামারা এখন আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে৷ আমরা এখন আলাদা থাকি৷ নানাজান বোধ হয় জীবদ্দশায় তাঁর সন্তানদের চরিত্র বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই মৃত্যুর পূর্বে সম্পত্তি বাটোয়ারা করে গেছেন৷ পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত মায়ের অংশে নতুন বাড়ি করেছি৷ এবার আর খড়ের ঘর নয়৷ টিনের ঘর বানিয়েছি৷ আমি এইটেও স্কলারশীপ পেয়েছি৷ আমাদের দু’ভাইয়ের বৃত্তির টাকা, বড়দার মত আমারও টিউশনির টাকা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছি৷ আর কোনভাবেও আমরা মাকে আর দাসী বানাতে দেব না৷ এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা৷

বড়দা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বায়ো কেমিস্ট্রিতে পড়ছে৷ থার্ড ইয়ার৷ আর কিছুদিনের মধ্যে ও বের হয়ে আসবে৷ ওর যে মেধা আমি নিশ্চিত ও ভাল একটা চাকুরি পেয়ে যাবে৷ মাকে বোঝাই আর ক’টা দিন অপেক্ষা করো৷ তোমার স্বপ্নের দিন এলো বলে৷ কথা শুনে মা হাসে৷ বলে ছোটরে তুই এখনো ছোটই থেকে গেলি৷ আমি কপট রাগ দেখাই৷ বলি দেখ মা আমি আর মোটেও ছোট না৷ এবার এসএসসি দিব৷ তারপর বড়দার মতো আমিও শহরের ভাল কলেজে পড়াশুনা করবো৷ আমাকে যে ডাক্তার হতে হবে মা৷ অনেক বড় হতে হবে৷ তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে৷

একথা শুনে মা খুব রিএক্ট করলো৷ মুখটা কাল করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো৷ তুইও যদি শহরে চলে যাস৷ তাহলে আমি এখানে কাকে নিয়ে থাকবো?
মা’র কথা শুনে আমারও বোধোদয় ঘটলো৷ আসলেতো মা-তো কার সাথে থাকবে? এখানেতো তাঁকে রাখা ঠিক হবে না৷ তাছাড়া শরীরের অবস্থাও ভাল নয়৷ খেতে পারে না৷ শরীরটা ফোলা ফোলা মনে হয়৷ ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার৷ বড়দাকে আসতে বলি৷ কিছুদিন পর বড়দা চিঠি পাঠায়৷ গ্রামেতো ভাল ডাক্তার নেই৷ তাই মাকে নিয়ে আমাকে ঢাকায় আসতে বললো৷ ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে আমিতো ভীষণ খুশি৷ কখনো সেখানে যাইনি৷ বন্ধুদের কাছে কত গল্প শুনেছি৷ কত বড় আর সুন্দর শহর৷ কিন্ত মনের আশা মনেই চেঁপে রেখেছি৷ এখন সুযোগ এসেছে বলে খুশি লাগছে৷ কিন্ত মা যেতে চাচ্ছে না৷ তাঁর নাকি ভয় লাগে৷

কিছুদিন পর মাকে নিয়ে ঢাকায় গেলাম৷ বড়দা ডাক্তার দেখালো৷ অনেক টেস্ট করানো হলো৷ রিপোর্ট দেখে ডাক্তার মাকে হাসপাতালে এডমিট করতে বললেন৷ আমরা দু’ভাই ভয়ে অস্থির৷ কী হয়েছে মায়ের? কিডনী জনীত রোগ৷ কিছুদিন ডাক্তাররা দেখবেন অসুধে কাজ হয় কী-না! তা নাহলে কিডনী প্রতিস্থাপন করতে হবে৷ কী ভয়ংকর ব্যাপার! আমরা এত টাকা পাবো কই? তাছাড়া কিডনীই বা কে দেবে? হাসপাতালের বেডে মায়ের মলীন মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না৷ কান্না পায়৷ মা বুঝে গেছে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না৷ তাই দু’ভাইকে ডেকে বললো, ” বাবা কেউই চিরকাল বেঁচে থাকে না৷ মরে যেতে আমার একটুও ভয় নেইরে সোনা৷ আমিতো মরে গেছি সেদিনই, যেদিন তোদের বাবা মরে গেছে৷ মানুষটার অনেক স্বপ্ন ছিল তোদেরকে মস্ত মানুষ বানানোর৷ দেখে যেতে পারেনি৷ আমিতো বেঁচে আছি শুধু ওঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য৷ আর আমাকে বাঁচতেই হবে৷ তোরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না বাবারা৷”
মায়ের এসব কথা শুনে বুকে মোচড় দিয়ে উঠে৷ কিন্ত মুখে হাসি হাসি মুখটা ধরে রাখি৷ মা যেন কিছুই বুঝতে না পারে৷

দুই ভাই ভীষণ চিন্তা করছি৷ কী হবে! মাকে কীভাবে বাঁচাবো! কিডনী কেনার মত টাকা নেই৷ হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা আমার চেক আপটা করে দেখি না? যদি ম্যাচ করে? ভাই ও মাকে গোপন করে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বললাম৷ তিনি চেক আপের পর হতাশ করলেন৷ ম্যাচ করেনি৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ শেষে মা-ভাইয়ের কাছে ধরা খাই৷

পরেরদিন বড়দা হঠাৎ করে এসে বললো কিডনী পাওয়া গেছে৷ একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি নাকি নিজের অঙ্গ দান করেছেন৷ কিন্ত নিজের পরিচয় গোপন করতে চান৷ বড়দা’র কাছে এসব কথা শুনে  দু’ভাই দু’জনকে জড়িয়ে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ চিৎকার করে হাসলাম৷ তারপর কেন যেন কান্না চলে এলো৷ নিজেদের সামলাতে পারলাম না৷ কাঁদতে কাঁদতেই আল্লাহ্’র দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে বললাম আলহামদুলিল্লাহ্৷
ক’দিন পর বড়দা বললো মায়ের অপারেশনের দিন সে থাকতে পারবে না৷ তাকে সপ্তাহখানিকের জন্য বাহিরে যেতে হবে৷ যে লোক কিডনী দিচ্ছে৷ তার গ্রামের বাড়ি৷

বড়দা ছাড়া আমার অনেক দৌড় ছুট করতে হলো৷ তবুও অবশেষে মায়ের অপারেশনটা সাকসেসফুল হলো৷ ধীরে ধীরে মা সুস্থ্য হয়ে উঠলো৷ কিন্ত বড়দা’র কোন পাত্তা নেই৷ একদিকে ওর উপর রাগ জন্মাচ্ছে৷ অন্যদিকে চিন্তাও হচ্ছে৷ ওর খারাপ কিছু ঘটলো নাতো? কী-যে করি! মাথা আউলায় যাচ্ছে৷
অবশেষে সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে একদিন বড়দা এসে হাজির৷ ওকে পেয়ে মা আর আমি যেন  প্রাণ ফিরে পেলাম৷ কিন্ত ওকে দেখতে কেমন ফ্যাকাসে আর অসুস্থ মনে হচ্ছে৷ বিষয়টা কী? জানতে চাইলে বললো, অচেনা জায়গা আর গ্রামের পরিবেশটা নাকি ওকে স্যুট করেনি৷ তাই কিছুদিন অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিল৷ এখন ভাল৷” যাক বাবা সব কিছুই ভালই ভালই হয়ে গেল৷ ভীষণ একটা শান্তির বাতাস যেন শরীর আর মনকে চাঙ্গা করে দিল৷ ভুলেই গেলাম কতটা দিন না ঘুমে, না খেয়ে কাটিয়ে দিলাম৷ শুধু মায়ের সেবা করেই৷

আজ মাকে রিলিজ দিয়েছে৷ মাকে নিয়ে দু’ভাই বাড়ি ফিরছি৷ মাঝখানে মা বসে আছে৷ তার দুই দিকে আমরা দু’ভাই৷ ভাড়া মাইক্রোবাসটা শহর পেরিয়ে এখন আমাদের গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে চলছে৷ চারিদিকে ধুলোর মেঘ৷ ভাল করে দেখা যাচ্ছেনা কিছুই৷ পিছনে চিৎকার আর চেচামেচির শব্দ বলে দেয় গাড়ি দেখে গ্রাম্য কিশোরদের দূরন্তপনার কথা৷ উইন্ডশীল্ডের ভেতর দিয়ে নেমে আসে শেষ বিকেলের সূর্য্যের রক্তিম আলোচ্ছটা৷ আজকের সূর্য্যটাকে কেন যেন বড্ড মায়াবী আর সুন্দর লাগছে৷ না কি এভাবে কখনো দেখা হয়নি প্রকৃতি? এখনো মা তার দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে দুই ছেলের হাত৷ শক্ত করে৷ মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাই৷ আরো গভীর ভাবে দেখি৷ অনুভব করি ঐ সূর্য্যটার চেয়ে অনেক অ-নে-ক বেশী সুন্দর আর মায়াবী আমার বড়দা এবং মা৷

ভাই – পর্ব ১

ভাই – পর্ব ৩

ভাই – পর্ব ৪

ভাই পর্ব-২ - রবীন জাকারিয়া

রবীন জাকারিয়া

৬ ডিসেম্বর, ২০২১ , ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

ভাই

(১ম পর্ব)

আমরা দুই ভাই৷ সাজু এবং রাজু আমাদের নাম৷ বড় ভাই আমার চেয়ে সাত বছরের বড়৷ ওকে আমি বড়দা বলে ডাকি৷ ও আমাকে “ছোট” বলে৷ ভাই হলে হবে কী? আমরা হচ্ছি গুরু-শিষ্য৷ ও যা বলবে আমাকে তাই শুনতে হবে৷ ব্যতিক্রম হলে আমার খবর করে ছাড়ে৷

আমাদের বাবা নেই৷ খুব ছোট বেলায় মারা গেছেন৷ আসলে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন৷ সার্টিফিকেট নামক এক খন্ড কাগজের জন্য যুদ্ধ করেননি৷ যুদ্ধ করেছেন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন৷ কোন উপঢৌকনের জন্য নয়৷ কোন্ সেক্টর কমান্ডার কী আদেশ দিয়েছেন তাঁর জানা ছিল না৷ বরং গ্রামের কিছু সংগঠিত মানুষের সাথে তিনিও বল্লম হাতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে গিয়ে শহীদ হন৷ যেহেতু তাঁর কোন সার্টিফিকেট নেই তাই তাঁর নামের সামনে শহীদ নয় মরহুম বসে৷ আমরা গর্ব করি বাবাকে নিয়ে৷ উনি আমাদের অনুপ্রেরণা৷ আমাদের অমানিশায় ভরা জীবনের বাতিঘর৷ বাবার কবরটা দাদার ভিটের খুলিবাড়ির এককোণে৷ আমাদের তাড়িয়ে দেয়ার কারণে বাবার কবরটা জিয়ারত করতে পারি না৷ তবে দোয়া করি৷ আল্লাহ্”র কাছে দু”হাত তুলে বলি “রব্বির হাম হুমা কামা রব্বা ইয়ানি সগীরা”

বাবার মৃত্যুর পর চাচা-ফুপুরা মা’কে স্থান দেননি৷ তাই আমরা নানা বাড়িতেই মানুষ৷ নানার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল নয়৷ অন্যদিকে মামা-মামিরা খুব বেশি আন্তরিক নয়৷ আমাদেরকে আপদ মনে করে৷ আমার মা দাসীর মত সংসারের সকল গৃহস্থালি কাজ করে পুষিয়ে দেয়৷ মা শুধু স্বপ্ন দেখেন আমরা যেন লেখাপড়া শিখে মস্ত কিছু হতে পারি৷ কিন্ত নিরাশ হন আমাদের কান্ড কারখানা দেখে৷ লেখাপড়ায় ভাল হলেও দু”জনে খুব দুষ্টু৷ মা বোঝান৷ স্বপ্ন দেখান৷ কিন্ত কে শোনে কার কথা? তাই মা প্রায় সময় মুখ গোমরা করে থাকেন৷

আমার খারাপ লাগে৷ কিন্ত বড়দা’র কথার অবাধ্য হওয়া যাবেনা৷ ও খুবই দূরন্ত৷ আবার স্বার্থপর আর বদরাগি৷ তাই আমি সমীহ করে চলি৷ প্রায় সময়েই আমাদের সকালের নাস্তা হলো ছোট একবাটি মুড়ির সাথে একখন্ড গুড়, খই-মুরখি, বাসি ভাত হলুদ-মরিচ দিয়ে বানানো ভূনা ভাত অথবা শীতের সময় একটা ভাঁপা পিঠা৷ সঙ্গে টিনের কাপে এক কাপ চা৷ কিন্ত বড়দা এখান থেকে ভাগ বসাতো৷ উপায় নেই৷ অন্যদিকে আমি যেন না নিতে পারি৷ সেজন্য ও নিজেরটাতে থুথু ছিটিয়ে দিত৷ এটা খেয়েই স্কুলে যাই৷ আমাদের কাপড় ছিল খুবই সীমিত৷ সেগুলোও খুব মানসম্মত নয়৷ স্পঞ্জের স্যান্ডেল৷ বয়স কত হবে জানিনা৷ শুধু জানি এগুলোকে আরো অনেকদিন চালাতে হবে৷ ছিঁড়ে যায়৷ জোড়া দেই৷ কুপির আগুনে বোতামের দুই মাথা গলিয়ে লাগিয়ে দেই৷ জোড়া লাগে৷ আবার ছেঁড়ে৷ তার দিয়ে বাঁধি৷ বড়দা সব সময় পকেটে তার ভাঁজ করে রাখে৷ পথে যদি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়?

আমাদের স্কুলটা গঞ্জে৷ বাড়ি থেকে অনেক দূর৷ দুভাই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাই৷ বড়দা স্কুলে যাওয়ার শর্টকাট একটা রাস্তা বের করেছে৷ গ্রামের পাশ দিয়ে যে ছড়া নদীটা চলে গেছে৷ ওটা পার হলে পথটা অনেক কমে যায়৷ বেশিরভাগ সময় নদীতে এক কোমর পানি থাকে৷ আমরা দুই ভাই পাট ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আইল ধরে ধরে পথ চলি৷ ওই সময়টুকু আমার ভয় লাগে খুব৷ কেমন অন্ধকার গা ছমছমে নিঝুম পরিবেশ৷ কোথাও কেউ নেই৷ যদি বাঘ ধরে? আবার মনকে সান্তনা দেই বড়দাতো আছে৷

নদীটা অদ্ভূত উপায়ে পার হই৷ বড়দা পকেট থেকে রুমালের মতো ভাঁজ করা একটা শাড়ির টুকরা বের করে৷ লুঙ্গির মতো পড়ে৷ ওর প্যান্ট আর বইগুলো আমাকে ভাল করে ধরতে বলে৷ তারপর আমাকে কাঁধে করে আস্তে আস্তে নদী পার হই৷ ওপাড়ে পোষাক পাল্টে স্কুলের পথ ধরি৷ প্রচন্ড খিদে নিয়েই কাটিয়ে দেই স্কুল টাইম৷ তবে বেশির ভাগ সময় বড়দা স্কুলের কিংবা আশেপাশের গাছ থেকে ফল পেড়ে নিয়ে আসে৷ দু’ভাইয়ে মনের সুখে খাই৷ ক্ষুধার কষ্ট ভয়ঙ্কর কষ্ট৷ খুধা স্বাদ বোঝেনা৷ বোঝে পেটে কিছু দিতে হবে৷ পেটের জ্বালা মিটলে ভাল লাগে৷ মনে হয় আহ্ জীবন কত সুন্দর! তখন বড়দা’কে আপন মনে হয়৷ ও অবশ্য আমাকে ছাড়া খাবেনা৷ কান্না পায়৷ ভাল লাগে৷ আর বড়দা’র প্রতি ভালবাসা বাড়তে থাকে৷ আসলে ও ছাড়া আমি অচল৷ ও বাঁনরের মত গাছে উঠতে পারে৷ বড়দা যখন গাছে উঠে তখন আমাকে বলে “ছোট” তুই নীচে দাঁড়িয়ে থাকবি৷ আমি ফল ফেললে তুই ধরে ফেলবি৷ তাহলে শব্দ হবে না৷ মালিকও টের পাবে না বুঝলি৷ আমার খুব ভয় ভয় করে৷ কিন্ত বড়দা’র অবাধ্য হতে পারিনা৷ একদিন একটা লম্বা গাছ থেকে বড়দা ডাব ফেললো৷ কথামতো আমি সেটা ধরতে পারলাম না৷ বরং মাথার সামনের অংশে লাগলো৷ আমি জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলাম৷ এরপর কিছু বলতে পারি না৷ জ্ঞান ফিরলে দেখি বড়দা ওর স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে আমার মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে৷ আমরা স্কুলের বারান্দায় বসে আছি৷ মেঝেতে রক্ত দেখে ভয় পেলাম৷ শরীর কাঁপতে থাকলো৷ বড়দা বললো চল এখন বাড়ি যাই৷ মা জিজ্ঞেস করলে বলবি৷ পড়ে গিয়ে মাথায় লেগেছে৷ আমি মলিন কন্ঠে বললাম ঠিক আছে৷ সেদিন আমার প্রচন্ড জ্বর এলো৷ প্রলাপ বকতে থাকলাম৷ সারারাত ঘুমাতে পারলাম না৷ ঘোরের মধ্যে যেন বসবাস৷ মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখি৷ মা আর বড়দা জেগে আছে পাশে৷ ওদের দেখে সাহস পাই৷ ভাল লাগে৷ ওদের ভালবাসায় কেঁদে ফেলি৷ মনে মনে বলি শুধু মাকে নয়৷ বড়দা তোমাকেও খুব ভালবাসি৷

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো৷ মেঘে মেঘে অনেক বেলা৷ এসএসসি পরীক্ষায় বড়দা বোর্ডে থার্ড স্ট্যান্ড করে পাশ করলো৷ ও অবশ্য ফাইভ ও এইটেও বৃর্ত্তি পেয়েছিল৷ বাড়িতে লোকের ভীড়৷ ওকে দেখতে দূর গ্রাম থেকেও লোক সমাগম হলো৷ খবরের কাগজের লোকেরা রিপোর্ট করলো৷ কাগজে ছবি ছাপা হলো৷ সে এক এলাহী কান্ড৷ মা’র সাক্ষাতকার নিতে গেল৷ কিন্ত মা কিছুই বলতে পারলো না শুধু কান্না ছাড়া৷ আমার ভেতর একটা জেদ তৈরি হলো৷ আমাকেও বড়দা’র মতো হতে হবে৷ আমার মায়ের দুঃখ ঘোচাতেই হবে৷

কিছুদিন পর বড়দা কলেজে পড়তে জেলা শহরে চলে গেল৷ আমাদের যে আর্থিক অবস্থা তাতে করে বড়দাকে শহরে পড়ানোর খরচ দেয়া অসম্ভব৷ তাই বড়দা একটা বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকবার একটা ব্যবস্থা করে ফেললো৷ স্কলারশীপের টাকা ও দু’একটা টিউশনি করে চালিয়ে নিতে পারবে বলে মাকে আশ্বস্থ করলো৷ শহরে থাকবে৷ কলেজে যাবে৷ তাই ভাল কিছু জামা কাপড় লাগবে বলে মা তার হাতের একমাত্র সোনার চুরিটা বেচে দিলো৷ জামা-কাপড়, মশারি, বেডিংসহ প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে কিছু টাকা বড়দা’র হাতে দিয়ে বললো, “এটা রেখে দে৷ বই-পত্র কিনতে ও প্রয়োজনে কাজে লাগবে৷” একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম মামা-খালারা কেউ কেন যেন খুশি নয়৷ তারা কোন সহায়তাই করলো না বরং বলতে লাগলো দাসীর ছেলের আবার লেখাপড়া! ছোটলোকের ঘোড়ারোগ!

দু’দিন ধরে মা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে৷ শুধুই কাঁদে৷ মা’র কান্না দেখে বড়দা’র মতো শক্ত মনের ছেলেটাও কাঁদে৷ আমি অবশ্য কাঁদছি না৷ বরং খুশিই লাগছে! কেননা ও চলে গেলে আমি ওর রুমটা দখল করতে পারবো৷

আমরা যে ঘরটাতে থাকি৷ সেটা পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ উপরে খড়ের দোচালা ছাউনি৷ সামনে বারান্দা৷ বারান্দায় নানার আমলের একটা জলচৌকি৷ গরমে ওখানেই বসি৷ মা বারান্দাসহ পুরো ঘরের পিড়ালি সব সময় মাটি দিয়ে লেপে রাখে৷ সাদা৷ চকচকে৷ পরিষ্কার৷ ঘরটাতে একটা পার্টিশন দিয়ে করা হয়েছে বড়দা’র রুম৷ আমি ছোট তাই মায়ের বিছানায় এক সাথে থাকি৷ আমাদের বিছানা মানে একটা কাঠের চৌকি৷ তার উপর শুধুমাত্র একটা কাঁথা বিছানো৷ দিনের বেলা কাঁথাটা তুলে রাখা হয়৷ যাতে নোংরা না হয়৷

অন্যদিকে বড়দা’র বিছানা হলো বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা৷ বড়দা খড় বিছিয়ে কাঁথা দিয়ে এমনভাবে গুছিয়ে রাখে৷ শুইলে কী আরাম! এখন মা’র সাথে শক্ত চৌকিতে থাকতে ভাল্লাগেনা৷ তাছাড়া বড়দা রুমটাকে কী যে সুন্দর করে সাজিয়েছে! দেখলে লোভ হয়৷ মায়ের শাড়ির ছেঁড়া টুকরোগুলো সেলাই করে ছাদ বানিয়েছে৷ চারিদিকে বাঁশের বাতা দিয়ে বক্ম করে সেখানে ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন ছবি লাগিয়েছে৷ পুঁই শাকের বিঁচি ফাটিয়ে রং নিয়ে বাতাগুলো রং করেছে৷ এটাই সুযোগ আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বড়দা’র রুমটা দখলে নেয়ার৷ তাই আমি কাঁদছি না৷ বরং খুশি৷

বড়দা চলে যাওয়ার কিছু দিন পার হয়ে গেল৷ এ ক’দিন রুমের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে খুশিতে কাটালাম৷ আজ কেন জানি খারাপ লাগছে৷ খুব খারাপ৷ কাউকে বলিনি৷ আজ অনেক্ষণ একা একা কেঁদেছি৷

মা খেতে ডাকছে৷ কিন্ত ক্ষিদে নেই৷ আমার এখন স্কুলে যেতে ভাল লাগে না৷ ভীষণ ক্ষিদে লাগে৷ কেউ আর এসে বলে না, “ছোট এই নে আঁতা ফল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে৷ খুব ক্ষিদে লেগেছে তাই নারে ছোট?”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি৷ বিড়বিড় করে বলতে থাকি, “বড়দা তুই চলে আয়৷ তুই ছাড়া আমি অচল৷ তোকে আমি বড্ড ভালবাসি৷” কখন যে মা এসেছে টের পাইনি৷ মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা কী দেবে বরং নিজেও জোড়ে জোড়ে কাঁদতে থাকলো৷ আর বলতে বলতে থাকলো, “কাঁদিস না ছোট৷ সোনা বাবা তোদেরকে অনেক বড় হতে বাবা৷ অনেক বড়৷ বল্ আমার এই স্বপ্নটা তোরা দুই ভাই পূরণ করবি? মায়ের কথাটা বুকে তীরের মতো লাগলো৷ আসলেতো আমার মা-তো জীবনে কিছুই পেল না! দুঃখ, কষ্ট আর লাঞ্চনা ছাড়া৷ নিজেকে শক্ত করলাম৷ মনে মনে লক্ষ্য স্থীর করলাম৷ যে করেই হোক মায়ের এই স্বপ্নটা পূরণ করতেই হবে৷

আবেগকে ঝেড়ে ফেলে পুরোদমে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলাম৷ ফলাফল হাতেনাতে৷ ফাইভের বৃর্ত্তি পেলাম৷ মা ভীষণ খুশি৷ বড়দা আমার জন্য একটা জামা পাঠিয়েছি৷ দামি জামা৷ তাই খুব কম পরি৷

সামনে পহেলা বৈশাখ৷ আর বেশিদিন নেই৷ পহেলা বৈশাখে আমাদের এখানে মাছ ধরা প্রতিযোগিতা হয়৷ এদিন ছড়া নদীটাতে সকলেই একযোগে মাছ ধরবে৷ যে সবচেয়ে বেশি ধরে তার জন্য পুরষ্কার থাকে৷ তবে শর্ত একটাই শুধু পলাই দিয়ে মাছ ধরতে হবে৷ প্রতিবার বড়দা’ই ফার্স্ট হয়৷ ও যে চালাক আর ডানপিঠে? ও জানে কোথায় মাছ বেশি পাওয়া যাবে৷ তাই ওর সাথে কেউ পারে না৷ আমি খলাই (বাঁশের পাতলা বাতা দিয়ে তৈরি মাছ রাখার পাত্র) আর একটা ব্যাগ নিয়ে পাড়ে বসে থাকি৷ ও মাছ ছুঁড়ে দেয়৷ আর আমি টপাটপ খলাইয়ে রেখে দেই৷ বড়দাকে চিঠি পাঠিয়েছি৷ তাড়াতাড়ি চলে আসতে৷

বড়দা বহুদিন পর বাড়ি আসবে৷ এজন্য মা খুশি৷ আমি খুশি৷ মা ওর পছন্দের বেশ কিছু খাবার তৈরি করে রাখলো৷ আমি সময় গুনি৷ এখনো আসে না কেন? মাছ ধরার জিনিষ পত্র ঠিক ঠাক করতে হবে৷ নাহলে তো ফার্স্ট হতে পারবো না!

পয়লা বৈশাখের দু’দিন আগে একটা চিঠি আসলো৷ বড়দা লিখেছে ও আসতে পারবে না৷ নতুন বছরের বর্ষপূর্তি কলেজ থেকে করা হবে৷ তাই কলেজের অনুষ্ঠানে তাকে থাকতে হবে৷ চিঠিটা পড়ে মা এবং আমার দু’জনেরই মন খারাপ হয়ে গেল৷ কিন্ত কিছু করার নেই৷

আজ পয়লা বৈশাখ৷ নদীতে মাছ ধরা উৎসব চলছে৷ আমি একটা পলাই ও খলাই নিয়ে নদীর পাড়ে৷ কয়েকবার নদীতে নামার চেষ্টা করলাম৷ মাছ ধরবো বলে৷ কিন্ত পানি অনেক বেশি৷ আমিতো ঢুবে যাবো৷ তাই বিষন্ন মনে নদীর পাড়ে বসে আছি একাকী৷ পাশে পড়ে আছে অব্যবহৃত পলাই আর খলাই৷ যেগুলো গতবার শেষ ব্যবহৃত হয়েছিল বড়দার চৌকষ হাতে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আজ গরমটা খুব বেশি৷ এই রোদ কিংবা গরম কোনটাই আমার ভাল লাগে না৷ কিন্ত কেন যেন আজ লাগছে৷ কেননা চোখের জলগুলো গোপনে মুছে ফেলার আগেই তা সহজেই শুকিয়ে যাচ্ছে৷ পানিতে মাতামাতি করবার এই দিনে নোনা পানিটুকু থাক না চোখের গহ্বরে৷

ভাই – পর্ব ২

ভাই – পর্ব ৩

ভাই – পর্ব ৪

ভাই - রবীন জাকারিয়া